নির্বাচন আসছে, এইতো এলো বলে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থেই দু‘টো মাত্র পক্ষ- আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ-বিরোধী। একপক্ষ অর্থাৎ আওয়ামী লীগ চাইছে আরেকবার ক্ষমতায় এসে তাদের শুরু করে যাওয়া কাজগুলি শেষ করতে এবং বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার যে প্রতিশ্রুতি তারা জনগণকে দিয়েছে এতোদিন সেটা বাস্তবায়ন করতে।
Advertisement
অপরদিকে যারা আওয়ামী-বিরোধী অবস্থানে আছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য দেশ, দেশের উন্নয়ন কিংবা রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নয়, তাদের প্রাথমিক ও মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শেখ হাসিনা তথা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানো এবং তারপর সুযোগ পেলে তারা বাংলাদেশের জন্য কিছু করবেন। অর্থাৎ বাংলাদেশ, বাংলাদেশের জনগণ এবং উন্নয়ন তাদের কাছে ‘সেকেন্ডারি’, এতোদিন ধরে বিএনপি-জামায়াত, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, গণফোরাম, নাগরিক ঐক্য, সুশাসনের জন্য নাগরিক, বিকল্প ধারা, জাসদ (রব) - কোনো পক্ষ থেকেই বাংলাদেশের উন্নয়নে আওয়ামী লীগের গত দশ বছরের যে প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি তার বিকল্প কোনো প্রস্তাব বা উল্লেখ কোথাও করা হয়েছে বলে আমার অন্ততঃ চোখে পড়েনি।
যদি দিয়ে থাকেন তবেতো ভালোই, নাহলে আগামী নির্বাচনটি আসলে হতে যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ বনাম আওয়ামী-বিরোধী তথা বাংলাদেশের উন্নয়ন বনাম আওয়ামী-বিরোধীদের ক্ষমতায়ন; বলাই বাহুল্য এই সমীকরণ দেশের জন্য কোনো শুভকর ঘটনা নয়। আমরা যদি আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী-বিরোধী কথিত জাতীয় ঐক্যের মূল পাঁচটি দাবির অন্যতম হচ্ছে বেগম জিয়ার মুক্তি এবং নির্দলীয় সরকার। নির্বাচন নিয়ে তাদের সন্দেহ বা নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার ভয়টা তাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক।
সেক্ষেত্রে তাদের এই ঐক্য যে জাতীয় ঐক্য নয়, একটি নির্বাচনী ঐক্য সেটা বোধগম্য। এই নির্বাচনকে সামনে রেখেই তারা তাদের অতীতের সকল অপমান, অবজ্ঞা সবকিছুকে একটি কৌটোয় বন্দী করে তারা একটি ঐক্যে পৌঁছেছেন, যে কৌটোকে আমরা বলতে পারি ক্ষমতা। কিন্তু সে ক্ষমতা তারা পেলে বাংলাদেশের জন্য তারা কী করবেন সেটা কিন্তু তারা কোনো ভাবেই খোলাসা করেননি। বরং নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় যতোই ঘনিয়ে আসছে ততোই তারা মূলতঃ আওয়ামী-বিরোধী প্ল্যাটফরমটিকে আরো বেশি শক্তিশালী করার জন্য যে কোনো ছাড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করছেন বলে বোঝা যায়।
Advertisement
যেমন বিএনপি’র সঙ্গে অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্প ধারা এদেশে কখনও একসঙ্গে রাজনীতি করবে সেটা কেউ হয়তো স্বপ্নেও ভাবেনি। কিন্তু সেটা হতে চলেছে বলে দেখা যাচ্ছে। ড. কামাল হোসেন সব সময় একথা জোর দিয়েই বলে আসছিলেন যে, তিনি কখনও যুদ্ধাপরাধী ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হাত মেলাবেন না, তিনি জনগণের রাজনীতি করতে চান। কিন্তু আজকে ড. কামাল হোসেন স্পষ্টতঃই জামায়াতের সঙ্গে বিএনপি’র জোটবদ্ধ আন্দোলনকে অস্বীকার করতে পারছেন না এবং তিনি মূলতঃ বিএনপি’র সঙ্গে সঙ্গে জামায়াতেরও নেতা হয়ে বসেছেন এই মুহূর্তে।
নাগরিক ঐক্যের মান্না সাহেবের না হয় আর কোনো উপায় নেই কিংবা তিনি আসলে এই মুহূর্তে যেরকমটি বলছেন, তিনি আসলেই তাই-ই, অর্থাৎ তার কখনওই জামায়াতের বিষয়ে কোনো ধরনের এ্যালার্জি ছিল না, এতোদিন ধরে তিনি আসলে একটি ভুল রাজনীতিই করে আসছেন এবং জনগণকে তার সম্পর্কে ভুল ধারণাই দিয়ে এসেছেন। তিনি আসলে বিএনপি-জামায়াতেরই একজন কর্মী, তিনি এর বেশি কিছু নন।
বাংলাদেশে আমরা তাকে একজন সাবেক বাম বা আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিলাম তার সম্পর্কে না জেনেই। তিনি সেটি স্পষ্ট করেছেন এবং নিজের অতীতের পোশাকটি তিনি নিঃসঙ্কোচে খুলে ফেলে এখন তিনি বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে গিয়ে জুটেছেন। কিন্তু আমার প্রশ্নটি অন্যখানে।
যেমন আজকেই (সোমবার রাত দশটা) এ লেখাটি যখন লিখছি তখন ড. কামাল হোসেনের একটি বক্তৃতার খবর পাঠ করছিলাম। ড. কামাল হোসেন স্পষ্ট করেই বলছেন যে, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় মানুষ সাড়া দিতে শুরু করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রশ্ন হলো, তিনি যাদেরকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য করার চেষ্টা করছেন তারা বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে কী ভাবে দেখেন?
Advertisement
শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া পাঁচটি দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করবে যার অন্যতম হচ্ছে বেগম জিয়ার মুক্তি। তার মানে এই ঐক্য প্রক্রিয়া সর্বসম্মতভাবে মেনেই নিয়েছে যে, তারা বেগম জিয়াকে তাদের নেতা মানছেন, নাহলে তার মুক্তির দাবি করার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু বেগম জিয়া মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কী বলেন? আর সব কথা বাদ দিলেও তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে একটি বিচারাধীন মামলার আসামী হয়েছেন।
অর্থাৎ তিনি মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সংখ্যাটিই বিশ্বাস করেন না। তাহলে ড. কামাল কথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কী ভাবে বাস্তবায়ন করবে এই ঐক্য প্রক্রিয়া, যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রাথমিক শর্তটিই অর্থাৎ শহীদদের সংখ্যা নিয়েই এই ঐক্য প্রক্রিয়ার অঘোষিত নেতা বেগম জিয়ার প্রশ্ন থাকে?
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে ড. কামাল হোসেন ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দেশে ফিরে আসার গল্প শুনিয়েছেন আমাদের। তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর সেদিন চিন্তামগ্ন ছিলেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন যে, নয় মাসে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন হয়েছে কেবল জাতীয় ঐক্য ছিল বলে। প্রশ্ন হলো, যাদেরকে সামনে বা পাশে বসিয়ে ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের গল্প শোনালেন তারা কি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মদাতা বলে মানেন?
আমরা বিএনপি’র রাজনীতি সম্পর্কে যারা জানি তারা সকলেই একথা ধ্রুব সত্য বলে জানি যে, বিএনপি’র রাজনীতিই প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী-বিরোধিতা, তথা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের রাজনীতি ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করার মধ্য দিয়ে। এমনকি বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়ার নাম জড়িত এবং তার হাতেই আইন করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ হয়েছে, খুনিরা দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে।
এই দলটির মূল নেতা বেগম জিয়া, তার পুত্র তারেক জিয়া থেকে শুরু করে একেবারে পাতি নেতা পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য নানাবিধ উদ্ভট তত্ত্ব হাজির করেন। কী করে তাদের সঙ্গে ঐক্য করে ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবেন সেটা নিঃসন্দেহে একটি কোটি টাকার প্রশ্ন বটে!!
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল অসাম্প্রদায়িক ও কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের বাড়াবাড়িমুক্ত একটি উদারনৈতিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা, কিন্তু সেই প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক বাধাটি এসেছিল জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নাম করে তিনি স্বাধীনতা-বিরোধী রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস্ ও জামায়াত-শিবিরকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন করেন আর তার স্ত্রী তাদের হাতে তুলে দেন রাষ্ট্র ক্ষমতা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে এটি কেবল সাংঘর্ষিকই ছিল না, ছিল ভয়ঙ্কর ও গর্হিত অপরাধ। সেই অপরাধীদের সঙ্গে ঐক্য করে ড. কামাল হোসেন কী করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করবেন সেটাও বিস্ময়কর প্রশ্ন, সন্দেহ নেই।
মজার ব্যাপার হলো, ওই একই অনুষ্ঠানে ড. কামাল হোসেনের সামনে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন দেশকে তিনি ‘বাকশালীদের’ হাত থেকে মুক্ত করতে চান এই ঐক্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বাকশাল বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া সংগঠন এবং তাতে ড. কামাল হোসেনও ছিলেন নিশ্চয়ই। তাহলে ভবিষ্যতে যদি এই ঐক্যপ্রক্রিয়া ক্ষমতা লাভ করে তাতেতো ড. কামাল হোসেনের মতো বাকশালীও থাকবেন, তখন?
আর ঐক্য প্রক্রিয়ার আরেক পুরোধা ব্যক্তিত্ব ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী এই অনুষ্ঠানে ভয় দেখান আরেকটি ৭৫-এর ঘটনার। ড. কামাল হোসেনের উপস্থিতিতেই যখন আরেকটি ৭৫-এর ভয় দেখান তখন বুঝতেই হয় যে, ড. কামাল হোসেন আসলে সত্যিই আরেকটি রাজনৈতিক ভুল করতে যাচ্ছেন, যে ভুলে তিনি আওয়ামী লীগ ছেড়েছিলেন সেই একই ভুল কিংবা তার চেয়েও বড় ভুল করে তিনি আসলে যা হবার নয় (বিএনপি-জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন) তাই-ই করার স্বপ্ন দেখছেন।
এ স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার নয় কোনোদিন। বরং এই দুঃস্বপ্ন কিছু ন্যায্য ও সুষ্ঠু দাবি আদায়ে তার জন্য প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে যেমন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। যে দাবিগুলোয় জনগণ তাদের পাশে দাঁড়ালেও দাঁড়াতে পারতো কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি বিএনপি-জামায়াতকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাইবেন সেই মুহূর্তেই জনগণ মুচকি হেসে তার পাশ থেকে সরে দাঁড়াবে, কারণ তিনি না চিনলেও জনগণ নিঃসন্দেহে জামায়াত-বিএনপি ও তাদের রাজনীতিকে চেনে ও বোঝে।
ঢাকা ৮ অক্টোবর, সোমবার ২০১৮
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।masuda.bhatti@gmail.com
এইচআর/পিআর