>> নিরাপদ পানি পান করে দেশের ৮৭ শতাংশ মানুষ >> এ সেক্টরে ‘ভালো’ করলেও অভাব আছে ‘সচেতনতার’ : মন্ত্রী>> ভূগর্ভস্থ পানি নয়, জলাধার তৈরিতে গুরুত্বারোপ
Advertisement
রাজধানীর অন্যতম আবাসিক এলাকা গুলশান। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন গুলশানে এখন ঋতুরাজ বসন্ত বিরাজমান। যারা গুলশানকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে কাজ করেন, তাদের অধিকাংশের আবাস গুলশান লেকের অন্য পাড়ে কড়াইল বস্তিতে। সেখানে বসন্তকালেও বিরাজমান মলের দুর্গন্ধ।
কড়াইল বস্তির পাশের লেক খনন চলছে। এজন্য লেকের ভেতরে বাঁধ দেয়া হয়েছে। ওই বাঁধ দিয়ে বস্তির দিকে এগোতে থাকলে ভেসে আসে দুর্গন্ধ। বস্তির কাছে গেলে দেখা যায়, পায়খানার পাইপ লেকে যুক্ত। রয়েছে উন্মুক্ত পায়খানাও।
আরও পড়ুন >> ২০৩০ সালের আগেই সবার জন্য নিরাপদ পানি
Advertisement
এ বস্তিতে স্ত্রী আর সন্তানকে নিয়ে বাস করেন মো. রফিকুল ইসলাম। খাওয়া, গোসলসহ যাবতীয় কাজে ব্যবহার করেন সাপ্লাইয়ের পানি। প্রতি শুক্রবারই পানির সংকটে পড়েন তারা। আরও বড় সংকট হলো প্রতি সপ্তাহে দু-তিনদিন কালো কুচকুচে ময়লা পানি আসে সাপ্লাইয়ের পাইপ দিয়ে। ১৫ মিনিট থেকে আধাঘণ্টা ধরে চলে ময়লা পানির প্রবাহ। এরপর দেখা মেলে পরিষ্কার পানির। কিন্তু ফুটানো ছাড়াই সেই পানি পান করেন রফিকুলের পরিবার।
কড়াইল বস্তিবাসীর অভিযোগ, হুটহাট ময়লা পানি আসা আর শুক্রবার পানি না থাকার সমস্যা দীর্ঘদিনের। বারবার বলা সত্ত্বেও এখানকার হাজারও মানুষের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি): বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রতিবেদন-২০১৮’ প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসডিজি অর্জনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করলেও নিরাপদ খাবার পানি সরবরাহে দক্ষিণ এশিয়ার নয়টি দেশের মধ্যে নিচের দিকে অর্থাৎ দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ। দেশটির ৮৭ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পান করে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে আফগানিস্তান। দেশটির মাত্র ৫৫ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পান করে।
নিরাপদ পানি পানের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভুটান। এখানে শতভাগ মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার করে। এরপর মালদ্বীপ, যাদের ৯৯ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার করে। ইরান ও শ্রীলঙ্কা ৯৬ শতাংশ, ভারত ৯৪ শতাংশ, নেপাল ৯২ শতাংশ, পাকিস্তান ৯১ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি পানের সুযোগ পান।
Advertisement
সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন, তারা দেশের বড় একটা জনগোষ্ঠীর কাছে চাপকল ও পায়খানা পৌঁছে দিতে পেরেছেন। তারপরও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ খারাপ অবস্থায় থাকার কারণ হিসেবে তারা দায়ী করছেন জনগণের অসচেতনতাকে।
আরও পড়ুন >> ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩-১০ মিটার নিচে নেমে গেছে
তবে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা গ্রামাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক থাকা, নদী-নালা, খাল-বিল কমে যাওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়া এবং শহরাঞ্চলে পানির লাইনের সঙ্গে পয়োনিষ্কাশনের লাইন মিশে যাওয়াকে দায়ী করছেন।
এছাড়া সর্বত্র ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করায় ভূমিধসের শঙ্কাও করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের খাবার পানির প্রধান উৎস হচ্ছে ভূগর্ভস্থ জলাধার। যদি গ্রামের দিকে তাকাই, তাহলে সেখানে সমস্যাটা হচ্ছে পানিতে আর্সেনিক। যদি উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে তাকাই, সেখানে আর্সেনিক ও লবণাক্ততা রয়েছে। যেহেতু আমাদের মিঠাপানির উৎস কমে যাচ্ছে; নদী-নালা ভরাট হচ্ছে, নদীর নাব্য কমে যাচ্ছে, স্রোত কমে যাচ্ছে – এসব কারণে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যাচ্ছে। ওই পানি খাওয়া যায় না, চাষাবাদও করা যায় না।’
শহরের নিরাপদ পানি সংকটের কারণ হিসেবে আব্দুল হামিদ বলেন, ‘শহরও ভূগর্ভস্থ পানির মাধ্যমে চলছে। এখানে সমস্যা হলো, পানি সরবরাহের লাইনের সঙ্গে অনেক সময় নর্দমার (সুয়ারেজ) লাইন মিলে যায়। এটা বড় সমস্যা। এছাড়া লাইনগুলো অনেক পুরনো, ফলে ময়লাও থাকে।’
‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা : বাংলাদেশ প্রোগ্রেস রিপোর্ট- ২০১৮’ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় বিশুদ্ধ পানি ব্যবহারে বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা জানতাম যে, ভালোই করছি। আমরা শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ মানুষের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে পেরেছি, চাপকল পৌঁছে দিতে পেরেছি। শতকরা ৭০-৮০ ভাগ মানুষকে স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন (শৌচাগার) দিতে পেরেছি। এটা শুধু দেয়ার বিষয় নয়, যাকে দিচ্ছি তার সচেতনতার একটা বিষয়ও আছে।’
‘তাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। তাকে ব্যয় করার মতো মানসিকতাও থাকতে হবে। ল্যাট্রিন আমরা প্রায় বিনামূল্যে দিচ্ছি। এ টাকাটাও অনেকে ব্যয় করতে চান না। এটার অনেক সোসিওলজিক্যাল ও কালচারাল কারণ আছে। এটা আপনি-আমি সবাই বুঝি।’
এম এ মান্নান আরও বলেন, ‘আসল কথা হলো, এ সেক্টরে প্রচুর কাজ হচ্ছে। পাবলিক হেলথ সেক্টরে আমাদের বিশাল বড় বিনিয়োগ আছে। আমি যেখানে কাজ করি, ইতোমধ্যে আমি নিজেও বলেছি, পানি ও স্যানিটেশনের ব্যাপারে আমাদের যতটুকু করার দরকার, আমরা সেটুকুই করব এবং আমরা আশা করি, পারব।’
ভূমিধসের শঙ্কা
দেশের সর্বত্র ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার পরিবেশের জন্য হুমকিও বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় প্রতিদিন লাখ লাখ টন পানি লাগছে। এর পুরোটাই আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটার (ভূগর্ভস্থ পানি) থেকে সরবরাহ হচ্ছে। কিছু পিউরিফিকেশন (বিশুদ্ধকরণ) প্লান্ট আছে আমাদের। কিন্তু বুড়িগঙ্গার পানি এতটাই বিষাক্ত যে, ওই পানি বিশুদ্ধ করা যায় না। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে যেকোনো সময় ভূমিধস হতে পারে।’
যেভাবে হতে পারে সমাধান
বাংলাদেশে খাওয়া, কৃষিকাজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার হলেও অন্যান্য অনেক দেশে তা করা হয় না বলে জানান ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ।
আরও পড়ুন >> নামছে পানির স্তর : দেবে যেতে পারে ঢাকা
তিনি বলেন, ‘সারা পৃথিবী সারফেস ওয়াটার (ভূমির উপরের পানি) ব্যবহার করে। অর্থাৎ তারা জলাশয় তৈরি করে সেই পানি শহরে সাপ্লাই (সরবরাহ) দেয়। কিন্তু আমাদের এখানে কৃষি, দৈনন্দিন কাজ বা পান করা- সব ক্ষেত্রেই ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হয়।’
ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের প্রচলন সম্পর্কে আব্দুল হামিদ বলেন, ‘একসময় পুকুর বা নদীর পানি পান করাতে প্রচুর মানুষ ডাইরিয়া, কলেরায় আক্রান্ত হতেন। এজন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ ছিল, ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা। সেটা আবার কিছু বছর পর হিতে-বিপরীত হলো। আন্ডারগ্রাউন্ড ওয়াটারে আর্সেনিক ধরা পড়লো। এখন আমাদের সার্ফেস ওয়াটার (উপরিভাগের পানি) ব্যবহার করতে হবে। সেটা হতে পারে কোনো আটকা জায়গায়। আমাদের এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। এছাড়া ফারাক্কা বাঁধ ছেড়ে দেয়ার সময়ও প্রচুর পানি আসে; এটা যদি ধরে রাখা যায় তাহলে আমাদের খাওয়া ও কৃষিকাজ চলবে।’
এছাড়া বোতলজাত প্রতিষ্ঠানগুলোও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে বলে জানান আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘মিনারেল ওয়াটার মানে হচ্ছে, সেটা ভূগর্ভস্থ পানি নয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশে পাহাড়, ঝরনা- এগুলো থেকে মিনারেল ওয়াটার সংগ্রহ করে। কিন্তু আমাদের দেশে সংগ্রহ করা হয় আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে। পানি বিক্রির এসব প্রতিষ্ঠান বৃষ্টির পানি ধারণ করে তা বিক্রি করতে পারে।’
এ সমস্যা সমাধানে নদ-নদী সংরক্ষণ, বৃষ্টি ও বন্যার পানি ধরে রাখার জন্য পানি সংরক্ষণাগার তৈরির পরামর্শ দেন এ অধ্যাপক।
আব্দুল হামিদ বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার যত দিন না কমানো যাবে, যত দিন রিজার্ভার (জলাধার) তৈরি করা না যাবে; তত দিন এ সমস্যার সমাধান হবে না। উত্তরবঙ্গে রিজার্ভার তৈরির পরিকল্পনা ছিল, তবে সেই আলোচনা এখন আর দেখি না। রিজার্ভার অবশ্যই লাগবে, তাহলে হয়তো এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
পিডি/এমএআর/পিআর