চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর এলাকার বাসিন্দা ও রাজধানীর নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিহত সাইদুর রহমান পায়েলের (২১) মরদেহ উদ্ধার হয় মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানার ফুলদি নদী থেকে। অথচ হানিফ পরিবহনের স্টাফ জনি ঘটনার পরদিন পুলিশকে জানান, পায়েল গাড়ি থেকে নেমেছে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন মদনপুর ক্যাসেল রেস্টুরেন্টের সামনে।
Advertisement
জনির কথা অনুযায়ী, পায়েলের গাড়ি থেকে নামার স্থান ও মরদেহ উদ্ধারের স্থানের দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। এই দূরত্ব এবং পায়েলের পরিবার ও দুই থানার ওসির বক্তব্যের ভিন্নতা মধ্যেই লুকিয়ে ছিল পায়েল হত্যার রহস্য। বিষয়টিকে সামনে এনে সাইদুর রহমান পায়েল নিখোঁজের তিনদিন পর গত ২৪ জুলাই ‘বাস থেকে নেমেছিল কোথায় পায়েল?’ শিরোনামে জাগো নিউজে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
সংবাদ প্রকাশের একদিন পরেই গতকাল বুধবার (২৫ জুলাই) হানিফ পরিবহনের সুপারভাইজার ও চালক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানায়, ‘নারায়ণগঞ্জে নয়, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানার ভাটেরচরই বাস থেকে নেমেছিল পায়েল। পরবর্তীতে যানজট নিরসন হলে বাসটি দ্রুত যাওয়ার চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় বাসে উঠতে গিয়ে বাসের দরজার সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লাগে পায়েলের। এতে তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে থাকলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরবর্তীতে বাসচালক, চালকের সহযোগী ও সুপারভাইজার পায়েলকে মৃত ভেবে ব্রিজ থেকে ফেলে দিয়ে চলে আসে।’
এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (২৬ জুলাই) সকালে গজারিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হারুন-উর-রশীদ জাগো নিউজের এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সোমবার (২৪ জুলাই) পায়েল নারায়ণগঞ্জে নামেইনি- আপনার কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়ার পর সন্দেহ হয়- হানিফ পরিবহনের স্টাফরা কোনো কারণে মিথ্যে বলছে। সেই সূত্রে বাসচালক জালাল, সুপারভাইজার ফয়সাল ও বাসচালকের সহকারী জনিকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়। তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা যায় হত্যার রহস্য। বাসের সুপারভাইজার ফয়সাল পুলিশের কাছে হত্যার ঘটনার বর্ণনা দেন। পরে তাকে মুন্সীগঞ্জের আদালতে পাঠানো হয়।’
Advertisement
তিনি আরও বলেন, ‘বাসের স্টাফ জনি বারবার পায়েলকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন মদনপুর ক্যাসেল রেস্টুরেন্টের সামনে নামিয়েছে বলে আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। আপনাদের প্রকাশিত সংবাদে পথের যে দূরত্ব ও বন্দর থানার ওসির যে বক্তব্য দেয়া হয়েছে তা যাচাই করতে ঘাতকদের চাপ দিলে, তারা স্বীকার করেছে- নারায়ণগঞ্জে নয়, মুন্সিগঞ্জের গজারীয়া থানাধীন ভাটেরচর সেতুর কাছেই গাড়ি থেকে নেমেছিল পায়েল।’
ওসি হারুন-উর-রশীদ বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) আসামি ফয়সালকে আমলি আদালত গজারিয়ায় হাজির করে পুলিশ। এসময় ফয়সাল বিচারকের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে জানায়- ২১ জুলাই রাতে হানিফ পরিবহনের বাসটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মুন্সিগঞ্জের গজারীয়া থানাধীন ভাটেরচর সেতুর কাছে যানজটে পড়ে। বাসযাত্রী সাইদুর প্রস্রাব করতে বাস থেকে নিচে নামেন। বাস দ্রুত টান দিলে পায়েল বাসের দরজার সঙ্গে সজোরে ধাক্কা খায়। এতে তার নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয় এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। বাসের চালক, চালকের সহকারী ও সুপারভাইজার ধারণা করেন, পায়েল মারা গেছেন। এই ভেবে চালকের সহকারী ও সুপারভাইজার পায়েলকে ব্রিজ থেকে ফেলে দিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন।’
যেভাবে ধরা পড়ল ঘাতকদের মিথ্যাচার :
নিহত পায়েলের মরদেহ উদ্ধারের তিনদিন পর জাগো নিউজের পক্ষ থেকে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানা ও মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানায় যোগাযোগ করা হয়। এসময় দুই থানার ওসি কে এম শাহীন মণ্ডল ও হারুন-উর-রশীদের সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।
Advertisement
মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানার ওসি হারুন-উর-রশীদ জাগো নিউজকে জানান, নিহতের পরিবার হানিফ পরিবহনের স্টাফ জনিকে ঘটনাস্থলে নিয়ে এসেছিল। তিনি নিশ্চিত করে পুলিশকে জানান, ঘটনার দিন ভোররাত সাড়ে ৪টায় বাসটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মদনপুর ক্যাসেল হোটেলের সামনে যানজটে পড়ে। তখন টয়লেটের প্রয়োজনে পায়েল বাস থেকে নামেন।
কিন্তু এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার ওসি কে এম শাহীন মণ্ডলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজের কাছে দাবি করেন, ‘পায়েল নারায়ণগঞ্জে নামেইনি’।
সেসময় মোস্তাফিজুর রহমান নামে এক পুলিশ পরিদর্শকের বরাত দিয়ে ওসি জানান, পায়েল যে জায়গায় নেমেছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করছে, সেটি কোনো বাসস্টপেজ নয়। আশপাশের অনেকের সঙ্গে কথা বলে ওই দিন রাতে গাড়ি থেকে কেউ নেমেছে এমন কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
ওসি কে এম শাহীন মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে দেখেছি, ওই দিন রাতে আমার থানা এলাকায় নিহত পায়েল নামেননি। আর যেখানে তার মরদেহ পাওয়া গেছে তা আমার থানা থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে। যতদূর জেনেছি ছেলেটি কুমিল্লার দিকে নেমেছে হয়তো।’
স্বাভাবিক ভাবেই ‘বাস থেকে নেমেছিল কোথায় পায়েল?’ জাগো নিউজের তোলা এই প্রশ্নে উত্তর সন্ধানে নামে মুন্সিগঞ্জের পুলিশ। শেষ পর্যন্ত সেই সূত্রেই উত্তর মেলে পায়েল হত্যার রহস্যের।
ফুলদী নদী থেকে পায়েলের মরদেহ উদ্ধারে অংশ নেয়া গজারিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আসাদুজ্জামান তালুকদার জাগো নিউজকে জানান, মরদেহ উদ্ধারের সময় নিহত পায়েলের নাক ও মুখে রক্ত ছিল। আর গলার ডান পাশ ও পেটের দুই পাশে কালো দাগ ও ক্ষত দেখা গেছে।
গজারিয়া থানার ওসি হারুনুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রথম দিকে ছেলেটিকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছিল না। আমরা যখন মরদেহ উদ্ধার করি তখন মরদেহ ফুলে গিয়েছিল। তবে তার নাক-মুখে রক্তের আলামত পাওয়া গেছে। মাথায় ভারী কিছুর আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে। ’
এদিকে পায়েলের নিকটাত্মীয়দের দাবি করেছেন, তাকে হত্যার পর মুখ বিকৃত করে রাতের অন্ধকারে ব্রিজে গাড়ি থামিয়ে নদীতে লাশটি ফেলে পালিয়েছে হানিফ পরিবহনের স্টাফরা।
পায়েলের মামা কামরুজ্জামান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আটক তিনজনের একজন পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে পায়েলকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমাদের জানিয়েছেন, গ্রেফতারের পর বাসচালকের এক সহকারী স্বীকার করেছে, তারাই পায়েলকে হত্যা করে এবং পরে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। তারা (বাসচালক ও সহযোগীরা) পুলিশকে জানায়, পায়েল দৌড়ে এসে বাসে উঠতে গিয়ে এর দরজার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। এসময় নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে সে অজ্ঞান হয়ে যায়। চালকের সহযোগী জনি বিষয়টি বাসচালককে জানালে চালক স্টিয়ারিং থেকে নেমে এসে বলে, ছেলেটা তো মারা গেছে। তাকে এখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে ঝামেলা হবে। এরপর তারা পায়েলের মুখ থেঁতলে দিয়ে লাশ নদীতে ফেলে দেয়।’
এমবিআর/আরআইপি