খেলাধুলা

বিরল রেকর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মুলার

জার্মানি এমনিতেই থাকে তারকায় ঠাসা। যে কারণে প্রতিটি বিশ্বকাপে তারা খেলতে আসে শাশ্বত ফেবারিটের তকমা নিয়ে। তারকাভর্তি টাইটানিক হলেও সবার মাঝে আলাদা একটি জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন থমাস মুলার। নিজেকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছেন, তিনি যেখানে তার আগে রয়েছেন কেবল মাত্র দু’জন ফুটবলার। একজন তারই স্বদেশি মিরোস্লাভ ক্লোসা এবং অন্যজন পেরুর ফুটবলার তিওফিলো কিউবিলাস।

Advertisement

বিশ্বকাপের ইতিহাসে কেবলমাত্র তিনজন ফুটবলার টানা দুই বিশ্বকাপে ৫টি করে গোল করেছেন। ক্লোসা, কিউবিলাসের পর সর্বশেষ এই তালিকায় ২০১৪ সালেই নাম লিখে নিয়েছিলেন থামস মুলার। এবার তার সামনে দারুণ একটি রেকর্ড গড়ার সুযোগ। স্বদেশি ক্লোসা এবং কিউবিলাসকে ছাড়িয়ে গিয়ে টানা তিন বিশ্বকাপে ৫টি করে গোল করতে পারলেই ফুটবলের ইতহাসে নতুন একটি অধ্যায় যোগ করে ফেলবেন তিনি। যেখানে থাকবে শুধুমাত্র মুলারেরই নাম।

২০১০ বিশ্বকাপের আগে হঠাৎ করেই ইনজুরিতে পড়ে যান মাইকেল বালাক। জার্মান ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকার ইনজুরিতে মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা দেশটির সমর্থকদের। বিশ্বকাপে কী করবে তাহলে জার্মানি। বালাকের পরিবর্তে জার্মান দলে নিয়ে আসা হয় তখন তিন তরুণ তুর্কিকে। মেসুত ওজিল, স্যামি খেদিরা এবং থমাস মুলার।

এক বালাকের স্থান পূরণ করতে জার্মানি যেন তাদের ভবিষ্যৎ তারকাদেরই পেয়ে গিয়েছিল সেবার। মূলতঃ বালাকের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য নেয়া হয় মুলারকেই। সেবার বিশ্বকাপের ২৭ জনের প্রথামকি স্কোয়াডে নাম থাকলেও মুলারের ২৩ জনের স্কোয়াডে থাকা নিয়ে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল। শেষ পর্যন্ত তার কপাল খুলে দেয় বালাকের ইনজুরি। দলে ডাক পেয়েই বালাকের ১৩ নাম্বার জার্সিটাই পেয়ে যান তিনি। ১৩ নাম্বার জার্সিটা পরতেন গার্ড মুলারও।

Advertisement

এরপর বিশ্বকাপে তো বাজিমাত করলেন তিনি। করলেন ৫ গোল। পেলেন গোল্ডেন বুট। নির্বাচিত হলেন বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান ফুটবলার। এরপর ২০১২ ইউরোতেও খেললেন। যদিও সেমিফাইনালে ইতালির কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় তাদের।

তবে বিশ্বকাপের আগেই জার্মানি জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন মুলার। তাও নানান নাটকের পর। ২০০৯ সালের অক্টোবরে প্রথম তাকে জাতীয় দলে ডেকে নেন কোচ জোয়াকিম লো। যদিও এ নিয়ে তার ক্লাব বায়ার্ন মিউনিখ রাজি ছিল না মুলারকে ছাড়তে। শেষ পর্যন্ত আইভরি কোস্টের বিপক্ষে প্রীতি ম্যাচে খেলার জন্য নির্বাচিত হন তিনি।

তবে ওই সময় ২০১১ অনুর্ধ্ব-২১ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাই পর্বে জার্মানির অবস্থা খুবই করুণ হয়ে পড়ে। যে কারণে জাতীয় দলের কোচ লো এবং অনুর্ধ্ব-২১ দলের কোচ রেইনার আদ্রিওন মিলে সিদ্ধান্ত নেন মুলারকে অনুর্ধ্ব-২১ দলে পাঠিয়ে দেয়ার। আন্তর্জাতিকে অভিষেক হওয়ার আগেই মুলার ফিরে যান অনুর্ধ্ব-২১ দলে। ফলে, জাতীয় দলের হয়ে অভিষিক্ত হতে অপেক্ষা করতে হয় উদীয়মান এই ফুটবলারকে।

২০১০ সালের জানুয়ারিতে আবারও মুলারকে ডেকে নেন লো। আর্জেন্টিনার বিপক্ষেই প্রীতি ম্যাচে আন্তর্জাতিক ফুটবলে খেলার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। ৬৬ মিনিটের সময় ওই ম্যাচে অভিষেক হওয়া টনি ক্রুসের পরিবর্তে মাঠে নামেন তিনি। ওই ম্যাচে আর্জেন্টিনার কাছে ১-০ গোরে হেরেছিল জার্মানি।

Advertisement

এরপরে তো বিশ্বকাপেই ডাক পেয়ে গেলেন তিনি এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচ থেকেই সেরা একাদশে থাকার সুযোগ পেয়ে যান। সেই সুযোগকে এমনভাবে কাজে লাগালেন মুলার, যাতে জোয়াকিম লো তাকে আর বাদই দেয়ার চিন্তা করতে পারেননি। প্রথম ম্যাচেই সকারুজদের বিপক্ষে গোল করেন মুলার। যেটা ছিল আবার আন্তর্জাতিক ফুটবলে তার প্রথম গোলও বটে।

দ্বিতীয় রাউন্ডে নিজেকে আরও ভালোভাবে মেলে ধরেন মুলার। ইংল্যান্ডের মত শক্তিশালী দলের বিপক্ষে করেন জোড়া গোল। কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের তৃতীয় মিনিটেই গোল করে বসেন মুলার। টুর্নামেন্টে ওটা ছিল তার চতুর্থ গোল। যদিও হ্যান্ডবল করার অপরাধে লাল কার্ড দেখে মাঠ থেকে বের হয়ে যেতে হয়েছিল তাকে এবং সেমিফাইনালে স্পেনের বিপক্ষে খেলতে পারেননি তিনি। উরুগুয়ের বিপক্ষে তৃতীয়স্থান নির্ধারণী ম্যাচে আবারও দলে ফেরেন এবং টুর্নামেন্টে ৫ম গোল করেন তিনি।

৫ গোলের সঙ্গে ৩টি অ্যাসিস্ট। সমান ৫টি করে গোল করেও ডেভিড ভিয়া, ওয়েসলি স্নেইডার এবং দিয়েগো ফোরলানের চেয়ে এগিয়েছিলেন এবং জিতে নেন গোল্ডেন বুটের পুরস্কার। মূলতঃ ২০০০ সালের ইউরোয় ভরাডুবির পর জার্মান ফুটবল ফেডারেশন ভিন্ন একটি উদ্যোগ নিয়েছিল। যে উদ্যোগের কারণে পুরনো চিরাচরিত ফুটবল স্টাইল ছেড়ে অ্যাটাকিং ফুটবলের ধারণায় চলে আসে তারা। নতুন নতুন প্রতিভা খুঁজে বের করা হয়। সেই খুঁজে বের করা প্রতিভারই একজন হলেন মুলার।

২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপ মুলারের জন্য স্মরণীয়। কারণ, দেশকে তিনি উপহার দিয়েছেন বিশ্বকাপ শিরোপা। টুর্নামেন্টের শুরুতেই, পর্তুগালের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করে বসেন জার্মানির এই সেরা তারকা। গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও করলেন এক গোল। সেবার সেমিফাইনালে ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে হারানোর ম্যাচে প্রথম গোলটাও করেছিলেন তিনি।

পেরুভিয়ান তিওফিলো কিউবিলাস এবং স্বদেশি মিরোস্লাভ ক্লোসার সঙ্গে নাম উঠে যায় তখনই। সে সঙ্গে জার্মান ফুটবলারদের মধ্যে ১০ গোল নিয়ে হেলমুট রানের সঙ্গে নাম লেখান কিনি। বিশ্বকাপ জেতার পর টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সেরার (সিলভার বল) পুরস্কার ওঠে মুলারের হাতে। হলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতাও।

পজিশনিং, টিম ওয়ার্ক আর দুর্দান্ত স্ট্যামিনার জন্য সবজায়গায় প্রশংসিত মুলার। শুধু তাই নয়, নিজে গোল করা এবং অন্যকে দিয়ে গোল করানোয়ও যেন তার বিকল্প নেই। ২০০৯-১০ মৌসুমে লুই ফন গাল বায়ার্নের কোচ হওয়ার পর মুলারের গুরত্ব বেড়ে যায়। প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই খেলেন তিনি। ক্লাবকে উপহার দেন বুন্দেসলিগা এবং লিগ কাপ। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালেও উঠেছিল তারা।

২০১২-১৩ মৌসুমে বায়ার্ন মিউনিখ যে ঐতিহাসিক ট্রেবল জিতেছিল, তার অন্যতম রূপকার ছিলেন থমাস মুলার। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, বুন্দেসলিগা এবং লিগ কাপ। বায়ার্নের হয়ে তার নিজের ক্যারিয়ারে শুধুমাত্র ২০১১-১২ মৌসুমের লিগটা জিততে পারেননি। এছাড়া মোট ৭টি এবং টানা ৬টি লিগ শিরোপা জিতেছেন তিনি। জিতেছেন একটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা। এক ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপছাড়া আর কোনো ট্রফি নেই, যেটা জিততে পারেননি মুলার।

মূলতঃ বায়ার্ন মিউনিখের ইয়থ একাডেমি থেকে উঠে এসেছেন মুলার। ওয়েলহেইমে জন্ম। ২০০০ সালে মাত্র ১০ বছর বয়সেই বায়ার্নের ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি হন। অনুর্ধ্ব-১৯ বুন্দেসলিগার ২০০৭ সালে তার হাত ধরে রানারআপ হয়েছিল বায়ার্ন। তখন থেকে নিয়মিতই বায়ার্নের অনুর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলতে থাকেন। অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়ে নিজেকে দলের মূল খেলোয়াড়ে পরিণত করেন তিনি।

তখনকার বায়ার্নের কোচ ইয়ুর্গেন ক্লিন্সম্যান মুলারকে নিয়ে আসেন সিনিয়র দলে। ২০০৮ সালেই ক্লিন্সম্যান পেশাদার ফুটবলে অভিষেক ঘটিয়ে দেন মুলারের। হামবুর্গের বিপক্ষে মিরোস্লাভ ক্লোসার পরিবর্তে মাঠে নামেন তিনি। পরের বছর, মার্চেই চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অভিষেক হয় জার্মান এই তারকার।

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বায়ার্নের সিনিয়র দলের হয়ে খেলার জন্য দুই বছরের চুক্তি করে ফেলেন মুলার। কিন্তু মাত্র তো দুই বছর নয়, মুলার এমন এক ফুটবলার, যাকে বলা হয় ওয়ান টিম ম্যান। বার্সেলোনায় মেসি, ইনিয়েস্তার মতই- এক ক্লাবে বেড়ে ওঠা এবং সেই ক্লাবের হয়েই ক্যারিয়ার শেষ করে ফেলা। থামস মুলার শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত বায়ার্নের মূল খেলোয়াড় হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়েছেন।

বায়ার্নের হয়ে এখনও পর্যন্ত সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪৩৬ ম্যাচ খেলে ১৭৬ গোল করেছেন তিনি। মুলার এমন ধরনের ফুটবলার, যে তাকে কোচ চাইলে যে কোনো পজিশনেই খেলাতে পারেন। এমনিতেই ফরোয়ার্ডেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন তিনি। সঙ্গে মিডফিল্ড, অ্যাটাকিং মিডফিল্ড, সেকেন্ড স্ট্রাইকার, সেন্টার ফরোয়ার্ড কিংবা উইংয়েও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন তিনি। এ কারণেই তাকে বলা হয় বহুমাত্রিক ফুটবলার।

রাশিয়া বিশ্বকাপেও জোয়াকিম লোর প্রধান অস্ত্র থমাস মুলার। জেনুইন কোনো স্ট্রাইকার না থাকার কারণে জার্মান দলটির মধ্যে মুলারের গুরুত্ব আরও বেশি। তবে তার চেয়েও মুলারের সামনে টানা তিন বিশ্বকাপে ৫টি কিংবা তারও বেশি গোল করার রেকর্ড গড়ার দারুণ সুযোগ। সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারেন কি না এখন সেটাই দেখার বিষয়।

আইএইচএস/জেআইএম