আন্তর্জাতিক

মুঠো মুঠো সোনা, প্ল্যাটিনাম ছড়িয়ে পড়ছে মহাকাশে! (ভিডিও)

সোনা কিংবা প্ল্যাটিনামের দাম বলা যায় আকাশছোঁয়া। এক ভরি হাতে পেলেই চকচক করে ওঠে আমাদের চোখ-মুখ। অথচ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে কাড়ি কাড়ি সোনা, প্ল্যাটিনাম! আর এসব ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। প্রতি বছরই তা নতুন নতুন করে তৈরি হচ্ছে। সূর্য যতটা ভারী, তার ২০ গুণ ওজনের সোনা ও প্ল্যাটিনামের মহাতাল বছরে অন্তত একটা করে তৈরি হচ্ছে।

Advertisement

কোথায় থেকে আসছে সেই তাল তাল সোনা, প্ল্যাটিনাম? কীভাবে তা তৈরি হচ্ছে প্রত্যেক বছর? ব্রহ্মাণ্ডের সেই বিপুল সোনার জন্ম কোথায়? সেই সোনা, প্ল্যাটিনাম থরে থরে জমছে কোথায়? তা কি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নাকি সেই সব মহামূল্যবান মৌল কয়েকশ কোটি বছর ধরে অবিকৃত, অটুটই থেকে গিয়েছে এই ব্রহ্মাণ্ডে?

প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে খোঁজ-তল্লাশের পর এই প্রথম উত্তর মিলল এসব প্রশ্নের। প্রথমবারের মতো হদিশ মিলল, যেখানে তৈরি হচ্ছে সোনা ও প্ল্যাটিনামের মহা মহাতাল। গবেষণাগারে কম্পিউটার সিম্যুলেশনের মাধ্যমে সাড়াজাগানো গবেষণাপত্রটি গত মাসে বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’-এ। গবেষকদলে রয়েছেন দুই খ্যাতনামা জ্যোতির্বিজ্ঞানী কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও কলম্বিয়া অ্যাস্ট্রোফিজিক্স ল্যাবরেটরির অধ্যাপক ব্রায়ান মেৎঝার ও ড্যানিয়েল এম সিগেল ও বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেনিফার বার্নস।

বছরে কতটা সোনার তাল তৈরি হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ডে?

Advertisement

আমাদের সূর্যের ভর কতটা জানেন? দুই-কে (আসলে ১.৯৮৯১) এক-এর পেছনে ৩০টি শূন্য দিয়ে গুণ করলে যে প্রকাণ্ড সংখ্যা পাওয়া যায়, ঠিক তত কিলোগ্রাম। এই সুবিশাল সংখ্যাকে ২০ দিয়ে গুণ করলে যা হয়, বছরে তত কিলোগ্রাম ওজনের অন্তত একটা করে সোনা ও প্ল্যাটিনামের মহাতাল তৈরি হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ডে!

কত সোনা, প্ল্যাটিনাম রয়েছে পৃথিবীতে?

পৃথিবীর সোনা, প্ল্যাটিনাম নিয়ে গর্ব আমাদের। কিন্তু ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের দেয়া তথ্য জানাচ্ছে, উত্তোলন শুরুর পর থেকে ২০১৯ সালের প্রথম ৬ মাস পর্যন্ত বিশ্বে ১ লাখ ৯০ হাজার ৪০ মেট্রিক টন ওজনের সোনা খনি থেকে তোলা হয়েছে।

আর কতটা সোনা মজুত রয়েছে ধরিত্রীর ভাণ্ডারে? ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল বলছে, ভূপৃষ্ঠের এত নিচে নামতে হবে যে ২০৫০ সালের পর খনি থেকে সোনা তুলে আনার কাজটা পৃথিবীতে হয়ে পড়বে খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। ২০৭৫ সালের পর অবস্থা এমন হবে যে খনি থেকে সোনা উত্তোলনের চালু প্রযুক্তি আর কাজেই লাগবে না আমাদের গ্রহে। ওই প্রযুক্তি দিয়ে আর সোনা তোলা যাবে না।

Advertisement

প্ল্যাটিনামের গল্পটা কী? আমেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভের তথ্য বলছে, ২০১১ সাল পর্যন্ত ১৯২ টন ওজনের প্ল্যাটিনাম উত্তোলন করা সম্ভব হয়েছে। এখন যে হারে তোলা হচ্ছে, তাতে আর একশ' বছরেই পৃথিবীর সব প্ল্যাটিনামের ভাণ্ডার শেষ হয়ে যাবে। পৃথিবীর সোনা ও প্ল্যাটিনামের ভাণ্ডার বলতে তো এইটুকুই। যা নিয়ে আমাদের এত গর্ব!

১৩ লাখ পৃথিবী অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে সূর্যের পেটে!

ওজনে পৃথিবীর চেয়ে ৩ লাখ ৩৩ হাজার গুণ ভারী সূর্য। ১৩ লাখ পৃথিবী অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে সূর্যের পেটে। সেই সূর্যের ২০ গুণ ওজনের সোনা, প্ল্যাটিনামের মহাতাল প্রত্যেক বছরে অন্তত একটা করে তৈরি হচ্ছে এই ব্রহ্মাণ্ডে।

নক্ষত্র যখন এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে...

কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সের (আইসিএসপি) কর্মকর্তা বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘সূর্যের ওজনের চেয়ে ৩০ থেকে ৬০ গুণ ভারী কোনো তারা বা নক্ষত্র যখন মরে যেতে শুরু করে তখন প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ হয়। তাকে বলা হয়, ‘সুপারনোভা।’ আবার কখনও মৃত্যুর সময়ে পৌঁছে পুরো একটি তারার ওই বিস্ফোরণ হয় না। কোনো কোনো বিশাল তারা তার নিজের কক্ষপথের চারদিকে লাট্টুর মতো বনবন করে খুব জোরে ঘুরতে ঘুরতে এগিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। সেগুলোকে বলা হয়, ‘কোল্যাপসার্স।’

সেই তারাটির মাথা আর পায়ের দিক তার শরীরের একটি বড় অংশ আলাদা দু’টি ‘জেট’ বা স্রোত হয়ে আগে ছড়িয়ে পড়ে মহাকাশে। এগুলোকে বলা হয়, ‘লং গামা রে বার্স্ট।’ তারাটির পেটের দিকে তৈরি হয় একটি ব্ল্যাকহোল। পেটের দিকে অংশের বাইরের দিকে থাকে লোহা, কোবাল্ট ও নিকেলের মতো মৌল। আর ভেতরে ভরা থাকে নিউট্রনে। সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের বিকিরণের বল এতটাই হয় যে নিউট্রন কণাগুলো আর তখন ভেতরে তৈরি হওয়া ব্ল্যাকহোলের দিকে এগিয়ে না গিয়ে দূরে চলে গিয়ে বাইরে থাকা লোহা, কোবাল্ট ও নিকেলের মতো মৌলগুলোর সঙ্গে জুড়ে গিয়ে সোনা ও প্ল্যাটিনামের মতো ভারী মৌল তৈরি করতে শুরু করে।’

রাক্ষুসে ব্ল্যাকহোলও সব গিলে নিতে পারে না...

সন্দীপ বলেন, অসম্ভব জোরালো নিশ্বাসে (অভিকর্য বল) নাগালে এসে পড়া সব কিছুকেই এক গ্রাসে খেয়ে ফেলতে পারে না ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বর। ‘যা পাই তাই খাই’ স্বভাবের সর্বভূক ব্ল্যাক হোলেরও ‘পেট’ সব কিছু একবারে টেনে নিতে পারে না। ব্ল্যাক হোলের চেটেপুটে খাওয়ারও একটা সীমা রয়েছে। যা প্রথম জানিয়েছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তি বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন।

তার কাছে এসে পড়া বস্তুদের জোরালো বিকিরণের বলই ব্ল্যাক হোলকে সব কিছু চেটেপুটে খেতে দেয় না। বিকিরণের বলই বস্তুগুলোকে নিয়ে যায় ব্ল্যাক হোল থেকে দূরে নিয়ে যায়। না নিয়ে গিলে ওই বস্তুগুলো থেকে সোনা ও প্ল্যাটিনামের মতো ভারী মৌল তৈরি হতে পারত না।

সোনা, প্ল্যাটিনামের জন্মের কারণ কী?

ছোটবেলায় পড়া মেন্দেলিয়েভের পর্যায় সারণী (পিরিয়ডিক টেবিল) মনে করুন। সেখানে হাইড্রোজেন থেকে লোহা (ফেরাম বা আয়রন) পর্যন্ত মৌলগুলো রয়েছে ওপরের দিকে। তার পর যত নিচের দিকে নামবেন, ততই দেখতে পাবেন উত্তরোত্তর ভারী হওয়া মৌলগুলোকে। যেগুলোকে বলে ‘হেভি এলিমেন্টস’। সোনা, প্ল্যাটিনাম সবই হেভি এলিমেন্টস। থাকে পর্যায় সারণীর নিচের দিকে।

কোনো মৌলের পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াসে থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা প্রোটনের সংখ্যা যত বাড়ে, ততই পর্যায় সারণীর বাম থেকে ডান দিক ও ওপর থেকে নিচের দিকে একের পর এক আসতে থাকে উত্তরোত্তর ভারী হয়ে ওঠা মৌলগুলো। সাধারণভাবে কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াসে ধনাত্মক আধানের প্রোটন থাকে যতগুলো, ‘শ্রীনিরপেক্ষ’ নিউট্রনও থাকে ততগুলোই। সেই নিউট্রন সংখ্যার বাড়া-কমা হলেই কোনো পরমাণুর নিউক্লিয়াস হয় ভারী হয়, না হলে হালকা। আর তাতেই তৈরি হয় আইসোটোপ। একই মৌল, তবে তার রং, ঢং আলাদা।

গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবেও পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন ঢুকিয়ে দেয়া যায় প্রচুর পরিমাণে। প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত বলে তার নাম ‘র্যাপিড নিউট্রন ক্যাপচার প্রসেস’ বা ‘আর-প্রসেস’। পরমাণুর পেটে খুব বেশি করে নিউট্রন পুরে দিলে নতুন নতুন আইসোটোপ তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু সেই আইসোটোপ খুব অস্থায়ী হয়। সেগুলো তুলনায় হালকা নতুন কোনো মৌলের পরমাণুতে বদলে যায়।

অর্থাৎ সোনা ও প্ল্যাটিনামের জন্য দরকার হয় পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রচুর নিউট্রন।

এই গবেষণার অভিনবত্ব কোথায়?

গবেষক কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ও কলম্বিয়া অ্যাস্ট্রোফিজিক্স ল্যাবরেটরির অধ্যাপক ড্যানিয়েল এম সিগেল বলেছেন, ‘এতদিন জানা ছিল, প্রায় পুরোটাই নিউট্রনে ভরা বলে নিউট্রন নক্ষত্রদের মধ্যে সংঘর্ষ হলেই (নিউট্রন স্টার মার্জার) ব্রহ্মাণ্ডে সোনা, প্ল্যাটিনামের মতো বহু মূল্যবান মৌলের জন্ম হওয়া সম্ভব। নিউট্রন নক্ষত্রদের একেবারে ওপরের স্তরে ১০ থেকে ১৫ মিটার পুরু লোহার একটি আবরণী থাকে। বাকি অংশটি ভরা থাকে প্রচুর নিউট্রনে। আমরাই প্রথম দেখালাম, আরো একটি উপায়ে সোনা, প্ল্যাটিনামের মতো মূল্যবান মৌলগুলোর জন্ম হচ্ছে ব্রহ্মাণ্ডে। আর তা হচ্ছে অনেক অনেক বেশি পরিমাণে।’

সন্দীপ বলেন, দু’টি নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি হলে যে সোনা ও প্ল্যাটিনামের মতো মূল্যবান ভারী মৌলের জন্ম হয়, এটা অবশ্য তাত্ত্বিক ধারণা ছিল। ২০১৭ সালে যখন দু’টি নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনার জেরে অভিকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভের হদিশ পেলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা, তখন তারা দেখলেন সেই সংঘর্ষের ফলে খুব স্বল্প সময়ের জন্য (যেগুলো ২ বা ৩ সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হয় না) যে গামা রশ্মি বেরিয়ে আসে (শর্ট গামা রে বার্স্ট) সেগুলোতে সোনা, প্ল্যাটিনামের মতো মূল্যবান ভারী মৌলের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলছে।

এই শর্ট গামা রে বার্স্ট প্রায়ই ঘটে ব্রহ্মাণ্ডে। তুলনায় লং গামা রে বার্স্ট সংখ্যায় অনেক কম হয়। কিন্তু সোনা ও প্ল্যাটিনামের মতো ভারী বহুমূল্যবান মৌলের পরিমাণে অনেক বেশি জন্মায় লং গামা রে বার্স্টের বদৌলতে। আর সেটাই প্রথম দেখাল এই গবেষণা।

সন্দীপের কথায়, ‘‘এই গবেষণাই প্রথম দেখাল, সোনা ও প্ল্যাটিনামের মতো মূল্যবান ভারী মৌলের জন্ম হচ্ছে মৃত্যুপথযাত্রী কোনো একটি নক্ষত্রের একটি বিশেষ পর্যায়ে। যখন সেই নক্ষত্রটিকে বলা হচ্ছে, ‘কোল্যাপসার্স’। ওই কোল্যাপসার্স নক্ষত্ররা তাদের মৃত্যুর সময়ে পৌঁছে জন্ম দেয় লং গামা রে বার্স্টের। যে গামা রশ্মির স্থায়ীত্ব ৫০ সেকেন্ড থেকে শুরু করে দুই বা আড়াই মিনিট পর্যন্ত হয়।’’

হিসেবে দেখা গেছে, ‘ব্রহ্মাণ্ডের যে অংশটুকু আমরা দেখতে পাই, শুধু সেইটুকু অংশেই লং গামা রে বার্স্টের ঘটনা ঘটে বছরে অন্তত একটি করে। লং গামা রে বার্স্টের ঘটনা সংখ্যায় কম হলেও, তার ফলে সোনা ও প্ল্যাটিনামের মতো মূল্যবান ভারী মৌলের কিন্তু জন্ম হয় প্রচুর পরিমাণে। সেই সোনা ও প্ল্যাটিনামের এক-একটা মহা তালের ওজন হয় সূর্যের ভরের তিন থেকে চার গুণ।’

এই সোনা, প্ল্যাটিনাম আর কোথায় রয়েছে?

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, মঙ্গল, শুক্র, বুধের মতো সূর্যের কাছাকাছি থাকা পাথুরে গ্রহগুলোর অন্তর, অন্দরে এই মূল্যবান মৌল থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট। যদি থাকেও বা সামান্য পরিমাণে, তবে চাঁদের বালিতে ভরা পিঠে (লুনার সারফেস) বালিকণার সঙ্গে মিশে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে এই ধরনের ভারী মৌলের। মঙ্গল, শুক্র বা বুধ থেকে আমরা তুলে আনতে পারি সেই মূল্যবান মৌল, প্রয়োজন হলে।

তবে ব্রহ্মাণ্ডে এত যে বিপুল পরিমাণে সোনা ও প্ল্যাটিনামের মতো মূল্যবান মৌলগুলো তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেগুলোকে নিয়ে আসাটা একটু কষ্টসাধ্যই। কারণ, আমাদের সবচেয়ে কাছে থাকা নক্ষত্রমণ্ডল ‘আলফা সেনটাওরি’ রয়েছে ৪ আলোকবর্ষ দূরে। মানে, এখনকার মহাকাশযানে চেপে সেই মুলুকে যেতে লাগবে ৪০ হাজার বছর। তবে কোনো মহকাশযানকে যদি ভবিষ্যতে ছোটানো যায় আলোর গতিতে তা হলে ৪ বছরেই পা দেয়া যাবে আলফা সেনটাওরিতে। আনন্দবাজার।

এসআইএস/পিআর