ভ্রমণ

নিয়ে এলাম রাঙ্গামাটির রঙিন স্মৃতি

সাহেদুজ্জামান সাকিব

Advertisement

ভ্রমণটি হওয়ার কথা ছিল মার্চের ২৮ তারিখ। কিন্তু করোনার কারণে কারো সাহস হয়নি। দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকায় ভুলে গিয়েছিলাম ভ্রমণের কথা। ভ্রমণের সপ্তাহখানেক আগে এক বড়ভাই ফোন দিয়ে জানালেন বান্দরবান ভ্রমণের কথা। দু’দিন পর নিশ্চিত করলাম, আমিও যাচ্ছি বান্দরবান ট্যুরে।

২১ নভেম্বর রাতে ভ্রমণের তারিখ ঠিক করা হয়। শ্যামলী শিশুমেলার সামনে থেকে রাত ১০টায় বাস ছাড়বে। আমার সাথে বন্ধু রাব্বি হাসান। ব্যাগ-প্যাক নিয়ে রাত ৮টার দিকে শ্যামলীর দিকে রওনা দিলাম। ৯টার মধ্যেই আমরা হাজির। রাত ১০টায় বাস ছাড়লো।

বাসে উঠে রাব্বিসহ কয়েকটি সেলফি তুলে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলাম। মাঝরাতে রাব্বির ডাকে ঘুম ভাঙলো। দেখি, বাস কুমিল্লায় এসে দাঁড়িয়েছে। ফ্রেশ হয়ে দু’জন হালকা নাস্তা করে নিলাম। খানিক পরে বাস আবার চলতে শুরু করলো।

Advertisement

গন্তব্য বান্দরবান। হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে আবারও ঘুমিয়ে পড়লাম। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে বাস ছুটে চলেছে আপন গতিতে। আবারও রাব্বির ডাকে ঘুম ভাঙলো। ঘড়িতে তখন কাটায় কাটায় ছয়টা বাজে। এবার ঘুম থেকে উঠে যা দেখলাম, তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না! থতমত খেয়ে গেলাম!

আমাদের যাওয়ার কথা বান্দরবান। কিন্তু বাস এসে দাঁড়িয়েছে রিজার্ভ বাজার, রাঙ্গামাটি! ভাবলাম, কোথাও কোনো ভুল হলো কি না! কিন্তু না, কোনো ভুল হয়নি। এক বড়ভাই নিশ্চিত করলেন, আমরা ঠিক জায়গায়ই এসেছি। আমাদের বান্দরবান ট্যুর পরিবর্তন করে রাঙ্গামাটি করা হয়েছে। আমি মনে মনে কিছুটা হতাশ হলাম!

গাড়ি থেকে নেমে সবাই হোটেলের দিকে গেলাম। হোটেলে আগেই রুম বরাদ্দ ছিল। হোটেলে ফ্রেশ হয়ে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নিলাম। সাড়ে সাতটার দিকে সবাই বের হলাম। রিজার্ভ বাজার থেকে রাঙ্গামাটি পুলিশ সুপারের বাসভবন পেরিয়ে লঞ্চ ঘাটের দিকে গেলাম। সেখানে একটি বড়সড় দোতলা বোট ভাড়া করে রাখা হয়েছে। বোটে দাঁড়িয়ে কুয়াশা ঘেরা রাঙ্গামাটির দৃশ্য দেখে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না।

রাব্বির ছবি তোলার হাত ভালো। আমরা ঝটপট কয়েকটি ছবি তুলে বোটের ভেতরে গিয়ে বসলাম। বাইরের দৃশ্য দেখার জন্য জানালার পাশের সিট আগেভাগেই দখল করে নিলাম। বোট ছেড়ে দেওয়ার খানিক পরেই কর্তৃপক্ষ নাস্তা দিয়ে গেল। তিনটি পরোটা আর ডালভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা করলাম।

Advertisement

পাহাড়ের পাদদেশে কাপ্তাই লেক। লেকের উপর দিয়ে চলেছে বোট। লেকের নীল জল আর পাহাড়ে ঘেরা নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে সৃষ্টিকর্তার কথা মনে হলো। বোটটি ধীরে ধীরে চলছিল। মাঝেমাঝে পাশ দিয়ে সাঁইসাঁই করে কিছু স্পিডবোট যাচ্ছিলো। দ্রুতগতির এ নৌযান লেকের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে।

এবারের গন্তব্য সুবলং ঝরনা। ঝরনায় যাওয়ার আগে বোট গিয়ে চেকপোস্টে দাঁড়ালো। প্রয়োজনীয় চেকিং সেরে চলতে শুরু করলো ঝরনার দিকে। খানিক পরেই পৌঁছলাম। চারিদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে জলপ্রপাত। দুই-তিন ভাগ হয়ে পানি পড়ছে, কোনো ভাগে বেশি আর কোনো ভাগে কম। পানির গতিও কখনো বেশি কখনো কম।

ঝরনার কাছে যেতে কিছু কাঁদা-পানি পেরোতে হয়। আস্তে আস্তে খুব সাবধানে পাহাড় বেয়ে ঝরনার পানি ছুঁতে হয়। ইচ্ছে করছিল পানিতে গোসল করি। কিন্তু ঝরনার পানি পাহাড়ের গা বেয়ে নামায় গোসল করার মতো অবস্থা ছিল না। যদিও তাতেই কেউ কেউ গা ভিজিয়ে উপভোগ করার চেষ্টা করছিল। সুবলং ঝরনায় একঘণ্টার মতো কাটিয়ে গোটা বিশেক ছবি তুলে বোটে গিয়ে উঠলাম।

সুবলং ঝরনা থেকে বোট আবার চলতে লাগলো চেকপোস্টের দিকে। এবারের উদ্দেশ্য চেকপোস্ট সংলগ্ন বারকল উপজেলা ঘুরে দেখা। বারকল উপজেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিস হচ্ছে সুউচ্চ পাহাড়। পাহাড়ে ওঠার জন্য এখানে সিঁড়ি আছে। চেকপোস্ট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কয়েকজন জোয়ান পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য উৎসাহিত করলো। আমরাও আগ্রহ নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম। উঠতে উঠতে কতবার যে হাঁপিয়ে গেছি, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

প্রায় আধাঘণ্টা সিঁড়ি বেয়ে ওঠার পর পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম। চূড়ায় উঠে যা দেখলাম; তা জীবনেও ভোলার মতো নয়। সেখানে কী কী দেখেছি, তা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজনবোধ করলাম না। আপনারা নিজের চোখেই দেখে আসবেন। পাহাড়ে ওঠার চেয়ে নামা একটু বেশিই কষ্টের। পেটে ক্ষুধা নিয়ে পাহাড় থেকে নামা ‘মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ’ হয়ে দাঁড়ালো।

পাহাড় থেকে নেমে পাহাড়িদের জীবনাচরণ দেখতে আমরা বাজারের দিকে গেলাম। বাজারে পাহাড়ি নারীরা বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। পাহাড়ি ডাব, পাহাড়ি কলা, পাহাড়ি শুকনো বরইসহ নানা ফল-মূল বিক্রি করছেন তারা। কেউ বা বসেছেন নানা রকম হস্তশিল্প নিয়ে। আমি আর রাব্বি দুটো ডাব নিয়ে ডাবের পানিতে তৃষ্ণা মেটালাম। বারকল উপজেলা ঘুরে আবার বোটে ফিরে এলাম।

১২টার দিকে বোট চলতে শুরু করলো পলওয়েল পার্কের দিকে। রাঙ্গামাটি জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে কাপ্তাই লেকের কোলঘেঁষে তৈরি হয়েছে পলওয়েল পার্ক। বৈচিত্রময় ল্যান্ডস্কেপ, অভিনব নির্মাণশৈলী এবং নান্দনিক বসার স্থান পার্কটিকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। পার্কে নেমে একে একে ঘুরে দেখলাম ভুতুড়ে পাহাড়ের গুহা, কৃত্রিম ঝরনা, কলসি ঝরনা, ক্রোকোডাইল ব্রিজ, ঢেঁকি শিল্প, লেকভিউ পয়েন্ট, হিলভিউ পয়েন্ট, লাভ লক পয়েন্ট, মিনি চিড়িয়াখানা, অ্যাকুরিয়াম, ফিশিং পিয়ার, ক্যাফেটেরিয়া, সুইমিংপুল এবং কটেজ।

পার্ক ঘোরা শেষে রওনা হলাম ঝুলন্ত ব্রিজের দিকে। ঝুলন্ত ব্রিজে নামার আগে বোটেই দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। রুই মাছ, চিংড়ি ভর্তা, সবজি আর ডাল দিয়ে তৃপ্তিসহ খেলাম। খাওয়া শেষ করেই ব্রিজ দেখতে নামলাম। কাপ্তাই হ্রদের উপর নির্মিত ৩৩৫ ফুট লম্বা এ ঝুলন্ত ব্রিজ। লেকের দুই পাড়ের পাহাড়ের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে দিয়েছে এ সেতু।

সেতুটি পারাপারের সময় সৃষ্ট কাঁপুনি ভিন্ন দ্যোতনা এনে দিলো। সেতু পার হয়ে পাহাড়ের উপরে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ক্ষয়িষ্ণু জীবনযাপন দেখতে গেলাম। আদিবাসীরা তাদের হাতে তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্প, আচার, শাল, চাদর, চকলেট বিক্রি করছিল। আমরা পছন্দমতো কিছু জিনিসপত্র কিনলাম।

৪টার দিকে রাজবন বিহারের দিকে রওনা হলাম। মূল শহরের অভ্যন্তরে রাজবন বিহার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। বোট থেকে নেমে রাজবন বিহারে ঢুকতেই হাতের বাঁ পাশে চোখে পড়লো এক স্বর্গীয় সিঁড়ি। অনুমতি নিয়ে যে কেউ এখানে উঠতে পারে। আছে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধ্যানের বিশাল গর্ত। আছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন মূর্তি।

এখানকার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জিনিস হচ্ছে, বৌদ্ধ ধর্মগুরু সাধনানন্দ মহাস্থবিরের (বনভন্তে) মৃতদেহ। যা ভক্তদের দেখার জন্য এখানে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। সময় স্বল্পতার কারণে আমাদের রাজবন বিহার ত্যাগ করতে হলো। রাজবন বিহার থেকে বোটে চড়ে সোজা লঞ্চ ঘাটে চলে এলাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে।

শেষবারের মতো বোট থেকে নেমে ফিরে এলাম হোটেলে। ফ্রেশ হয়ে পাহাড়ি পেঁপে, কলা ও আপেল দিয়ে নাস্তা করলাম। এবার আমাদের ফেরার পালা। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বাসে গিয়ে উঠলাম। ঠিক আটটায় বাস ছাড়লো। রাঙ্গামাটি রিজার্ভ বাজার থেকে চট্টগ্রাম-কুমিল্লা হয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম। সাথে নিয়ে এলাম রাঙ্গামাটির রঙিন স্মৃতি।

লেখক: শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী।

এসইউ/জেআইএম