দেশজুড়ে

৩৩ বছরে ১৮ হাজার রোগী বহন করেছেন তিনি

‘১৯৭৮ সালের ঘটনা। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় শহরের পুরাতন রেজিস্ট্রি পাড়ার এক লোককে অসুস্থ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি। অসুস্থ ব্যক্তিটিকে কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাই। তাকে সহযোগিতার মাধ্যমেই আমার মনে সাধ জাগে মানুষের সেবা করার।’ কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে ৩৩ বছর ধরে অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে কর্মরত একেএম ফজলুল হক।

Advertisement

ফজলুল হকের বাড়ি কুড়িগ্রাম শহরের পৌরসভার কৃষ্ণপুর গ্রামে। বাবা মৃত মহির উদ্দিন। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে ৪র্থ তিনি। ১৯৬১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। চালকের প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৮৫ সালে যোগদান করেন কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসেবে। তার সংসার জীবনে স্ত্রীসহ দুই ছেলে ও এক মেয়ে এবং নাতী-নাতনী রয়েছেন।

ফজলুল হক চাকরির ৩৩ বছরে জেলার উলিপুর, রাজারহাট, চিলমারী এবং কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালে কাজ করেছেন। কর্ম জীবনে প্রায় ১৮ হাজার রোগী বহন করেছেন তিনি। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ফজলুল হক বলেন, চাকুরিতে যোগদানের পর সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩ বার কুড়িগ্রাম সফরের সময় দায়িত্ব পালন করেছেন।

ফজলুল হক জানান, কোনো গুরুতর রোগীকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ কিংবা ঢাকায় পৌঁছে দেয়ার পর একটি জীবন বাঁচাতে সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারায় তৃপ্তি পান অনেক। তার গাড়িতে কোনো রোগীর মৃত্যু হলে বা পৌঁছানোর পরে যদি শুনতে পান সেই রোগী মারা গেছে তখন অনেক বেদনায়ক হয়ে ওঠে সেই সময়গুলো।

Advertisement

কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতাল থেকে গুরুতর কোনো রোগীকে দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে যার নাম উঠে আসে তিনি হলেন অ্যাম্বুলেন্স চালক ফজলুল হক। সাংসারিক জীবনে যে অবস্থায় থাকেন না কেন কোন মুমূর্ষু রোগীকে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনলেই ছোটেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে অবিরাম ছুঠে চলেছেন ফজলুল হক।

স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ২০০৭ অথবা ২০০৮ সালের দিকে তারই সহকর্মী কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন অফিসের প্রজেক্ট ড্রাইভার স্ট্রোক করেন। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়ার সময় রংপুরের নবীগঞ্জ বাজারে অ্যাম্বুলেন্সের দুটি চাকা পর্যায়ক্রমে পাংচার হয়ে যায়। দ্রুত সেগুলো ঠিক করে রোগীকে রংপুরে পৌঁছানোর পর চিকিৎসা পেয়ে বেঁচে যান।

কর্মজীবনে তার কষ্টদায়ক একটা দিন ছিল ২০১৫ সালে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কুড়িগ্রাম সফরে আসেন। বিকেলে তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ মাঠে জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখার জন্য বের হন। এ সময় গাড়ি বহরে থাকা একজন চালক হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। সেই মুহূর্তটা তার মনে এখনও দাগ কাটে।

তিনি বলেন, দীর্ঘ ৩৩ বছরে আজ পর্যন্ত দায়িত্বে অবহেলা কিংবা কোনো ধরনের অভিযোগ ওঠেনি আমার বিরুদ্ধে। চাকরির বাকি সময়টা রোগীর সেবা আর নিজের কাজের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে অবসরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এই দক্ষ অ্যাম্বুলেন্স চালক।

Advertisement

কুড়িগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম জানান, জেলার প্রায় ২২ লক্ষাধিক মানুষের জন্য কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতাল। এই সদর হাসপাতালসহ ৯টি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০টি অ্যাম্বুলেন্সে ১০ জন চালক রয়েছেন। তারা নিয়মিতভাবে রোগীদের সেবা নিশ্চিত করছেন। তাদের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স চালক ফজলুল হক সিনিয়র ও দক্ষ। তিনি সৎ-নিষ্ঠার সঙ্গে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন। তার দায়িত্ব নিয়ে লিখিত কিংবা মৌখিক কোনো অভিযোগ আসেনি আমার কাছে।

নাজমুল হোসেন/এফএ/এমএস