ভ্রমণ

নৌকায় চড়ে ডিমচর ভ্রমণের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা

কামরুলকে না জানিয়ে বিশাল এক ট্রলারে আমিসহ কয়েকজন সাগরের গভীরে রওনা দেই। চালকের গদিতে আমি বসেছিলাম আর মনের আনন্দে ট্রলার চালাচ্ছি। তবে ঝামেলা হলো ট্রলারটিকে আমি সাগরের ঢেউয়ে একবার ডানে একবার বাঁয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

Advertisement

এতে অন্যরা খানিকটা বিরক্ত হচ্ছিল। হঠাৎ পানির দিকে তাকিয়ে দেখি আমাদের দিকে বিশাল এক তিমি মাছ এগিয়ে আসছে। আমার তো ভয়ে গা কাঁপছিল। তিমি মাছটি সামনে এসে লেজ দিয়ে ট্রলারে বেশ জোরেই ধাক্কা দিলো। ট্রলার তো ঢুলতে ঢুলতে কটকট মড়মড় আওয়াজ করতে লাগলো। হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে গেলো। এ কী! এতো তিমি মাছ না। খাটের ওপর আমাদের কামরুল ভাই নড়াচড়া করছেন।

নিজেকে সামলে মোবাইল নিয়ে দেখি ভোর সাড়ে ৬টা বাজে। মোবাইলও ফুল চার্জ। দুবলারচরের সবাই সোলার প্যানেল ব্যবহার করেন। জরুরি প্রয়োজনে জেনারেটর। ঘুম থেকে উঠে দেখি বাইরে অনেক ঠাণ্ডা, তাই কম্বল গায়ে নিয়েই ঘর থেকে বের হলাম।

আকাশে চোখ মেলতেই দেখি সূর্য উদয়ের কিরণ আমারে দিকে চেয়ে আছে। ছুটে গেলাম খালের পাশে। লাল সূর্যের আলো পানির ওপর ঝিলিক দিচ্ছে। আরেক পাশের আকাশে চিল উড়ছে। ওই দূরের বন থেকে পাখিদের আওয়াজ ভেসে আসছে। আরেক পাড়ে বন শুকর পানি খেতে খালের কিনারায় ঘুরছে।

Advertisement

স্নিগ্ধ সকালে বড় ট্রলারে দুবলায় মালামাল আনা হয়েছে। শ্রমিকরা সেগুলো নামাচ্ছেন। জেলেরাও ট্রলারে করে মাছ নিয়ে ফিরে আসছেন। হঠাৎ কিছু সময়ের জন্য নিজেকে জেলে ভাবতে লাগলাম। আর তখনই মনে পড়ে গেলো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসের কুবের চরিত্রের কথা।

যদি এখানে একটা কপিলা চরিত্র (কুবেরর শ্যালিকা) থাকতো। আবার মালা চরিত্র (কুবেরর স্ত্রী) যদি কপিলার সঙ্গে কুবেরকে দেখে ফেলতো। নিজেকে কুবের চিন্তা করেই হঠাৎ হেসে উঠলাম। একা একা এমন পায়চারি শেষে কামরুল ভাইয়ের কথা মনে পড়লো।

আহা ছেলেটা এমন নয়নাভিরাম সৌন্দর্য মিস করছে। গিয়ে তাকে ডেকে তুললাম। কিন্তু সে আগে ব্রাশ করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো। মুখ ধোয়া শেষে আমরা আবারও খালের পাড়ে যাই। এদিকে সকাল সাড়ে ৮টা বেজে গেলো। সকালের নাস্তাও খাওয়া লাগবে।

দেলু ভাই ব্যস্ততা শেষ করে বললেন নিউ মার্কেট গিয়ে পরটা ভাজি খাবেন। তো সেখানেই রওনা দিলাম। শিশির ভেজা ঘাস মাড়িয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। যেতে যেতে আবারও বাঁশের মাচা ও হ্যাঙারে শুঁটকির মাছের সারি দেখছি।

Advertisement

অনেকে শুঁটকি গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। আবার অনেকে ট্রলারে আসা মাছ বাছাইয়ে ব্যস্ত। অনেকে মাচায় মাছ ঢালতে ব্যস্ত। জেলে ও শ্রমিকদের ব্যস্ততা দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম নিউ মার্কেটের আগের হোটেলটিতে।

আজকে ঠিক সময়ে যাওয়ায় মিললো গরম গরম পরটা। সঙ্গে ডিম, আলুভাজি ও ডাল পেলাম। সেরে নিলাম চায়ের পর্বও। মার্কেটে কয়েকজনের সঙ্গে তাদের কাজ কর্ম নিয়ে আলাপও হলো।

ফিরে এলাম বেলায়েত সরদারের ঘরের কাছে। দুপুরের খাবারে আজও আমরা সামুদ্রিক মাছ খাবো। তাই দেলু ভাই ও বেলায়েত ভাইয়ের বাবা মাছের সন্ধানে আমাদের নিয়ে এর-ওর ঘরে ঘুরতে লাগলেন।

জেলেরা হরেক রকম মাছ পেয়েছেন। কারও কাছে ছুরি, ছোট লইট্টা, ভোলা, বোল, ভেটকি, তিন প্রজাতির রূপচাঁদা, বাঁশ পাতা, লাখ্যা, কয়েক জাতের চিংড়িসহ নাম না জানা অনেক মাছ রয়েছে।

দেলু ভাই দেখি ভূত পমফেট ও চাইনিজ পমফেট নামের দুই জাতের বড় দুটি রূপচাঁদা মাছ নিয়ে আসলেন। একেকটার ওজন প্রায় এক কেজির কাছাকাছি।

অন্যদিকে বেলায়েত ভাইয়ের বাবা বড় বড় ৩টি বাঁশপাতা মাছ নিয়ে আসলেন। ওজন প্রায় ৩ কেজি। মাছগুলো নিয়ে আরও কয়েকটি ঘরে ঘুরতে লাগলাম। হঠাৎ জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। তিনি তার নিজের ট্রলারে থাকা পর্যটকদের দুবলারচর দেখাতে নিয়ে এসেছেন।

সৈয়দ মুকিদ নামের এক পর্যটক শুঁটকি কিনতে এসেছেন। তার সঙ্গে বেশ আলাপ হলো। বলে রাখা ভালো জাহাঙ্গীর ভাই সাংবাদিক মোহসীন উল হাকিম ভাইয়ের ভিডিওতে থাকা একজন। এ ছাড়াও তিনি একসময় দস্যুতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

তবে মোহসীন ভাইয়ের কল্যাণে তিনি সেই বিপথ থেকে ফিরে আসেন। এখন নিজের ট্রলারে পর্যটকদের সুন্দরবন ঘুরিয়ে দেখান। এদিকে তাদের যাওয়ার সময় হয়েছে। তাই একটা টঙ দোকানে চায়ের পর্ব শেষে বিদায় জানালাম।

মাছ নিয়ে আমারও ঘরে ফিরে গেলাম। গিয়ে দেখি বেলায়েত ভাইয়ের বাবা ইলিশ ও জাভা মাছ নিয়ে এলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ছয় কেজির মাছ হয়ে গেলো। সকাল ১০টা বেজে যাওয়ায় দেলু ভাই আর দেরি না করে মাছ কাটায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অন্যদিকে আমি, কামরুল আর রুহুল ভাই মাছ নিয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত।

আজ আমি, কামরুল, রুহুল ভাই ও প্রসেনজিৎসহ পাঁচজন বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবো। দেখবো বনে থাকা প্রাণীদের। ছোট ছোট খালে জাল মেরে মাছ ধরবো। তাই সাড়ে ১১টার দিকে আমরা একটা নৌকা প্রস্তুত করলাম। প্রসেনজিৎ ভাই একটা খেয়া জালও নিয়ে আসলেন। সঙ্গে ছিল শুকনো খাবার আর এক বোতল পানি।

নৌকায় আছে দুটি বৈঠা। বৈঠা বাওয়া মাঝির কাজ। কিন্তু আমাদের সবাইকে ধারাবাহিকভাবে বৈঠা বাইতে হবে। প্রথমে প্রসেনজিৎ দাদার বৈঠার ঠেলায় ভাসতে শুরু করলাম পানিতে।

এ সময় আমি আর কামরুল মনের খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। আশপাশের ট্রলারে থাকা লোকজনও আমাদের সঙ্গে সাড়া দিলেন। এই অল্প সময়ে হৈ হুল্লোড় যেন এখনো কানে শুনতে পাচ্ছি।

ভাসতে ভাসতে আমরা খালের মাঝে। হঠাৎ দু-একটা ট্রলার চললেও নেই কোনো কোলাহল। নিস্তব্ধ চারদিক। হালকা বাতাসের সঙ্গে ঢেউয়ের পানির তারতম্য দেখতে বেশ ভালোই লাগছে। একই সঙ্গে বৈঠার চাপে পানির শব্দ। সব মিলিয়ে আমরা প্রকৃতিতে হারিয়ে গেছি।

নৌকা এখন ডিমচরের তীর দিয়ে চলছে। এ চর প্রায় ডিম আকৃতির। নামও তাই ডিমচর। এর সাগরের পাশটা ফাঁকা বালুচর তবে ভেতরের অংশে ঘন জঙ্গল। বাহারি গাছে ভরা এই চর। তবে এই চরে একটা ভয়ের বিষয়ও আছে। এ চরে নাকি বাঘের বিচরণ বেশি।

দুবলার লোকজনও এই চর থেকে বাঘের গর্জন শুনতে পায়। এসব শুনে আমাদের ডিমচরে নামার আগ্রহ হারিয়ে গেছে। তবে মাঝে মাঝে আবার সাহসও জাগে। তবে বেলায়েত ভাইয়ের নির্দেশ আমরা যেন ওই চরে না নামি। তাই তীর ঘেঁষে যেতে যেতে বন দর্শন করছি।

কিছুদূর যেতেই দেখি একটা বিশাল আকৃতির সাদা বক মাছ খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার ওপরেই বন থেকে বেরিয়ে আসছে কয়েকটি বানর। তাদের দেখার জন্য আগ্রহ নিয়ে দ্রুত সামনের দিকে এগোতে থাকলাম। একি.. কয়েকটা নয় গাছ গাছালিতে ভরে গেছে কয়েকশ’ বানরে।

আমাদের কাছে থাকা বিস্কুট তাদের ছুড়ে দিতে থাকলাম। সবাই সে খাবার নিতে কাছে আসতে চায়। তবে বানরের কথিত রাজা (অনেক রাগি) তাদের আসতে দিচ্ছে না। সম্ভবত সে বলতে চাইছে ‘সব খাবার আমার, তোরা বনের ভেতর গিয়ে খা’।

এদিকে কামরুলের এতো বানর দেখে আর তর সইছিল না। হুট করে নেমে বানরের কাছে চলে যায়। কিন্তু বানরগুলো তাকে দেখে তার থেকে দূরে চলে যায়। এভাবেই খুনসুটি শেষে আমরা চলে যাই ছোট দুই খালের মোহনায়। এক পাশে ডিম চর, আরেক পাশে নাম না জানা আরেকটি চর।

আমরা এবার সেখানেই নামবো। তবে কামরুল বাঘের কথা শুনে নামতে চাইছিল না। তবে রুহুল ভাইয়ের অভয়ে পরে সবাই নামলাম। অল্প সময়ে কয়েকশ ছবি তোলা শেষ। এবার পালা জাল মারার। আমাদের সঙ্গে থাকা এক দাদা খালে জাল ফেলতে লাগলেন।

জালে দু-একটি বেলে আর চাকা চিংড়ি মাছ ছাড়া কিছুই আসছে না। এভাবে কয়েকবার জাল ফেলার পর হতাশ হয়ে যাই। কিন্তু নয়নাভিরাম বনে সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভুলিনি। আমরা পাঁচজন ছাড়া সেখানে আর কেউ নেই।

এর ফাঁকে কামরুল দেখি এক দৌড়ে গিয়ে খালে লাফ দিলো। প্রথমে তো আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে, কী হলো তার। পরে বুঝলাম রোদে অতিষ্ঠ হয়ে সে খালে সাঁতার কাটতে নেমেছে। যখন প্রসেনজিৎ দা বললো কুমির, ঠিক তখনই হুড়মুড় করে উঠে গেলো। উঠেই বলা শুরু করলো ‘এ কী করলাম আমি’।

আমরা কিছু সময় ওই খালে থেকে আবারও নৌকায় উঠি। এখন যাবো মায়াবী হরিণের খোঁজে। বৈঠা বেয়ে আরেকটি খালে যেতে হলো। ভাটার বিপরীতে থাকায় ধীরে চলছে নৌকা। তীর ঘেঁষে যাওয়ার সময় দেখা মিললো কয়েকশ বানর ও বিশাল শূকরের।

মা শূকরের সঙ্গে খাবার খুঁজছে শাবক শূকরও। দূরে আরেকটা বিশাল শূকর পানির জন্য খালে নেমে এসেছে। আমরা তার কাছে যেতেই সে দৌড়ে ওপরে উঠে যায়। সেখানেও বানরদের অবশিষ্ট বিস্কুটও ছিটিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। বানরের বাচ্চাগুলো খাওয়ার চেষ্টা করেও পায়নি।

আরেক খালের কিছুদূর যেতে দেখা গেলো কয়েকশ গাছ মরা অবস্থায় শুকিয়ে আছে। সেখানে গিয়ে গাছগুলো দেখলাম। সেখানে একটা ‘মদন টাক’ পাখির দেখা মেলে। তবে কয়েক ঘণ্টা থাকার পরও আমরা কোনো হরিণ দেখলাম না। এদিকে বিকেল হয়ে গেছে। তাই আর দেরি না করে হতাশ মনে ফিরতে লাগলাম।

বিকেল সাড়ে ৩টায় বেলায়েত ভাইয়ের বাসায় ফিরে এলাম। এসে দেখি দেলু ভাই সকালের সংগ্রহ করা মাছ দিয়ে চার পদের রান্না করেছেন। গোসল সেরে আমরা খাবার খেতে বসলাম। চাইনিজ পমফেট মাছটি মুখে দিতেই আহা কি স্বাদ।

লবণ, ঝাল মসলা সবকিছুই ভালোভাবেই হয়েছে। এরপর খেলাম বাঁশপাতা মাছ ভাজা। এর স্বাদও অন্যরকম। নিজের অজান্তেই হঠাৎ আহ.. কি মজা বলে চিৎকার দিয়ে উঠলাম।

অন্যদিকে কামরুল ভাই আমার দিকে তাকায় আর চুপচাপ স্বাদ চেখে নিচ্ছে। পরে দেলু ভাই দিলো বেগুন আর টমেটো দিয়ে রান্না করা ভূত পমফেট মাছ। এ মাছের রান্না খেয়ে মনে হচ্ছে সবগুলোর মধ্যে যেন এটিই অসাধারণ স্বাদ। একটা থেকে একটার রান্না মজা। কোনোটিই আপনি ১০/১০ নম্বর না দিয়ে পারবেন না।

যাই হোক খাবার শেষে গামছায় হাত মুছতে মুছতে জানতে পারলাম আমাদের জন্য ইলিশ মাছও রান্না হয়েছে। তবে দেলু ভাই বা আমাদের কারও মনে ছিল না। এত মজার মজার রান্না খেতে খেতে আরেকটা আইটেমের কথা নিমিষেই ভুলে গেছি সবাই।

তখন কামরুল ভাই বললো সমস্যা নাই রাতে মোংলায় ফেরার ট্রলারে উঠার আগে আমরা ইলিশ দিয়ে ভাত খেয়ে নিবো। কারণ আজ রাতেই যে আমাদের মোংলায় ফিরতে হবে।

চলবে…

জেএমএস/এএসএম