আন্তর্জাতিক

কেন্দ্রের সঙ্গে নজিরবিহীন সংঘাত, টানা ধর্নায় মমতা

সারদা দুর্নীতি মামলায় জিজ্ঞাসাবাদ করতে কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাসায় দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার (সিবিআই) কর্মকর্তাদের অভিযানের জেরে নজিরবিহীন ধর্নায় বসেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। রোববার বিকেল থেকে শুরু হওয়া মমতার এই ধর্না এখনো চলছে।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার বলছে, সারদা দুর্নীতি মামলার তদন্তে ‘সহযোগিতা’ না করার অভিযোগ নিয়ে সিবিআই কর্মকর্তারা রোববার সন্ধ্যায় কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে হাজির হতেই পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে।

কলকাতা পুলিশ দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের কর্মকর্তাদের আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এরপরের সব ঘটনা নজিরবিহীন। পুলিশ কমিশনারের বাসায় ছুটে যান মুখ্যমন্ত্রী। উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন।

তারপরই ঘোষণা করেন, মোদি সরকারের হাত থেকে দেশের সংবিধানকে ‘বাঁচাতে’ তিনি নিজে ধর্নায় বসবেন। এই ধর্নাকে তিনি ‘সত্যাগ্রহ’ বলে অভিহিত করেছেন। রাজীব কুমারকে ‘বিশ্বের সেরা পুলিশ অফিসারদের অন্যতম’ বলেও বর্ণনা করেন মুখ্যমন্ত্রী।

Advertisement

রাত থেকেই ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে মমতার ধর্না শুরু হয়। সেখানে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের পাশাপাশি হাজির ছিলেন রাজীব কুমার-সহ জ্যেষ্ঠ পুলিশকর্তারাও।

আপাতত মুখ্যমন্ত্রী যে এটা চালিয়ে যাবেন, তার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি জানিয়েছেন, সোমবার বিধানসভায় বাজেট পেশের আগে প্রথামাফিক মন্ত্রিসভার বৈঠকটি হবে ধর্না মঞ্চের পাশে অস্থায়ী ছাউনিতে। ১৩ বছর আগে বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন তৎকালীন বাম সরকারের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদী আন্দোলন মমতা করেছেন।

সর্বশেষ সিঙ্গুর আন্দোলনের সময়ে এই মেট্রো চ্যানেলেই ২৬ দিন অনশন করেছিলেন তিনি। এখন কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে পথে বসে মমতা আবার অতীতের স্মৃতি ফিরিয়ে দিলেন। তিনি জানিয়েছেন, কেন্দ্র এখানে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করলেও পরোয়া নেই। তিনি ‘দেখে নেবেন।’

লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে বিরোধী দলগুলো যখন সম্মিলিতভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে জোট বাঁধার চেষ্টা করছে এবং কলকাতার ব্রিগেড সমাবেশে শপথ গ্রহণ করেছে, তখন তাৎপর্যপূর্ণভাবে মমতার ধর্না দেশের বিরোধী রাজনীতিতেও নতুন মাত্রা যোগ করল বলে কলকাতার রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন।

Advertisement

ধর্নার খবর পেয়ে শীর্ষস্থানীয় বিরোধী নেতারা মমতার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন। ফোন করেন কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী, আহমেদ প্যাটেল, অখিলেশ যাদব, মায়াবতীও। মমতার সমর্থনে টুইট করেন চন্দ্রবাবু নাইডু, অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

বার্তা পাঠান সাবেক রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীও। মমতা বলেন, ‘সবাই বলছেন তারা সঙ্গে আছেন।’ সোমবার এই ধর্নায় যোগ দিতে পারেন আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব। আসতে পারেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালও।

সারদা তদন্তের ব্যাপারে রাজীব কুমারকে কিছু দিন ধরেই তলব করছিল সিবিআই। সিবিআইয়ের অভিযোগ, রাজীব কুমার সারদা সংক্রান্ত বিশেষ তদন্তকারী দলের (সিট) শীর্ষে ছিলেন। কিন্তু বেশ কিছু নথি তিনি সিবিআইকে দেননি বা ‘নষ্ট’ করেছেন। তাকে বারবার নোটিশ দিয়ে ডাকলেও রাজীব কুমার সিবিআইতে যাননি বা তদন্তে সহযোগিতা করছেন না বলে অভিযোগ।

সব মিলিয়ে এবার তাকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হতে পারে বলে শনিবার সন্ধ্যা থেকেই খবর রটেছিল। যদিও রাজ্য প্রশাসন তাতে আমল না দিয়ে জানিয়ে দেয়, আদালতের নির্দেশে রাজীব কুমারকে জেরা বা গ্রেফতার করা যাবে না। আলোচনা করা যেতে পারে।

কিন্তু রোববার সকালে সিবিআই দফতরে অফিসারদের সঙ্গে শীর্ষ কর্তাদের বৈঠকের পরে অবস্থা দ্রুত বদলায়। রাজীব কুমারকে ‘গ্রেফতার’ করা হতে পারে বলেও আশঙ্কা দানা বাঁধে।

সকালে পরপর দু’টি টুইট করে মুখ্যমন্ত্রী জানান, ‘বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব জঘন্য রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় শুধু যে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিশানা করছে তা-ই নয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে। সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। আমরা এর নিন্দা করছি। কলকাতার পুলিশ কমিশনারের সাহসিকতা, নিষ্ঠা ও সততা প্রশ্নাতীত। তিনি সপ্তাহের সাত দিনই ২৪ ঘণ্টা কাজ করেন। এর মধ্যে একদিনই তিনি ছুটিতে ছিলেন। তা নিয়ে মিথ্যা রটনা হচ্ছে।’

রাতে পুলিশ কমিশনারের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করেন মুখ্যমন্ত্রী। শনিবার রাজ্যে সভা করে নরেন্দ্র মোদি বলে গিয়েছেন, মমতার সরকারের পতন হবেই। তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ কমিশনারকে কেন্দ্র করে তৈরি পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে গিয়ে মমতা তীক্ষ্ণ আক্রমণ শানান মোদির বিরুদ্ধে।

তিনি বলেন, ‘নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ বিজেপির দুই গুন্ডা মিলে বাংলায় ‘ক্যু’ করার চেষ্টা করছেন। যে ত্রাস শুরু হয়েছে তা জরুরি অবস্থার থেকেও ভয়াবহ। ক্ষমতায় ফিরবেন না বুঝে মোদি পাগল হয়ে গিয়েছেন। এবার কি রাজ্যে ৩৫৫ ধারা জারি হবে, না কি ৩৫৬?

মমতা বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির শাসন হলেও আমরা দেখে নেব। একটা গদ্দার (এই বিশেষণ তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া এক নেতা সম্পর্কে প্রয়োগ করেন) আর এক চম্বলের ডাকাতের ( এই বিশেষণের লক্ষ্য বিজেপির এক কেন্দ্রীয় নেতা) কথায় মোদী এবং শাহ এ সব করছেন। একটা করে নির্বাচন আসে, তখন চিটফান্ডের নাম করে যেখানে ইচ্ছে ঢুকে পড়ে।’

মোদি-সহ বিজেপির বিভিন্ন নেতানেত্রীর নাম উল্লেখ করে তিনি অভিযোগ করেন, বিভিন্ন চিটফান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সিবিআই তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তিনি কেন রাজীব কুমারের পাশে দাঁড়িয়েছেন তার ব্যাখ্যা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, ‘আমার সরকারের কোনও অফিসার, কোনও কর্মীর বিপদ হলে তাদের সুরক্ষা দেয়া আমার সাংবিধানিক দায়িত্ব।’

এসআইএস/এমকেএইচ