খেলাধুলা

হলুদের সোনালী আশা

‘তিনজন মানুষ মারাকানাকে স্তব্ধ করে দিতে পেরেছিলেন। ফ্রাঙ্ক সিনাত্রা, পোপ এবং আমি’- বড় গর্বভরা এই কথাটি আলসিদেস ঘিগিয়ার। আর তা বলবেন না কেন? ১৯৫০ বিশ্বকাপের ট্রফি নির্ধারণী ম্যাচে তার গোলেই তো উরুগুয়ে ২-১ ব্যবধানে হারায় ব্রাজিলকে। তাতে আক্ষরিক অর্থেই নৈঃশব্দে ডুবে যায় মারাকানার দুই লাখ ব্রাজিলিয়ান সমর্থক! সঙ্গে পুরো দেশও।

Advertisement

ওই হারটি ছিল যুগের বাঁকবদলের ক্ষণ। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলকে নতুন করে খোঁজার উপলক্ষ্য। খোলনলচে পাল্টে শূণ্য থেকে শুরুর সময়। ‘মারাকানাসো’ ট্রাজেডির পর আগের জার্সি কী করে তাই রাখে ব্রাজিল!

হ্যাঁ, সেই অভিশপ্ত ফাইনালে আজকের এই হলুদ জার্সি ছিল না ব্রাজিলের। নীল কলারের সাদা জার্সির সঙ্গে সাদা শর্টস ও সাদা মোজা- এই ছিল সেদিন ‘সেলেসাও’দের পোষাক। উরুগুয়ের কাছে হারের পর সেটি চিত্রিত দেশপ্রেমহীন পরিচ্ছদ হিসেবে। সেখানে ব্রাজিলের জাতীয় পতাকার প্রতিনিধিত্ব ছিল না বলে। পতাকার সবুজ রঙে যে বিশাল বনভূমির ছাপ, সোনালী হলুদে যে খনিজ সম্পদের চিহ্ন, নীল পৃথিবী ও সাদা তারায় যে আকাশ-মহাকাশের প্রকাশ- এর কিছুই তো ব্রাজিলের জার্সিতে নেই!

ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের অনুমোদনে তাই ১৯৫৩ সালে ‘কোরিয়েরো দা মানহা’ নামের সংবাদপত্র এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। ব্রাজিলের নতুন জার্সির ডিজাইন আহ্বান করে। শর্ত একটাই- ব্রাজিলের পোশাকে হলুদ-নীল-সবুজ-সাদা এই চারটি রঙই শুধু থাকতে পারবে। বিজয়ী ডিজাইনের জার্সি পরে ব্রাজিলের ১৯৫৪ বিশ্বকাপ খেলার সিদ্ধান্তও হয়ে গেল।

Advertisement

‘মারাকানাসো’র চেয়ে ‘মিনেইরাসো’ ট্রাজেডি কম নয়! ১৯৫০ সালে ঘরের মাঠে ট্রফি ছোঁয়ার দূরত্বে উরুগুয়ের কাছে ১-২ গোলে হার আর ২০১৪ আসরে সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ১-৭ গোলে উড়ে যাওয়া। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে সবচেয়ে বড় দুই বিপর্যয়ে সমান্তরালে প্রবাহিত এ দুটো অধ্যায়। এবার কিন্তু সেবারের মতো জার্সি বদলে খেলতে নামছে না ব্রাজিল। হলুদ জার্সিতেই সোনালী সাফল্যের সন্ধান করবে তারা আবার। আরো একবার।

’৫০-এর ভূত তাড়াতে আট বছর লেগেছিল ব্রাজিলের।’ ১৪-র অভিশপ্ত রাতকে মুছে দেবার জন্য চার বছর কী যথেষ্ট?

ব্রাজিল কিন্তু আশায় রয়েছে। বড্ড আশায়। লিওনার্দো বাচ্চি তিতের অধীনে পাওয়া যাচ্ছে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের স্বর্ণসময়ের সৌরভ। রাশিয়া বিশ্বকাপে ফেভারিটদের তালিকায় ‘সেলেসাও’দের না রেখে তাই উপায় কী!

মারাকানা বিপর্যয়ের পর শূন্য থেকে শুরু করেছিল ব্রাজিল। মিনেইরাসো ট্রাজেডির পর তা করেনি। সেটি কেবল জার্সি বদলে নয়; সামগ্রিক মানসিকতায়ও। নইলে কিভাবে কার্লোস দুঙ্গার মতো একজনের হাতে ব্রাজিলকে তুলে দেয় আবার! সেই দুঙ্গা, যার অধীনে ২০১০ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে মুখ থুবড়ে পড়ে দল। সেই দুঙ্গা, যার সময়ে ‘জোগো বোনিতো’র চূড়ান্ত মৃত্যু হয় বলে জনমানসের রায়।

Advertisement

ফল যা হবার, হলো তাই। ব্রাজিল না পারে সৌন্দর্য পিপাসুদের মন জয় করতে; না পারে সাফল্য বুভুক্ষুদের তৃষ্ণা দূর করতে। ২০১৫ কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনালে আটকে যায় দুঙ্গার দল। আর পরের বছরের মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের আসরে তো গ্রুপ পর্বই পেরোতে পারে না। ওদিকে লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের এক তৃতীয়াংশ শেষে পড়ে থাকে পয়েন্ট টেবিলের ছয় নম্বরে। ১৯৭০-র বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের ফরোয়ার্ড তোস্তাওদের আশঙ্কা তখন সত্যি হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল, ‘জার্মানির কাছে ১-৭ গোলের হারেও কিছু বদলায়নি, ব্রাজিল একবার বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন না পারলে যদি আমাদের ফুটবল-সংস্কৃতি পাল্টায়!’

তখনই ফুটবলের সবুজ মঞ্চে আবির্ভাব লিওনার্দো বাচ্চির, যার আদুরে নাম তিতে। তবে তিনি যে ব্রাজিলের পতনোন্মুখ ফুটবল-রথ নিয়ে অমন জাদুকরের ভেলকিতে ময়ূরপঙ্খির উড়াল দেবেন, অতোটা ভাবা যায়নি।

তিতের নামডাক করিন্থিয়ান্সের কোচ হিসেবে। আর পরিচিতি রক্ষণাত্মক ধাঁচের কৌশলের কারণে। করিন্থিয়ানসকে ব্রাজিলিয়ান লিগ জিতিয়েছেন, কোপা লিবের্তাদোরেস জিতিয়েছেন, ক্লাব বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন। সবই আঁটোসাঁটো রক্ষণের কৌশলে। ২০১২ সালে একবার ব্রাজিল কোচ হবার দৌড়ে ছিলেন, ফেডারেশন ফিরিয়ে আনে ২০০২ বিশ্বকাপজয়ী কোচ লুই ফেলিপে স্কলারিকে। ২০১৪ বিশ্বকাপ-বিপর্যয়ের পরও আশায় ছিলেন; এবার কর্তারা সময়ে পিছু হেঁটে দ্বারস্থ হন দুঙ্গার। আর সেই দুঙ্গার কলঙ্কিত সময়ে যখন শরবিদ্ধ ব্রাজিল, তখন তিতে-শরণ ছাড়া আর উপায় থাকে না।

বার্সেলোনার দায়িত্ব ছাড়ার পর ফুটবল থেকে আত্ম-নির্বাসনে ছিলেন পেপ গার্দিওলা। তিতেও তাই, তবে তা ইউরোপিয়ান ফুটবলকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য। সময় কাটিয়েছে আর্সেনাল ক্লাবে আর্সেন ওয়েঙ্গারের সঙ্গে, রিয়াল মাদ্রিদে কার্লো আনচেলত্তির সাহচর্যে। তাতেই নিজের রক্ষণাত্মক ধাঁচের ফুটবল-দর্শন থেকে বেরিয়ে আসেন তিতে। তবু এ কথা বলার উপায় নেই, বর্তমানের ব্রাজিল ১৯৭০ বা ১৯৮২-র দলের মতো সৌন্দর্যের ফুট ফোটায়। তবে দুই যুগ ধরে কাউন্টার অ্যাটাকের মোহাচ্ছন্ন ‘সেলেসাও’রা আবার ফিরেছে পাসিং ফুটবলে। ’৮০-র দশকের ব্রাজিলের পর এমন পাসিং ফুটবল আর কোনো ব্রাজিল খেলেনি বলে বিশেষজ্ঞদের রায়।

আর এ সৌন্দর্য কেবল দর্শক বিনোদনের নিমিত্তে নয়, জয়ের ঐশ্চর্যেও গর্বিত। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ছয় ম্যাচ শেষে ছয় নম্বরে থাকা দলটির দায়িত্ব নিয়ে টানা ৯ ম্যাচ জিতিয়েছেন তিতে। ১৯৭০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে হোয়াও সালদানিয়ার টানা ছয় ম্যাচ জেতার রেকর্ড ছাপিয়ে গেছেন। চার ম্যাচ হাতে রেখে নিশ্চিত করেছেন ব্রাজিলের বিশ্বকাপ খেলা। আর তা স্বাগতিক রাশিয়া বাদ দিয়ে পুরো বিশ্বের প্রথম দল হিসেবে।

পেছনে ‘৭-১ গোলের ভূত’ তাড়া করলেও সেটি তাড়ানোর জন্য এই ব্রাজিলের ওপর তাই আস্থা রাখছেন সমর্থকরা। যেখানে সবচেয়ে বড় ভরসার নাম নেইমার। ২০১৪ বিশ্বকাপেও তাই ছিলেন, তবে তখন তিনি অপরিণত এক তরুণ। তার উপর কোয়ার্টার ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে এমন ইনজুরিতে পড়লেন যে, শেষ হয়ে যায় বিশ্বকাপ। এবারও ইনজুরির কারণে ফেব্রুয়ারির পর থেকে মাঠের বাইরে। তবে সেটি ‘শাপে বর’ও হতে পারে। ক্লাব ফুটবলের ক্লান্তি তো কাবু করতে পারবে না। প্রত্যাবর্তনের কক্ষপথে থাকা পরিণত নেইমারের সামনে তাই চ্যালেঞ্জ নিজেকে পেলে, গ্যারিঞ্চা, রোমারিও, রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহোদের সমপর্যায়ে তুলে নেবার। বিশ্বকাপজয়ী হবার।

আগের বিশ্বকাপে খুব বেশি নেইমার নির্ভরতা ছিল ব্রাজিলের। তাকে ছাড়া তাই জার্মানির বিপক্ষে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে দল। দুঙ্গাও সে নির্ভরতা কমাননি বরং বাড়িয়েছেন ক্রমশ। তার সময়ে খেলা ম্যাচগুলোয় ১১ গোল করে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোলদাতা নেইমার; দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ফিলিপে কৌতিনহোর চার। ‘নেইমারডিপেনডেনসিয়া’ শব্দটি তখনই জেঁকে বসে ব্রাজিল ফুটবলে।

তিতে এসে সে চাপ সরিয়ে নিলের নেইমারের উপর থেকে। মনোযোগ দিলেন দলীয় সমন্বয়ে। এ কোচের অধীনে খেলা ১৯ ম্যাচে ব্রাজিলের সেরা খেলোয়াড় নিঃসন্দেহে নেইমার, তবে সর্বোচ্চ গোলদাতা তিনি নন। এখন গ্যাব্রিয়েল হেসুস রয়েছেন, কৌতিনহো আছেন, পউলিনহো রয়েছেন। তিতের অধীনে সর্বোচ্চ ৯ গোল জেসুসের; সাতটি করে গোল নেইমার-পউলিনহোর, পাঁচ গোল কৌতিনহোর। চাপ নেই বলে প্রজাপতির স্বচ্ছন্দ্যে অ্যাটাকিং থার্ডে উড়তে পারছেন নেইমার। তাতে গোলসংখ্যা কিছু কমলেও ব্রাজিলের সামগ্রিক খেলার উন্নতিটা চোখে পড়ার মতো।

তিতের আরেক বড় আবিষ্কার হেসুস। অনেকদিন ধরেই একজন সত্যিকারের ‘নাম্বার নাইন’ খুঁজছিল ব্রাজিল। রোমারিও, রোনালদোদের দেশের মূল স্ট্রাইকার গত দুই বিশ্বকাপে কি না লুইস ফ্যাবিয়ানো ও ফ্রেডের মতো গড়পড়তারা। সে গ্রহণকাল পেরিয়ে এবার ত্রাতা হয়ে হেসুসের আলো। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ব্রাজিলের সর্বোচ্চ গোল তার, তিতের অধীনে খেলা ম্যাচগুলোয়ও। গোলের জন্য তাই অন্তত রাশিয়ায় হা-পিত্যেশ করতে হবে না সেলেসাওদের।

একাদশ নিয়েও খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিছু আর নেই। গোলবারের নীচে অ্যালিসন তো এখন বিশ্বসেরাদের কাতারেই; দ্বিতীয় পছন্দের এদেরসনও পিছিয়ে নেই। সেন্ট্রাল ডিফেন্সে থিয়াগো সিলভা, মারকুনিয়োস ও মিরান্দার মধ্যে খেলবেন দুজন। লেফট ব্যাকে মার্সেলো। রাইট ব্যাকে দানি আলভেসের ইনজুরিতে সুযোগ এসেছে দানিলোর সামনে। মিডফিল্ডে ‘ডাবল পিভোট’-এর দিন পেরিয়ে এসেছে তিতের ব্রাজিল। কাসেমিরো, পউলিনহো, ফের্নান্দিনহো, রেনাতো আগুস্তের মধ্যে তিনজন খেলবেন এখানে। ফরোয়ার্ড লাইনে নেইমার, হেসুস, কৌতিনহো। প্রয়োজেন রবের্তো ফিরমিনো, উইলিয়ান, ডগলাস কস্তারা উঠে আসবেন বেঞ্চ থেকে।

এই দলের সামনে এখন অমরত্বের হাতছানি। তিতের সামনে সুযোগ ব্রাজিলিয়ানদের হৃদয়ের সিংহাসনে চিরস্থায়ী জায়গা করে নেবার। বিশ্বকাপে মাঠের ফুটবলে অনেক কিছুই ঘটতে পারে সত্য। তবে কাগজ-কলমের হিসেবে ব্রাজিলিয়ানদের আশার আকাশটা বড় হচ্ছে দিন দিন। প্রতি দিনই।

আর ওই হলুদ জার্সিধারীরা যদি সোনালী ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরতে পারেন ১৫ জুলাই, তাহলে ফুটবলদেবতারও যে দায়শোধ হবে কিছুটা। ’৫০-এর দায়মোচন যেমন ’৫৮-তে; তেমনি কি ’১৪-র হাহাকার ঘুচবে ’১৮-তে!

আইএইচএস/পিআর