কৃষি ও প্রকৃতি

বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে আগ্রহী বেকাররা

নওগাঁর রানীনগরে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন যুবক সামিউল আলম তুষার। পড়াশোনার পাশাপাশি বায়োফ্লকের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন বাড়ির উঠানে মাছ চাষ করছেন। তাকে উৎসাহ দিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করেন বাবা মাহাবুব আলম। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে সামিউল আলম তুষার জেলার দ্বিতীয় এবং উপজেলার একমাত্র ব্যক্তি। তার দেখাদেখি উদ্বৃদ্ধ হয়ে এলাকার শিক্ষিত বেকাররা বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চাকরির পেছনে না ছুটে স্বাবলম্বী হয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এমন প্রত্যাশা তাদের।

Advertisement

জেলার রানীনগর উপজেলার কাশিমপুর ইউনিয়নের প্রত্যান্ত গ্রাম কুজাইল খান পাড়া। এ গ্রামের তরুণ উদ্যমী যুবক সামিউল আলম তুষার। তিনি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নওগাঁ সরকারি কলেজে ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছেন। পড়াশোনার পাশাপাশি বাড়ির উঠানে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষ করছেন।

গত বছরের ১৯ ডিসেম্বরে জেলা মৎস্য অফিসে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষের ওপর তিনদিনের প্রশিক্ষণ নেন সামিউল। প্রশিক্ষণকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি থেকে কার্যক্রম শুরু করেন। বাড়ির উঠানে সামান্য জায়গায় ইট, বালি ও সিমেন্ট দিয়ে ১০ হাজার লিটার পানি ধারণ ক্ষমতার দুটি হাউজ (ট্যাংকি) তৈরি করা হয়। এরপর নিরাপত্তার জন্য টিনের বেড়া ও ছাউনি দেয়া হয়। হাউজে সূর্যের আলো পড়তে ছাউনিতে লাগানো হয়েছে স্বচ্ছ টিন। হাউজে পানি সরবরাহের জন্য স্থাপন করা হয়েছে সাবমাসিবল পাম্প। এছাড়া হাউজে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য দুটি মোটর এবং বিদ্যুৎ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে জেনারেটর রাখা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে তার খরচ পড়েছে প্রায় ২ লাখ টাকার মতো। সামিউলকে এ কাজে অর্থের জোগান দিয়েছেন তারা বাবা মাহাবুব আলম। সবকিছু প্রস্তুত করার পর গত ২৫ মার্চ থেকে মাছ চাষ শুরু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তিনি ১৪০ টাকা কেজি হিসেবে ৫০ কেজি মাছ বিক্রি করেছেন।

এতে একদিকে যেমন দেশি মাছের চাহিদা পূরণ হচ্ছে অন্যদিকে আমিষের জোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে। প্রতি বছর পুকুর খনন করতে গিয়ে যেমন কৃষিজমির পরিমাণ কমছে। এ পদ্ধতিতে চাষ করতে গিয়ে যেমন নতুন করে পুকুর খননের প্রয়োজন হবে না। তেমনি খাল-বিল কিংবা নদী-নালারও প্রয়োজন হয় না। বাড়ির উঠানে স্বল্প জায়গায় ও অল্প পুঁজিতে এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ করা সম্ভব।

Advertisement

উদ্যোক্তা সামিউল আলম wতুষার বলেন, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে তিনদিনের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ নিই। তারপর ইউটিউবসহ বিভিন্ন বই পড়ে আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। এরপর সাবেক এক মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিকল্পনা মোতাবেক হাউজগুলো তৈরি করা হয়। এ কাজে অর্থের যোগান দিয়েছেন বাবা। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার একটি হ্যাচারি থেকে সাড়ে ছয় হাজার পিস শিং মাছের রেনু সংগ্রহ করে একটি হাউজে পরিষ্কার পানিতে ছাড়া যায়। রেনু ছাড়ার ৭দিনের মধ্যে পানি জীবাণুমুক্ত এবং ‘প্রবায়োটিক’ এর মাধ্যমে পানি তৈরি করা হয়। এরপর নিয়মিত ফিড খাবার এবং পানির গুণগতমান পরীক্ষা করা হয়।

তিনি বলেন, রেনু ছাড়ার প্রায় দুইমাস পর দেড় হাজার পিস মাছ মারা যায়। পানির অ্যামোনিয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে চিটাগুড় ব্যবহার করা হয়েছিল তা খারাপ ছিল। খারাপ চিটাগুড়ের কারণে পানি নষ্ট হয়ে যায়। পরে আবার নতুন করে পানি তৈরি করা হয়। এক মাস আগে ৫০ কেজি (কেজিতে ১৫/২০ পিস) মাছ ১৪০ টাকা দরে বিক্রি করেছি। করোনাভাইরাসের কারণে মাছের দাম পাওয়া যায়নি। তবে লাভ না হলেও লোকসান হয়নি। আশা করছি হাউজে এখনো যে পরিমাণ মাছ আছে মোটামুটি একটা লাভ থাকবে।

সামিউল আলম তুষার বলেন, যাদের পক্ষে পুকুর ইজারা নেয়া সম্ভব না। তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্ত হয়ে অল্প পুঁজিতে স্বল্প জায়গায় মাছ চাষ করতে পারেন। দশ কাঠা পরিমাণ জলাশয়ে যে পরিমাণ মাছ চাষ করা যাবে, তার একটি হাউজে সেই পরিমাণ মাছ চাষ করা সম্ভব। হাউজে মাছ চাষে খাবারের খরচটা কম লাগে। আমাগীতে তার বায়োফ্লকে আরো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করবেন। তবে সরকার যদি বেকার দুরীকরণে জামানতবিহীন ঋণের ব্যবস্থা করে তাহলে অনেক সুবিধা হবে। চাকুরির পিছনে না ছুটে উদ্যোক্ত হয়ে মাছ চাষ করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

একই গ্রামের যুবক চন্দন কুমার সরকার বলেন, তাদের এলাকায় এক বিঘা পরিমাণ জলাশয় এক বছরের জন্য ইজারা নিতে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হবে। তিন বছরের জন্য গুণতে হবে ৩ লাখ টাকা। এছাড়া রয়েছে খাবার খরচ। আর বায়োফ্লক হচ্ছে একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া যা বাড়িতেই করা সম্ভব। সামিউলের দেখে নিজেও একটি হাউজ তৈরি করেছি। মৎস্য অফিস থেকে পরামর্শ নিয়েছি। তবে আমাদের মতো শিক্ষিত বেকারদের জন্য সরকারের পৃষ্টপোষকতা প্রয়োজন।

Advertisement

নওগাঁ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফিরোজ আহমেদ বলেন, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে অল্প জায়গায় মাছ চাষ করা সম্ভব। ইতোপূর্বে ১৫০জনকে দুইটি গ্রুপে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এ পদ্ধতিতে মাছ চাষে অনেকে উদ্বৃদ্ধ হচ্ছে। বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছে দেখে অনেকে একবারে ঝাঁপিয়ে না পড়ার জন্য অনুরোধ রইল। বিষয়টি ভালোভাবে জেনে বুঝে ও অভিজ্ঞদের কাছ থেকে এবং মৎস্য অফিসের পরামর্শ নিয়ে শুরু করতে হবে। অন্যথায় লোকসানে পড়তে হবে এবং অন্যরা হতাশ হয়ে পড়বে। বিষয়টি জানার পরই যেন কেউ শুরু করে এটাই পরামর্শ থাকবে।

আব্বাস আলী/মিজান/এসইউ/এএ/এমএস