অর্থনীতি

চরম আস্থার সংকটে পুঁজিবাজার

প্রতিদিন নতুন নতুন বিনিয়োগকারী আসলেও বাড়ছে না টাকার ফ্লো। উল্টো দেখা দিয়েছে তারল্য সংকট। প্রতিনিয়ত দরপতন হচ্ছে একের পর এক প্রতিষ্ঠানের। অভিহিত মূল্যের নিচে নেমে গেছে অর্ধশত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম। উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে তালিকাভুক্ত হওয়া অর্ধডজনের বেশি কোম্পানির শেয়ারের দাম নেমে গেছে ইস্যুমূল্যের নিচে। চরম আস্থার সংকটে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার।

Advertisement

দুই মাসের বেশি সময় ধরে পুঁজিবাজারে এ মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ের দরপতন ও লেনদেন খরা বাজারের দুরবস্থা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত পুঁজি হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। প্রাতিষ্ঠানিক ও বড় বিনিয়োগকারীরা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন। পুঁজিবাজারকে সাপোর্ট দেয়ার দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)-ও অনেকটা নিষ্ক্রিয়।

অথচ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পুঁজিবাজারে বড় ধরনের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়। ভোটের পর প্রায় এক মাস ঊর্ধ্বমুখী থাকে বাজার। তালিকাভুক্ত প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের দাম বাড়ে। এতে এক মাসের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ৭০০ পয়েন্টের ওপরে ওঠে। লেনদেন পৌঁছে যায় হাজার কোটি টাকায়। সেই বাজার এখন তারল্য সংকটে। লেনদেন এসে ঠেকেছে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে। এমন তারল্য সংকট দেখা দিলেও গত তিন মাসে পৌনে এক লাখ নতুন বিনিয়োগকারী এসেছে।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, গত কয়েকদিন ধরে বাজারের যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তা বিনিয়োগকারীদের চরম আস্থার সংকটই ইঙ্গিত করে। সাম্প্রতিক সময়ের লেনদেন খরা বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা বাড়াচ্ছে। জানুয়ারি মাসজুড়ে পুঁজিবাজারে বড় উত্থানের ফলে এ সংকট দেখা দিতে পারে। নির্বাচনের পর কোনো চক্র পরিকল্পিতভাবে বাজারে এ উত্থান ঘটিয়ে এখন নীরব ভূমিকা পালন করছে কি না- তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার খতিয়ে দেখা উচিত।

Advertisement

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সাল শেষে পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব ছিল ২৭ লাখ ৬৬ হাজার ২১৭টি। যা প্রতিনিয়ত বেড়ে ৪ এপ্রিল দাঁড়ায় ২৮ লাখ ৩৩ হাজার ১৬৩টিতে। অর্থাৎ তিন মাসে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিও হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৬৬ হাজার ৯৪৬টি। এর মধ্যে একক বিও’র সংখ্যা বেড়েছে ৪১ হাজার ১১২টি। যৌথ বিও বেড়েছে ২৫ হাজার ৮৩৪টি।

এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) এক সদস্য বলেন, যেভাবে প্রতিদিন বিও হিসাব বাড়ছে তাতে বাজারে তারল্য বাড়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাজারে চরম তারল্য সংকট বিরাজ করছে। এর মানে হলো, যেসব বিও হিসাব খোলা হচ্ছে এর বেশির ভাগই সেকেন্ডারি মার্কেটে (মূল বাজার) সক্রিয় নয়। আইপিও ধরার জন্য এসব বিও খোলা হচ্ছে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এসব বিও হিসাবের বেশির ভাগ বাজারে থাকা বিনিয়োগকারীরাই অন্য নামে খুলেছেন। ফলে মূল বাজার থেকে টাকা সরে গিয়ে প্রাইমারি মার্কেটে (আইপিও) আটকে থাকছে।তিনি বলেন, বাজারে এখন কী ধরনের সংকট বিরাজ করছে তা একটু গভীরে চিন্তা করলে বোঝা যাবে। ৬০টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম অভিহিত মূল্যের নিচে অবস্থান করছে। এর মধ্যে ‘এ’ গ্রুপের কোম্পানিও রয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি বাদে প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠানগুলোর দাম কমছে। এরপরও বিনিয়োগকারীরা কিনতে চাচ্ছেন না। সবার মধ্যেই যেন এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। আইসিবিও বাজারকে সাপোর্ট দিচ্ছে না। এখন শোনা যাচ্ছে শেয়ার কেনার জন্য আইসিবি সরকারের কাছে পাঁচ হাজার কোটি টাকা চেয়েছে।

তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে দরপতনে শেয়ারের দাম সবচেয়ে বেশি কমেছে বিডি অটোকার, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স, প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স, নর্দার্ন ইন্স্যুরেন্স, মাইডাস ফাইন্যান্স, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, প্রিমিয়ার লিজিং, ইউনাইটেড ফাইন্যান্স, ফার্স্ট ফাইন্যান্স, এফএএস ফাইন্যান্স, আইএফআইসি, জুট স্পিনার্স, তুং-হাই নিটিং, মেঘনা পেট, হাক্কানি পাল্প, ন্যাশনাল ফিড, এমারেল্ড অয়েল ও এসএস স্টিল। এসব কোম্পানির প্রত্যেকটির শেয়ারের দাম ৩০ শতাংশের ওপরে কমেছে।

এদিকে উচ্চ প্রিমিয়াম নিয়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া বসুন্ধরা পেপার, আমান কটন ফাইবার্স, ফারইস্ট নিটিং অ্যান্ড ডায়িং, অ্যাপোলো ইস্পাত, ওরিয়ন ফার্মা, আরগন ডেনিমস ও হামিদ ফেব্রিক্স লিমিটেড’র শেয়ারের দাম ইস্যুমূল্যের নিচে নেমে গেছে। অথচ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে যোগ্য বিনিয়োগকারীরা এসব প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ইস্যুমূল্যের থেকে অনেক বেশি দামে কেনার প্রস্তাব দেন।

Advertisement

এ বিষয়ে ডিএসইর এক সদস্য বলেন, বাজারে কী ধরনের কোম্পানি তালিকাভুক্ত হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রক সংস্থার চিন্তা করে দেখা উচিত। বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে শেয়ারের কাট অফ প্রাইজ নির্ধারণে যোগ্য বিনিয়োগকারীরা আকাশচুম্বী দাম হাঁকছেন। অথচ তালিকাভুক্তির পর ওইসব কোম্পানি ইস্যুমূল্যই ধরে রাখতে পারছে না। আবার এমনও কোম্পানি আছে তালিকাভুক্তির পর কয়েক বছর যেতে না যেতেই তাদের অফিসও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

তিনি বলেন, একের পর এক দুর্বল কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে। এতে বাজারের উপকার তো হচ্ছেই না বরং আরও ক্ষতি হচ্ছে। আইপিওর মাধ্যমে কোম্পানিগুলো শেয়ারের যে দাম নিচ্ছে, মূল মার্কেটে সেই দাম বেশিদিন ধরে রাখতে পারছে না। কোম্পানির ব্যবসায়, মুনাফায় ধস নামছে। এতে বিনিয়োগকারীদের বড় একটি অংশ মূল মার্কেটে বিনিয়োগ না করে আইপিওতে করছেন।

বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অনেকটা টানা ঊর্ধ্বমুখী থাকে পুঁজিবাজার। এক মাসের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক ৭০০ পয়েন্টের ওপরে বেড়ে যায় এবং লেনদেন চলে আসে হাজার কোটি টাকার ঘরে। তবে ২৭ জানুয়ারি থেকে বাজারের ছন্দপতন ঘটা শুরু হয়। দেখা দেয় দরপতন। সেই সঙ্গে কমতে থাকে লেনদেনের পরিমাণ।

সাম্প্রতিক সময়ে লেনদেন কমতে কমতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ৭ মার্চ পর্যন্ত শেষ ১১ কার্যদিবসের মধ্যে আট কার্যদিবসেই লেনদেন হয়েছে ৩০০ কোটি টাকার ঘরে। বাকি তিন কার্যদিবসের লেনদেন ছিল ৪০০ কোটি টাকার ঘরে। গত দুই মাসে ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক কমেছে ৫১৭ পয়েন্ট।

সার্বিক বিষয়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বাজারের যে চিত্র তা তারল্য সংকট ও আস্থার সংকটকে ইঙ্গিত করে। তারল্য সংকটের অন্যতম একটি কারণ হলো, ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া। এছাড়া এখন পর্যন্ত যে কয়েকটি ব্যাংক লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে তার বেশ কয়েকটির লভ্যাংশ আগের বছরের তুলনায় কম। যা বাজারের ওপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

‘তবে আমি মনে করি, এ বাজার নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। অনেক কোম্পানির শেয়ারের দাম এখনও অবমূল্যায়িত।’

এদিকে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকটে পুঁজিবাজারে চরম দূরবস্থা দেখা দিলেও বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক- বলছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন। এ বিষয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যান এম খায়রুল হোসেন বলেন, বাজারে উত্থান-পতন হয়েছে, কিন্তু অস্থিতিশীল হয়নি। সবার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল পর্যায়ে এনেছি।

তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিনিয়োগকারীদের তার ও সরকারের ওপর আস্থা রাখতে বলেন। তিনি (অর্থমন্ত্রী) বলেন, সূচক কত নামতে পারে আমি দেখব। এটা আমার জন্য চ্যালেঞ্জ। আপনারা আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন, ঠকবেন না। আমরা সবাই লাভবান হব। সূচক কত হবে- এটা আমি বলব না। সূচক ঠিক করে দেবে অর্থনীতি। অর্থনীতি যত বড় হবে, পুঁজিবাজারের সূচকও ততটা বাড়বে। পুঁজিবাজারকে পেছনে রেখে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না।

এমএএস/এমএআর/এএইচ /এমকেএইচ