ফুটবলের রঙ কি? প্রশ্নটা যদি এভাবে করি, ফুটবলের নির্দিষ্ট কোনো রঙ কি আসলে আছে? বেদনার রঙ নীল হয়। কিন্তু মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে সেই বেদনার রঙ লাল হয়ে গেলো। ইনিয়েস্তা, বুস্কেটস, রামোস, পিকে, ইসকো, সিলভাদের চোখের পানি এসে মিশে যাচ্ছিল শরীরে জড়ানো লাল জার্সিতে। মুখ বেয়ে নেমে আমা অশ্রুর ফোটা সঙ্গে সঙ্গেই ধারণ করছে লাল রং।
Advertisement
যদিও গ্যালারিতে তখন চলছিল লাল উৎসব। রাশিয়ান সমর্থকদের উল্লাস আর গগনবিদারী চিৎকারে কেঁপে উঠছিল তখন পুরো স্টেডিয়াম। রাশিয়ার হোম জার্সিই যে লাল! কিন্তু স্পেনের বিপক্ষে এই ম্যাচে তারা নেমেছে সাদা অ্যাওয়ে জার্সি পরে।
স্পেন নেমেছে নিজেদের লাল হোম জার্সি পরে। সে কারণে, মাঠের লাল বেদনার সঙ্গে গ্যালারির লাল উল্লাস, অনেকেই হয়তো গুলিয়ে ফেলতে চাইবেন; কিন্তু স্প্যানিশদের মনের নীল বেদনা তো আর তাতে কমবে না কোনোভাবেই। মুছেও যাবে না।
একটা দল এভাবে হেরে যেতে পারে! তাও একচেটিয়া এভাবে খেলার পরও, বিশ্বাস হওয়ার কথা নয়। বিশ্বকাপের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে ফেলেছে স্পেন, রাশিয়ার বিপক্ষে, মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে। এক হাজারেরও বেশি পাস দিয়েছে তারা। ১২০ মিনিটের খেলায় পাস দিয়েছে ১১১৪টি। বলে টাচ নিয়েছে ১০২৯বার। বিপরীতে মাত্র ২০২টি সফল পাস দিতে পেরেছে রাশিয়া।
Advertisement
১৯৬৬ সালে টিভিতে খেলা দেখানো এবং পরিসংখ্যানের হিসেব রাখার পর থেকে মাত্র তিনটি দল এক হাজারের বেশি বল পাস দিয়েছিল। ১৯৯৪ সালে ইতালির বিপক্ষে ব্রাজিল, ২০১০ সালে জার্মানির বিপক্ষে স্পেন এবং ২০১৪ বিশ্বকাপে আলজেরিয়ার বিপক্ষে জার্মানি দিয়েছিল ১ হাজারের বেশি পাস। মজার বিষয় হলো আগের তিনবারই জিতেছে সবচেয়ে বেশি পাস দেয়া দল। অথচ, রাশিয়ার বিপক্ষে এই ম্যাচে জয়ের দেখা পেলো না স্পেন। বেদনাবিধুর বিদায় ঘটেছে টাইব্রেকারে ৪-৩ গোলে হেরে।
ম্যাচের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ১৭বার রাশিয়ার পোস্ট লক্ষ্যে শট নিয়েছিল স্পেন। অন টার্গেট শট ছিল ৯টি। কী দুর্ভাগ্য একটি শটও খুঁজে পেলো না রাশিয়ার জাল। রাশিয়ার গোলরক্ষক ইগোর আকিনফিভ ছিলেন যেন স্পেনের ফুটবরারদের সামনে চীনের মহাপ্রাচীর। যে’ই শট নিক, সেটা নিশ্চিত বাধাপ্রাপ্ত হবেই সেই ওয়ালের সামনে। না হয়, স্প্যানিশদের এত এত শট কেন রুখে যাবে পোস্টের ঠিক সামনে!
ফিফা র্যাংকিংয়ে এবার সর্বনিম্ন র্যাঙ্কধারী দল ছিল রাশিয়া। তারা রয়েছে ৬৬ নাম্বার র্যাংকিংয়ে এবং স্পেন রয়েছে ৮ নম্বর র্যাংকিংয়ে। ম্যাচের পরিসংখ্যান বিচার করলে সেই চিত্রই ফুটে ওঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের টাইব্রেকারে যে পিছিয়ে পড়তে হলো স্পেনকে!
ম্যাচের শুরুতে সৌভাগ্যের মুখোমুখিই হয়েছিল স্পেন। ১২তম মিনিটে ইসকোর ফ্রি-কিকের শটটি ঠেকাতে গিয়ে সার্জিও রামোসকে ফেলে দেন পোস্টের সামনে। নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেননি। বল এসে পড়ে সার্গেই ইগনাশেভিকের পায়ে। বলটি সোজা প্রবেশ করলো রাশিয়ার জালে। আত্মঘাতি গোলে এগিয়ে গেলো স্পেন। আনন্দের বন্যা স্পেন শিবিরে।
Advertisement
নিয়তি বুঝি তখন আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসছিলো! আর বলছিলো, এত আনন্দ করে কী হবে! শেষে তো চোখের পানিতেই ভাসবে। আহা, কী দুর্ভাগ্য! ভবিতব্য জানে না মানুষ। জানার কোনো সুযোগ নেই। না হয়, স্পেন তো আরও সতর্ক হয়ে খেলতো। চেষ্টা করতো, নিজেরা না পারুক, অন্তত যেন প্রতিপক্ষ গোল দিতে না পারে। এই বিশ্বকাপেই তো প্রায় প্রতিটি ম্যাচে পার্ক করা বাস- ডিফেন্স দেখতে হচ্ছে সবাইকে। স্পেনও না হয় তাদের গোল মুখে ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ট্রাক’ দাঁড় করিয়ে রাখতো!
জানে না বলেই বেদনার গোলটি হজম করতে হলো তাদের। প্রথমার্ধের একেবারে শেষাংশে ঘটেছে এই ঘটনা। কর্নার থেকে ভেসে আসা বলে হেড করেন আর্তেক জিউবা। হেড করার জন্য লাফিয়ে উঠেছিলেন জেরার্ড পিকেও। তিনি লাফিয়ে যতটানা উঠেছে, তার চেয়ে বেশি উঠেছে তার হাত।
এমনকি লাফ দেয়া থেকে পতনের মুহূর্তেও হাতটি নামালেন না। জিউবার হেড গিয়ে আঘাত হানে পিকের হাতে। রেফারি যেন সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। দিলেন বাজিয়ে বাঁশি। পেনাল্টি। স্প্যানিশ ফুটবলাররা প্রতিবাদ জানালেন। কিন্তু উল্টো পিকেকে হলুদ কার্ড দেখতে হলো।
পেনাল্টির কিক নিতে আসেন জিউবা নিজে। স্পেনের গোলরক্ষক ডি গিয়া পেনাল্টি ফেরাতে পারলেন না। গোল। শোধ হয়ে গেলো আত্মঘাতি থেকে আসা স্পেনের গোলটি। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক উঠে গেছে, রেফারি পক্ষপাতিত্ব করলেন না তো! নাইজেরিয়ার বিপক্ষে যেমন আর্জেন্টিনার রোহোর হ্যান্ডবলে পেনাল্টি দিলেন না রেফারি, তেমনি একই হ্যান্ডবলে পেনাল্টি দিয়ে দিলেন? বিষয়টা দ্বিমুখি হয়ে গেলো না? কে দেবে এর জবাব?
পাগলাটে এক বিশ্বকাপই উপহার দিচ্ছে রাশিয়া। গ্রুপ পর্বের প্রথম থেকেই টান টান উত্তেজনার এক বিশ্বকাপ। শুরু থেকেই ফেবারিটদের হোঁচট। বিশ্বকাপ এতটাই উন্মুক্ত হয়ে গেছে যে, এখন আর ফেবারিট বলতে কিছু নেই। ৩২ দলের সবাই ফেবারিট। যে কেউ যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারে।
মেক্সিকো কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে গেরে যেতে পারে জার্মানি। আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডের কাছে হোঁচট খেতে পারে আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল। ক্রোয়েশিয়া হারিয়ে দিতে পারে আর্জেন্টিনাকে। শেষ পর্যন্ত রাশিয়া হারিয়ে দিলো স্পেনকে। জায়ন্ট বধের এই বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত ভালোভাবে টিকে আছে ফ্রান্স। সেরা তারকাদের মধ্যে বিদায় নিয়েছেন মেসি-রোনালদো, দু’জনই।
স্পেন বিশ্বকাপের অন্যতম ফেবারিট। যে দল নিয়ে তারা এসেছে রাশিয়ায়, চোখ বন্দ করে যে কেউ তাদেরকে ফেবারিটের তালিকায় রাখবে। দলের ১১জনই তারকা। প্রতিটি পজিশনে সেরা সেরা খেলোয়াড়। ২০১০ বিশ্বকাপজয়ী দলেরও কয়েকজন সদস্য রয়েছেন এই দলে। আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা, সার্জিও রামোস, জেরার্ড পিকে, ডেভিড সিলভা।
ইনিয়েস্তার মত মিডফিল্ডার, যার একার সামনেই খবি খেতে হয় বিশ্বের তাবৎ বড় বড় দলকে। সেই ইনিয়েস্তা রাশিয়ানদের রক্ষণ ভাঙতে পারলেন না। একটিবার বল প্রবেশ করাতে পারলেন না রাশিয়ার জালে। কিংবা একটি গোল করার মত বল বানিয়ে দিতে পারলেন না। একের পর এক আক্রমণ করে গেছেন শুধু; কিন্তু শীষাঢালা প্রাচীরের মত শক্ত ডিফেন্স ভাঙতে পারলেন না।
জেরার্ড পিকের সেই পেনাল্টি হয়ে গেলো শেষ পর্যন্ত বেদনার এক গোল। টাইব্রেকারে এসে কোকে এবং ইয়াগো আসপাসকে বাছাই করা হলো শট নেয়ার জন্য। ইসকো, কার্ভাহাল, বস্কুয়েটস, জর্দি আলবাদের মত খেলোয়াড়রা থাকতে বল তুলে দেয়া হলো কোকে এবং আসপাসকে। যারা গোলরক্ষকের ম্যুভমেন্ট না বুঝেই শট নেয়।
টাইব্রেকারে যাওয়ার আগে অতিরিক্ত সময়ের একেবারে শেষ মুহূর্তে একেবারে গোলমুখে ফেলে দেয়া হলো সার্জিও রামোসকে। রেফারি তাকালেনই না। তিনি ফাউল দিতে নারাজ। স্পেন খেলোয়াড়রা ভিএআরের আবেদন জানালেও রেফারি হয়তো ভিডিও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন; কিন্তু নিজে গিয়ে রেফারেলটা দেখলেন না। নিশ্চিত পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত করলেন রেফারি। তাতেই অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, রাশিয়ার পক্ষই বেশি নিয়েছেন রেফারি।
আইএইচএস/জেএইচ