বাণিজ্য গুরুত্ব পেলে বইয়ের মেলার মান থাকে না- এমনটিই মনে করেন লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে তো অন্য কোনো বিষয়ের তুলনা চলে না। মানুষ আত্মার বিকাশ ঘটায় শিল্প বা সাহিত্যের ওপর ভর করেই। সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্নয়নে বইয়ের তো কোনো বিকল্প থাকতে পারে না।’
Advertisement
বইমেলা আয়োজনের উদ্দেশ্য, সার্থকতা ও শিল্প-সাহিত্যের মান নিয়ে সম্প্রতি মতামত ব্যক্ত করেন জাগো নিউজ-এর কাছে।
মেলার আয়োজনের প্রসঙ্গ নিয়ে গুণী এই লেখক বলেন, বইয়ের মেলা ঠিক আর দশটি মেলার সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এর আয়োজন, এখানে অংশগ্রহণকারীর চিন্তা-চেতনা ঠিক আলাদাই হওয়ার কথা। বইয়ের কাছে গেলেই তো অস্থির মন স্থির হবে। মেলা প্রাঙ্গণের পরিবেশ শান্ত হবে এবং একটি বিশেষ মেজাজ তৈরি করবে। আমাদের এখানে তা ঠিক হতে পারল না। অন্য আর দশটি পণ্যের মেলার মতোই রূপ নিল আমাদের একুশে বইমেলা।
বইয়ের মেলা জমে ওঠে বসন্তবরণ বা বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে। এমনটি কি হওয়ার কথা। যারা ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন, তারা কিন্তু ভাষার মর্যাদা এমনভাবে চাননি। বাণিজ্যিক ধারণায় প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে বইয়ের মেলা। শিল্প-সাহিত্যের বিকাশে এই ধারণা কখনই শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। শিল্পের বিকাশে বাণিজ্য মুখ্য হলে তাকে আর শিল্প বলে না।
Advertisement
বইমেলার আয়োজনের সার্থকতা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন এই লেখক। তিনি বলেন, বইমেলা হচ্ছে জ্ঞানের জায়গা। বছরের পর বছর ধরে মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। মাসব্যাপী বইমেলায় লাখ লাখ মানুষ আসে। শত শত বই প্রকাশিত হয় প্রতিবছর। তাতে কি এমন দাঁড়ালো? কী জ্ঞান বিকশিত করতে পারলো, আয়োজকরা? যারা আসছেন, তাদের বেশির ভাগই তরুণ। তরুণদের জ্ঞানের পরিধি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা ছাড়া আর কী মিলল? অথচ এই তরুণদের ওপরেই জাতিকে কোনো না কোনোভাবে নির্ভর করতে হয়।
‘কেন এই পরিস্থিতি’ তার ব্যাখ্যা স্বরুপ তিনি বলেন, জ্ঞানের পরিধি সংকোচিত হওয়ার নানাবিধ কারণ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দিকে তাকালেই সমাজের সব বিষয় সামনে আসবে। আগে শিক্ষার্থীরা জ্ঞান চর্চা করত বিশেষ অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে। এখন সবাই যেন উপরিতলের বিষয় নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। কোনো গভীরতা নেই। এই পরিস্থিতির অন্যতম কারণ হচ্ছে সমাজের ভাবুকদের ভাবনার নিম্নগামিতা। সিরিয়াস বিষয়ে তারা আর বই লিখতে চাইছেন না কেউ-ই। শত শত বই প্রকাশ হচ্ছে মেলায়। বলুন তো, কোন বইটি নিয়ে গভীর আলোচনা করা যায়? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও আর জ্ঞানের জগতে নেই। কোনোমতে পাস করে চাকরির পেছনে ছুটতেই তাদের জীবন শেষ। সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের পড়ুয়াদের যদি এই হাল হয়, তাহলে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র সহজেই অনুমেয়।
মূলত শিল্প-সাহিত্যের রাজনীতি একাকার হয়ে গেলে যে সর্বনাশ হওয়ার কথা, এখন তাই দেখছি। এর পেছনে রাষ্ট্র কাঠামো, সমাজই প্রধানত দায়ী, বলেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
গণমাধ্যমের দায় নিয়ে তিনি বলেন, গণমাধ্যমগুলোও ভঙ্গুর রাষ্ট্র কাঠামোর তলপিবাহক হিসেবে কাজ করছে। বইমেলা বা বইয়ের খবর নিয়ে প্রকাশিত খবরগুলো দেখলেই সব ধারনা পাওয়া যায়। ‘জমে ওঠেছে মেলা’, ‘ভালোবাসা দিবসের মেলা’, ‘ভাষার মাসের বইমেলা’ এমন শিরোনামে খবর আসে। যেন গরুর হাটের খবর।
Advertisement
বইমেলা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, শত শত লোক মেলায় আসছে। যেন উৎসব শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু বই কিনছে না মানুষেরা। ভালো বইয়ে চোখ নেই। স্বজনপ্রীতি, পরিচিতজনের মাধ্যমেই বেচাকেনা হচ্ছে। এই ধারণাই তো ভাষা-সংস্কৃতির বিকাশে অন্তরায়।
শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ ঘটাতে সবার আগে রাষ্ট্র কাঠামোর দিকে নজর দিতে হবে। এই কাঠামো রেখে আসলে একটি জাতিসত্তা দাঁড়াবে কিনা, তার দিকে নজর দিতে হবে। আর এ জন্যই জ্ঞান চর্চা জরুরি, যা বই এবং বইমেলা থেকে আহরণ করার ছিল। আমরা ঠিক বইমেলাকে সেই জায়গাতে নিতে পারিনি, মনে করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
এএসএস/এআরএস/জেআইএম