ভারত জুড়ে চলছে তুমুল উত্তেজনা। নির্বাচন এবং ফলাফল নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই । এই লেখা পাঠক যখন পড়বেন তখন জানা হয়ে যাবে কে হচ্ছেন ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী। বুথ-ফেরত জরিপ অনুযায়ী বিজেপি এবং তার মিত্রদেরই সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার কথা। তাই প্রায় ধরেই নেয়া হচ্ছে যে বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদিই আবার ফিরে আসছেন দিল্লির অধিপতি হয়ে।
Advertisement
নির্বাচনী প্রচারণার শুরুতে ধারণা করা হচ্ছিল যে, পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে মোদি তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, তাই তার এবারের লড়াই জয় সহজ হবে না। নির্বাচন কয়েক দফা হওয়ার পর বলা হচ্ছিল মোদির কপালে নাকি ভাঁজ পড়ে গেছে। অর্থাৎ তার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। বিরোধী মহলে এক ধরনের উল্লাস লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। অবশ্য নিজেদের জয়ের ব্যাপারে মোদি বরাবরই ছিলেন আত্মবিশ্বাসী।
এখন নির্বাচন শেষে এসে দেখা যাচ্ছে, ভারতবাসীর আস্থা মোদিতেই। মোদির চেয়ে আর কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যোগ্য বলে ভারতের জনগণ ভাবেনি। মোদির প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের রাহুল গান্ধী। কিন্তু মানুষের কাছে তার ইমেজ কেমন যেন ম্লান। ভোটের আগে বোন প্রিয়াঙ্কাকে সঙ্গে নিয়েও তেমন সুফল পাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়নি। বরং একেবারে প্রথম থেকেই যদি রাহুলের বদলে প্রিয়াঙ্কা কংগ্রেসের হাল ধরতেন তাহলে হয়তো কংগ্রেসের মরা গাঙে বান ডাকতেও পারতো।
ভারতে বিজেপি এবং কংগ্রেস ছাড়া সর্বভারতীয় কোনো দল নেই। দেশজুড়ে সংগঠন-সমর্থক আছে এই দুই দলেরই। তবে ভারতে এখন চলছে আঞ্চলিক দলের জয়জয়কার। একেক রাজ্যে একেক দল ক্ষমতায়। এই আঞ্চলিক দলের নেতারা কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে নিজের অবস্থান জানান দিতে চান। তারা কেন্দ্রে সরকার গঠনের স্বপ্নও দেখে। কিন্তু তারা আবার সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। ভারতে এখন মোটা দাগে তিন ধারার রাজনীতি চলছে। এক ধারার নেতৃত্বে বিজেপি। এরা মূলত সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদী। আরেক ধারার নেতৃত্ব কংগ্রেস। এরা অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে। এর বাইরে আর সবাই। এদের অবস্থান কিছুটা জগাখিচুরির মতো। অসাম্প্রাদায়িক-সাম্প্রদায়িক মিলেমিশে একাকার। একসময়ে ভারতে বামপন্থি একটি ধারা প্রবল হয়ে উঠছিল। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা এবং ত্রিপুরায় দীর্ঘদিন সরকারে ছিল কমিউনিস্টরা। এখন এই কমিউনিস্ট বিলীনপ্রায়। তারা নানা দলে গিয়ে মিশেছে, এমনকি বিজেপিতেও।
Advertisement
বিজেপিবিরোধী একটি বৃহত্তর মোর্চা যদি নির্বাচনের আগে গড়ে উঠতো তাহলে ভোটারদের মধ্যে একটি ইতিবাচক প্রভাব হয়তো পড়তো। কিন্তু সেটা হয়নি। তাই নির্বাচনে আগেরবারও যেমন মোদি ছিলেন দাপটের সঙ্গে, এবারও তার খুববেশি হেরফের হয়নি। হিন্দি বলয়ে বিজেপি এবার খুব খারাপ করবে বলে মনে করা হলেও বাস্তবে তা হয়নি।
উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ এবার সরকার গঠনে নির্ধারক ভূমিকা পালন করবে বলে বলা হলেও এই দুই রাজ্য সম্ভবত মোদির দিক থেকে একেবারে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোদিতে আস্থা হয়তো কিছুটা কমেছে কিন্তু বিরোধীদের প্রতি আস্থাটা ততটা বাড়েনি। সংসদ নির্বাচনটা ভারতবাসী এবার সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন হিসেবে নিয়েছে। মোদি বনাম অন্যরা। বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটি মুখ সামনে আনতে পারেনি।
একটি ত্রিশঙ্কু সংসদ হলে কি হতে পারে সেসব আলোচনাও প্রচুর হয়েছে। কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না বলে কারো কারো মনে হয়েছে। যদি সত্যি তা হতো তাহলে হয়তো বিজেপিবিরোধী একটি কোয়ালিশন সরকারের দিকেই হাঁটতে হতো। বুথ-ফেরত জরিপ যদি বোগাস কিংবা গসিপ হয়ে থাকে তাহলে তৃতীয় পক্ষের কপালে শিঁকে ছিড়তে পারে। তবে এতগুলো বুথ-ফেরত জরিপ ভ্রান্ত হবে বলে অনেকেই মানতে চাইছেন না। তবে বিরোধীরাও প্রস্ততি নিয়ে রাখছে। যদি সংখ্যার হিসাব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে?
ভারতের সরকার বদল হওয়া না-হওয়ায় বাংলাদেশের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। এর প্রধান কারণ ভারতে সরকার বদল হলেও বিদেশনীতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসে। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থে অভিন্ন অবস্থান নিয়ে থাকে। আগেরবার কংগ্রেসকে হটিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এলে আমাদের এখানে বিএনপি-জামায়াত উল্লসিত হলেও পরে ‘দাগা' খেয়েছে।
Advertisement
কংগ্রেস আমলের চেয়ে বিজেপি আমলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন মাত্রা ও উচ্চতায় পৌঁছেছে। তবে এবার নির্বাচনী প্রচারণায় ‘ধর্ম' ইস্যুটা যেভাবে সামনে এসেছে সেটা আমাদের জন্য উদ্বেগ ও অস্বস্তির। আগেরবার মোদির কাছে মন্দিরের চেয়ে ল্যাট্রিন বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। এবার যদি মন্দির সামনে আসে তাহলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় থাকবে, সে নিশ্চয়তা কে দেবে? মোদি অভিজ্ঞ এবং বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন রাজনীতিবিদ। তিনি নতুন করে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিলে নতুন কি করেন, সেটাই দেখার বিষয়।
মোদিবিরোধী সরকার যেসব রাজ্যে ক্ষমতায় আছে সেসব রাজ্যে রাজনৈতিক সংকট বাড়বে বলে আশঙ্কা করা যায়। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারেন। তিনি মোদির বিরুদ্ধে যে তিক্ত রাজনীতির আবহ তৈরি করেছেন সেটা বদলা মোদি সমর্থকরা নেবে না মনে করার কোনো কারণ নেই। হিন্দু-মুসলিম বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গে এত প্রবলভাবে এসেছে যা রীতিমতো উদ্বেগের ব্যাপার। পশ্চিমবঙ্গ এতদিন ছিল অসাম্প্রদায়িকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
দীর্ঘদিনের কমিউনিস্ট শাসন পশ্চিমবঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষ ধারাকে বলবান করেছিল। এবার পশ্চিমবঙ্গে যদি বিজেপি ১০/১২ টি আসন পায় তাহলে মমতার গদি রক্ষা যেমন কঠিন হবে, তেমনি তার বিরুদ্ধে মুসলিম তোষণের যে অভিযোগ তার একটি বিপরীত প্রবণতাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে তার অভিঘাত আমাদের এখানেও লাগেতে পারে। তবে দুই দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের প্রত্যাশা, নির্বাচনী প্রচারণায় যাই হয়ে থাক না কেন, ভোটে জেতার সহজ পথ হিসেবে যে যে কৌশলই নিয়ে থাক না কেন, সরকার গঠনের পর যেন তার রেশ কোথাও দেখা যায়। বিভাজনের রাজনীতি ভারতের ঐক্য এবং স্থিতির জন্যই বিপজ্জনক হবে। ভারতে যারাই নির্বাচনে জিতে সরকার গঠনের সুযোগ পাক, তাদের জন্য আগাম অভিনন্দন ও শুভকামনা।
লেখক : যুগ্ম সম্পাদক, আমাদের নতুন সময়।
এইচআর/জেআইএম