ভ্রমণ

মনভোলানো বাহারি মাছের স্বাদ মেলে দুবলারচরে

দুবলারচরে উঠেই মাছ ব্যবসায়ী দেব চাচার (বেলায়েত ভাইয়ের কাছের) ঘরে ব্যাগ রাখলাম। কাদা মাখা পা পরিষ্কার করতে চলে গেলাম কূপে। বলে রাখা ভালো এ চরের মানুষ নিজেদের তৈরি করা কূপ থেকেই মিঠা পানি সংগ্রহ করে।

Advertisement

চরের চারদিক নোনা পানি থাকায় কূপই তাদের পানি ব্যবহারের একমাত্র ভরসা। কাদা পরিষ্কার শেষে হাত-পা ধুয়ে দেব চাচার ঘর থেকে ব্যাগ নিয়ে চলে গেলাম চরের নিউ মার্কেটে নাস্তা করতে।

দু’পাশে দোকান, মাঝে হাঁটার জন্য সাত হাতের মতো রাস্তা। এ মার্কেটে গিয়ে আপনি হতাশ হবেন না। কারণ চাহিদার সবকিছু মিলবে সেখানে। হাঁটতে হাঁটতে মাঝ বরাবর গিয়ে একটা খাবার হোটেলে বসলাম। দুপুর সাড়ে ১২টা বেজে যাওয়ায় রুটি বা পরটা কোনোটিই নেই।

তবে লোভনীয় সিঙাড়া ভাজা দেখেই খেতে মন চাইলো, কিন্তু কেন জানি খাওয়া হলো না। তাই শেষ সময়ে ঠান্ডা পড়ে থাকা লুচি, ডাল আর ডিম খেলাম। খাবারের স্বাদে মনে হবে না আপনি চরে আছেন। নাস্তা শেষ করেই কেউ দুধ চা আবার কেউ রঙ চায়ের স্বাদ নিলাম।

Advertisement

খাবার হোটেলে গিয়ে পরিচয় হয় বেলায়েত সরদারের কাছের এক ভাই দেলুর সঙ্গে। অনেকে তাকে মিঞা ভাই বলেও ডাকেন। তিনি খুবই ভদ্র ও মিশুক প্রকৃতির। নাস্তা শেষে এবার বেলায়েত ভাইয়ের তৈরি করা ঘরে যাওয়ার পালা। পৌঁছাতে প্রায় ১০ মিনিট সময় লাগলো।

যেতে যেতে বাঁশের মাচায় মাছ শুকানো আর শুঁটকির প্রক্রিয়ায় শ্রমিকদের খুব ব্যস্ততা দেখা গেলো। কেউ মাচায় মাছ সাজিয়ে দিচ্ছেন। কেউ আবার শুকিয়ে যাওয়া মাছ তুলে নিচ্ছেন। আবার কেউ শুকিয়ে যাওয়া মাছগুলো জাত ও আকারভেদে ভাগ করে রাখছেন।

জানতে পারলাম, এই চরে থাকা জেলেরা মাছ ধরে আনার পর একেবারে তাজাগুলো মহাজনরা ট্রলার লোড করে খুলনা, বরগুনার পাথরঘাটাসহ বেশকয়েকটি মৎস্যঘাটে নিয়ে পাইকারি বিক্রি করেন। আর চরে যে মাছগুলো থেকে যায় সেগুলো বাঁশের মাচা ও পাটিতে শুকাতে দেন।

শুঁটকি হয়ে গেলে ভালো-খারাপ বাছাই করে বস্তাবন্দি করা হয়। কার্গোতে করে খুলনায় নিয়ে খালাস করা হয়। পরে সেখান থেকে ট্রাকে শুঁটকিগুলো চলে যায় চট্টগ্রামের আড়তে। সেখান থেকে চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন বাজারে খুচরা ব্যবসায়ীরা শুঁটকি কিনে বিক্রি করেন।

Advertisement

আমরা পৌঁছে গেলাম ঘরে। রুহুল ভাইও আমাদের এগিয়ে দিয়ে আবার তার ঘরে চলে গেলেন। আমরা যে ঘরে থাকছি তা কয়েকভাগে ভাগ করা। বেড়া দিয়ে রান্নার জন্য একটা ভাগ, শুঁটকি মাছ রাখার জন্য একটা ভাগ, দুই ভাগে শোবার ব্যবস্থা।

বিশ্রাম ও ঘুমানোর জন্য উঁচু বাঁশের খুঁটি আর কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে একধরনের খাট। এর ওপর বিছানাপত্র দেওয়া আছে। যেহেতু শীত মৌসুম তাই ঠান্ডা নিবারণের জন্যও আছে কম্বলের ব্যবস্থা।

ঘরের একটু দূরে রিং বসিয়ে শৌচাগারের ব্যবস্থাও করা আছে। এ শৌচাগার নিয়েও আছে মাজার কাহিনি। আমার বেশি চাপ আসাতে শৌচাগারে যাই, ভেতরে গিয়ে দেখি কমোডের মুখ ঢাকা। কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। ভাবলাম এখনো আন্ডার কনস্ট্রাকশনে আছে (কাজ চলমান)।

এই ভেবে বাইরে এসে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম যে, মল-মূত্র ত্যাগ করেন কই? তারা ওই শৌচাগারটি দেখিয়ে দিলেন। লজ্জায় কাউকে ওই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আবার ভেতরে গেলাম। বদনায় থাকা পানি ঢালতে শুরু করলাম প্রথমে। ওমা.. একি.. পানির ভারে ঢাকনাটা টপ করে আওয়াজ করে খুলে গেলো।

পানি তারপর রিংয়ের ভেতর পড়তে থাকলো। আবার কমোডের মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। আমি কামরুলকে বলিনি। কামরুলের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল বলে জেনেছি। বিষয়টা খুব মজার হলেও কিছুটা বিব্রত ছিলাম দুজনই।

ব্যাগ রেখে কামরুল গোসল করতে গেলেন। জোয়ারের সময় সংগ্রহ করা নোনা পানিতেই গোসল করছিলেন তিনি। এর পাশেই আশির্ধ্ব এক ব্যক্তি রান্না করছিলেন। আমি গেলাম তার কাছে। দেখি পেঁপে রান্না করছেন।

এ বৃদ্ধ ২৬ বছর ধরে সুন্দরবনে আছেন। স্ত্রী-সন্তান ও বাড়ির মায়া ছেড়ে প্রতিবছর পাঁচ মাসের জন্য চরে আসেন। শ্রমিক হিসেবে কাজ করে যা পান তা দিয়েই সারা বছরের সংসার চলে। তার সঙ্গে গল্প করতে করতে দেখি কামরুল ভাইয়ের গোসল শেষ।

সেই ঢাকা থেকে সুন্দরবনের শেষ অংশ পর্যন্ত লম্বা একটা পথ পাড়ি দিয়ে আমি আর কামরুল ভাই বেশ ক্লান্ত। কামরুল জামা পরিবর্তন করেই শুয়ে গেলেন। কিন্তু চরের অপরূপ সৌন্দর্য আমাকে ঘুমাতে দেয়নি।

আশপাশে হেঁটে দেখে নিলাম। বেলায়েত ভাইয়ের ঘরের পাশে খালের শাখা। সেখানে গিয়ে কতক্ষণ পায়চারিও করলাম। কীভাবে ও কোন দিক আসলাম সব পরখ করে দেখলাম।

দুবলায় অসংখ্য অস্থায়ী ঘর আছে। প্রায় ৩০ হাজার জেলে, শ্রমিক, মহাজনরা এখানে বসবাস করেন। ঘরগুলোর দিকে তাকালেই চোখ ফেরানো যায় না। বাঁশ দিয়ে ঘরগুলো তৈরি।

আর ঘরের চালায় বর্ষা মৌসুমে দুবলায় জেগে ওঠা ঘাস দিয়ে দেওয়া হয়। তা শুকিয়ে ছনের মতো হয়। আর চারদিক ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়। এতে রোদ বা বাতাস কোনটিই সহজে প্রবেশ করতে পারে না।

প্রায় ঘণ্টা দুই পর ঘরে ফিরে এলাম। এসেই দেখি দেলু ভাই রান্নার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। আমাদের জন্য আনলেন জাভা ও দাঁতিনি মাছ। মাছ কেটেকুটে পরিষ্কারের কাজও শেষ।

চরে মোটামুটি সবাই সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা ব্যবহার করেন। কিন্তু গ্যাসের চুলা নষ্ট থাকায় দেলু ভাইকে মাটির চুলায় কাঠ দিয়ে রান্নার ব্যবস্থা করতে হলো। তাই মাছ, ডাল, ভাত এ কয়টি পদের রান্নায় বেশ সময় লেগে গেলো।

আমি আর পারছি না, চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। তাই বিছানায় শরীরকে ছেড়ে দিলাম। হঠাৎ ঘুমও চলে আসলো আবার অল্প সময়ে ভেঙেও গেলো। তখন বাজে বিকেল সাড়ে ৩টা। উঠে দেখি দেলু ভাই টমেটো দিয়ে মাছের ভুনা করেছেন। রান্নার রং দেখেই বুঝে গেছি কেমন স্বাদ হবে।

জিভে কিছুটা পানিও চলে এলো। চুলায় তাকিয়ে দেখি ঘন ডালের ধোঁয়া উড়ছে। এমন লোভনীয় খাবার দেখে আমার পেটের ক্ষুদাও যেন তীব্র হতে লাগলো। দেলু ভাই যে মজার রান্না করতে পারেন তা আমি মহসীন ভাইয়ের ভিডিও থেকে দেখেছি।

কিন্তু নিজের চোখে দেখাটাও অন্যরকম আনন্দ। আমি তো সঙ্গে সঙ্গে কামরুল ভাইকে ঘুম থেকে তুলে রান্নার বিস্তারিত বলতে লাগলাম। দেখলাম সেও খাবারের লোভ সামলাতে না পেরে এক লাফ দিয়েই বিছানা থেকে উঠে গেলেন।

অবশেষে সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া শুরু করে দিলাম। মাছের তরকারি মুখে দিতেই আহা! কী স্বাদ। মনে হচ্ছে গ্রামের বাড়ি বসে মায়ের হাতের রান্না খাচ্ছি। ডালও খেয়ে দেখি অসাধারণ স্বাদ।

রান্নার হাতেখড়ি জানতে চাইলে দেলু ভাই জানালেন তিনি কখনো রান্না করতেন না। বছর দুই আগে সাংবাদিক মহসীন ভাই জোর করায় তিনি আজ রান্নায় পারদর্শী হয়েছেন।

আজ আবার ১৬ ডিসেম্বর। এদিনে বিজয় পায় লাল সবুজের পতাকা। নতুন করে জন্ম নেয় সোনার বাংলাদেশ। তাই দিনটি উদযাপন করতে ভুলেননি দুবার বাসিন্দারাও। প্রতিটি মাছ ধরার ট্রলার, দোকান ও থাকার ঘরেও ওড়ানো হয় দেশের জাতীয় পতাকা।

এ উপলক্ষ্যে বিকেলে আলোচনা ও ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শপথ অনুষ্ঠান দেখানোর আয়োজন করা হয়। খাওয়ার পর্ব শেষ করতে বাজলো বিকেলে সাড়ে ৪টা।

পশ্চিম দিকে হেলে পড়া রক্তিম সূর্যের ডুবে যাওয়ার সময় হয়েছে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার পালা। তাই দেরি না করে কামরুল ভাই আর দেলু ভাইসহ বেরিয়ে পড়লাম সেই নিউ মার্কেটের উদেশ্যে।

কিন্তু আমরা দেরি করে ফেলায় বিজয়ের অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ পেলাম না। পরে আয়োজক দুবলার চরের কামাল ও খোকন সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। বিজয় উদযাপনের আয়োজন ও জেলেদের জন্য তাদের পদক্ষেপ সম্পর্কে প্রায় ঘণ্টা দেড় আলাপ হয়।

সুন্দরবনে টেলিটক ছাড়া কোনো সিমের নেওয়ার্ক পাওয়া যায় না। তাই আলাপ শেষে আমাদের দুজনের জন্য বাজার থেকে একটা সিম কিনলাম। সিম কিনে পরিবারের সঙ্গে আলাপ সেরে নিলাম। রুহুল ভাই, দেলু ভাই, কামরুল ভাই ও আমি মিলে মার্কেটের এ মাথা থেকে ওই মাথা ঘুরে দেখলাম।

সেখানকার বসবাসকারী জেলে ও দোকানদারদের সঙ্গে আলাপও হতে থাকলো। আলাপের সঙ্গে চা চলছে একের পর এক, তাদের ওইখানে রং চায়ের লিকারটা বেশ কড়া, খেতেও দারুণ।

সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় চলে গেলাম দেব চাচার বাসায়। সেখানেও বিভিন্ন মানুষের জীবন কাহিনি শুনতে লাগলাম। সেই আড্ডায়ও বাদ পড়েনি চা। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রাত সাড়ে ৮টার দিকে আবার নিউ মার্কেটে গিয়ে প্রসেনজিৎ নামে এক দাদার দোকানে গিয়ে বসলাম। তিনি কফি বানাতে পারেন বেশ। কিন্তু এতো রাতে কফি শেষ হয়ে যাওয়ায় আবারও চললো রং চা।

যত রাত হচ্ছিল, তত ঠাণ্ডা অনুভব হচ্ছিল। রাত ৯টায় চলে এলাম ঘরে। পথে দেখলাম জেলেরা ট্রলারে মাছ নিয়ে ফিরছেন। এনেই মাচায় ঢেলে দিচ্ছেন। কিছু শ্রমিক সে মাছ সাজিয়ে দিচ্ছে। আর জেলেরা মাছ রেখেই আবার ট্রলারে চলে যাচ্ছে।

ঘরে ফিরেই দেলু ভাই রাতের খাবার প্রস্তুত করছেন। এ ফাঁকে আমি আর কামরুল ঘরের পাশেই বয়ে যাওয়া খালে জোয়ারের পানি দেখতে পেলাম। সেখানে কামরুল আর আমি চাঁদের মিটমিট আলোয় জোয়ারের গর্জন শুনতে লাগলাম।

সঙ্গে চরে মাছ নিয়ে আসতে থাকা ট্রলারের আওয়াজ। সন্ধ্যা নামতেই জোয়ার আসে। আর সে জোয়ারেই মাছের ট্রলার আসতে শুরু করে। আবার ভাটার আগেই গভীর সাগরে পাড়ি জমান জেলেরা।

এদিকে বেজে গেলো রাত সাড়ে ১০টা। ঘরে ফিরে ডিম ভাজি আর ডাল দিয়ে মেরে দিলাম রাতের খাবার। দুজনেরই চোখ যেন নীভু নীভু হয়ে আসলো। কামরুল তো আগেই চিৎপটাং হয়ে শুয়ে গেলো।

আমি দেলু ভাই নয়ন নামে আরেক ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করতে থাকলাম। সে কত গল্প, শুনতে শুনতে আরো দুই ঘণ্টা পার। সকালে উঠে সূর্যদোয় দেখবো বলে আমিও শুয়ে পড়লাম, এদিকে কামরুলের তো অর্ধেক ঘুম হয়েও গেছে।

চলবে...

জেএমএস/জিকেএস