ভ্রমণ

কক্সবাজারে ৪ দিনের আনন্দ বিলাস

মো. রাকিবুল হাসান

Advertisement

১২ অক্টোবর রাত ৮টা। সমুদ্রের খোঁজে চলতে শুরু করি ১০ চাকার ইঞ্জিন নিয়ে। একটি চাকা বিকল হয়ে যাওয়ায় বাহনটি পরিবর্তন করতে হলো। সকাল ৯টায় পৌঁছে যাই জলের রাজ্য কক্সবাজারে। ১৬ জোড়া ঘুমমাখা চোখ তখন ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত ও উল্লাসী।

চারিদিকে মৃদু বাতাস বইছে, আবার প্রখর রোদ। ছায়া নেই কোথাও! ১০ মিনিট পর একটি অটো নিয়ে যাই ঠিক করে রাখা হোটেলে। রুম পেতে একটু সময় লাগে। সকালের খাবারটা সেরে নেই। তারপর রুমে গিয়ে বিশ্রাম করি। বিশ্রামের মাঝেও চলে আড্ডা ও খেলা। বেশি দেরি না করে হোটেল থেকে বের হই জলের রাজ্যে গা ঘেঁষতে। পথে দুপুরের আহার করে নেই। কোমলপানীয় খেতে খেতে দেখা পেয়ে গেলাম নীল সমুদ্রের।

আজ শরীর ভেজাবো না ঠিক করে নিলাম। এখনো দু’জন এসে পৌঁছাননি। কিছুটা টেনশন কাজ করছিল। সন্ধ্যার মধ্যে এসে যাবে মুঠোফোনে জানিয়ে দিলেন। জল গড়িয়ে পায়ে লাগতেই শুরু হয়ে যায় খুনসুটি ও আনন্দ উল্লাস। অগ্রজ অনিকের দিক-নির্দেশনায় ‘চান্দের বাত্তি’ গানের সাথে নেচে জানান দেই সমুদ্রের বুকে পা রেখেছে গণ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি (গবিসাস)। ভিজবো না ঠিক করা থাকলেও আমাকে ও সভাপতি রনি জ্যেষ্ঠকে কাকভেজা করে দিলো চিত্রগ্রাহক টুটুল অগ্রজ।

Advertisement

দুপুর থেকে কখন যে বেলা বিদায় নিলো, বুঝতেই পারলাম না। সূর্যাস্ত দেখে হোটেলের দিকে হাঁটতে শুরু করি। হোটেলে গিয়ে কাপড় পাল্টে নেই। এর মধ্যেই বাকি দু’জন হাজির। রাতে আড্ডা বেড়ে যাবে, যখন শুনলাম গবিসাস উপদেষ্টা মিলন কাউছার অগ্রজ ও উপদেষ্টা মো. ওমর ফারুক জ্যেষ্ঠ আসছেন এবং আমদের সাথেই থাকবেন।

তখন ঘড়িতে ১১টা ৩০ হবে। রাতে খেয়ে নিলাম। চাঁদের আলোয় সমুদ্র দেখবো। হাতে একটি বক্স ছিল। বক্সে কী? অপেক্ষা করেন আগে সমুদ্রে পৌঁছাই। রাতে সমুদ্রের গর্জন, জলের শো শো শব্দ সবার মনকে কেড়ে নিলো। ৫টি সী বেড পেতে বসে গল্প ও পানি-আকাশ দেখা চলল কিছু সময়।

সময় ১২টা ছুঁইছুঁই। বক্সে কী আছে এখন বলবো। আজ সভাপতির প্রিয় মানুষটির জন্মদিন। কেক আনা হয়েছে, ঠিক ১২টায় ফেসবুক লাইভে গিয়ে কেকে চাকু চালিয়ে তাকে শুভেচ্ছা বার্তা জানিয়ে দেই আমরা। এরপর শুরু হয় গানের পর্ব। এলোমেলো কণ্ঠে গাওয়া হয় পুরোনো দিনের বেশ কয়েকটি গান। সামনের দিকে কয়েক কদম হেঁটে সমুদ্রে পা ভিজিয়ে প্রথম দিনের ইতি টানি।

দ্বিতীয় দিনের সকালে আমরা রওনা দেই মহেশখালীর পথে। সমুদ্রের ধারঘেঁষে নদী। একপাশে উত্তাল ঢেউ, অন্য পাশে নীরব জল। এ নদী দিয়ে ২০ মিনিটে মহেশখালীর দ্বীপে পোঁছে যাই। দু’পাশে বড় বড় গাছ, মাঝে সরু রাস্তা মহেশখালীর সৌন্দর্য জানান দেয়। হেঁটে চলে গেলাম পাহাড়ের বুক খোদাই করে বানানো পুরোনো এক মন্দিরে।

Advertisement

দুপুরে অটো নিয়ে অদ্ভুত এক জায়গায় পৌঁছে যাই আমরা। সারি সারি আঠা গাছ, ঠিক যেন সিলেটের কোনো বাগানে ঢুকে পড়েছি। আরেকটু এগোলে সাগর, কিন্তু অনেকখানি গিয়েও পানি নেই। কাদামাটি ও শাল, ঝাউ গাছে ভরপুর। প্রথম দেখায় কেউ সুন্দরবন বলতে ভুল করবে না! এ পথে হেঁটে জলের দেখা পাওয়া যাবে না, এক মধ্যবয়সী জেলে বললেন। উত্তর দিকে সাগরের পানি দেখা যাচ্ছে, হাঁটতে শুরু করি। কিন্তু অনেকখানি আগানোর পরও পথ কমে না। দেখা যাচ্ছে কিন্তু যাওয়া যাচ্ছে না।

আমরা যখন এসেছি; তখন ভাটা চলছে। এ কারণেই এ রূপ দেখতে পেয়েছি। জোয়ারের পানিতে ভরে যায়, এতো ভেতরে আসা যায় না। মহেশখালীর ঘাটে ফিরে যাই। ফিরবো ট্রলারে, ১ ঘণ্টা লাগবে। সূর্য ও জলের খেলা দেখতে দেখতে কক্সবাজারে পৌঁছে যাই। নদীর এক কোণ দিয়ে সমুদ্র দেখা যায়, পানির রং গাঢ় নীল। এ পানিতে লাল সূর্য টুপ করে মিলিয়ে গেল।

আমরা আজ দুপুরে খেতে পারিনি। খাওয়ার সুযোগ পাইনি, এজন্য খেয়েই হোটেলে ঢুকলাম। হোটেলের আশপাশ ঘুরতে ঘুরতে সমুদ্রের তীরে চলে যাই। সেখানেই গবিসাস সদস্য সজল ও ধীরার জন্মদিনের কেক কেটে শেষ করি দ্বিতীয় দিন।

৩য় দিনে সাগরকন্যার বুকে হারিয়ে যাই। জলে গা ভেজানোর আগে চললো ফটোসেশন পর্ব। সবার পরনে একই রকম টি-শার্ট, চোখে বাহারি রঙের সানগ্লাস। এবার জলরাশির মিতালীতে ডুব দেওয়ার পালা। সাংগঠনিক সম্পাদকের শরীর খারাপ করেছে, গা গরম। তিনি জলে নামবেন না। তাই তার কাছে ফোন, টাওয়াল, কাপড় রেখে আমরা দলে দলে সমুদ্রে নেমে পড়ি।

নোনা জল, ছোট-বড় ঢেউ, নীল আকাশের মাঝে লাফালাফি, দৌড়াদোড়ি করি প্রায় ঘণ্টাখানেকের বেশি। ভেজা শরীর নিয়ে উত্তপ্ত বালি পাড়ি দিয়ে অগ্রজ অনিককে নিয়ে হোটেলে ফিরে আসি। এ সময় একটা ডাব খেয়ে অনেকটা প্রশান্তি পেলাম।

সমুদ্রে গোসল করায় সবাই অনেকটা ক্লান্ত হয়ে গেছে। তাই দুপুরে ভরা পেট খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুম। এরপর ২-৪ জন গ্রুপ করে করে লাবনী, সুগন্ধা পয়েন্টে চলে ঘোরাঘুরি, আড্ডা ও শখের কেনাকাটা। বিদায়ের ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। কাল দিন ঘুরে রাতে রওনা দিবো ঢাকার পথে।

৪র্থ দিনের সকাল ছিল চনমনে। সাগরের আরেক রূপ দেখা যায় ইনানী বিচে। আজকের পথচলা শৈবাল-প্রবালের ঠিকানায়। মিল্কিওয়ে হোটেল থেকে দেড় ঘণ্টার রাস্তা। বেলা ১টা, তখন ইনানী বিচে আমরা। ঝাল, তেঁতুল, দুধ দিয়ে বানানো হচ্ছে অসাধারণ আইসক্রিম। ভেজা বালি, শৈবাল-প্রবাল, সাগরের ঢেউ, দূরে উঁচু উঁচু পাহাড় এবং সারি সারি গাছের মেলা। ইনানীতে আমরা প্রায় দেড় ঘণ্টা ছিলাম। পুরো সময়কে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করেছি।

এখানে লাল টি-শার্ট গায়ে কালো ক্যামেরা হাতে নানা বয়সী ছেলে আছে। তারা আপনার ছবি তুলে দেবে। এ বিচে আপনি ছবি তুলতে পারেন। কিন্তু একটু সচেতন না হলে ছবি তুলে বেশ খানিকটা টাকা চলে যেতে পারে।

এখান থেকে বের হয়ে আবার উল্টা পথে চলতে শুরু করি। যাবো হিমছড়ি, কিন্তু সেদিন শুক্রবার ও করোনার কারণে মূল ফটক বন্ধ ছিল। আরেকটি বিচে মিনিট বিশেক দাঁড়ালাম। একপাশে বিশাল লাল মাটির পাহাড়, অন্যপাশে আকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্র। এখানে প্যারাসুট দিয়ে সাগরে ভেসে থাকার সুযোগও আছে। ১ কিলোমিটার এগোলে একটি ঝরনা। উঁচু পাহাড়ের বুক চিড়ে টুপটুপ করে পরিষ্কার পানি পড়ছে।

বিদায় বেলা ক্রমশ ঘনিয়ে আসছে। আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। দুপুরে আহার সেরে নেই। প্রায় বিকেল। সন্ধ্যায় ফেরার টিকিট কাটা হয়ে গেছে। আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। সবাই হোটেল থেকে বের হয়ে সুগন্ধা পয়েন্টে গেলাম। নিজেদের মতো কেনাকাটা শেষ করি। সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিট তখন। আমাদের বাস ৮টায়। শেষমুহূর্তে একটি সেলফি তুলে কক্সবাজারকে এবারের মতো টা-টা বলে বাসে উঠে বসলাম।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমকেএইচ