মতামত

বিরোধীকণ্ঠ কি আসলেই রুদ্ধ?

বাংলাদেশে বিরোধীকণ্ঠ রুদ্ধ কিনা এই প্রশ্ন নিয়ে বেশ অনেকদিন ধরেই কথা শুনি এবং ভাববার চেষ্টা করি। গণমাধ্যমের প্রকৃত স্বাধীনতা বলতে কোনো বস্তু আছে কিনা তা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষকগণই বহুবিধ প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে তথাকথিত উন্নত গণতন্ত্রের দেশ বলে আমরা যাদেরকে চিনি সেসব দেশে গণমাধ্যম কতোটা স্বাধীন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে ইরাক যুদ্ধে ব্রিটেনের যোগদান নিয়ে সংবাদ প্রচারে বিবিসি টেলিভিশনের ওপর যে চাপ এসেছিল এবং এরপর উইকিলিকসসহ জুলিয়ান এ্যাসাঞ্জ-এর দুনিয়াজোড়া উন্মোচন ও এ কারণে তার স্বাভাবিক জীবন-যাপন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া সব মিলিয়ে পশ্চিমও যে নামকাওয়াস্তে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সমর্থ হয়েছে সেটা এখন আর কোনো গোপন বিষয় নয়, বরং সকলেই একথা জানেন এবং মানেন। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা কি?

Advertisement

আমরা কথায় কথায় স্বাধীন বাংলাদেশে বাকশাল সরকারের উদাহরণ দেই এবং বলতে চাই যে, মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে বাকি সব কাগজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ভাগ্যিস তখন কোনো টেলিভিশন ছিল না, বিটিভি ছাড়া। কিন্তু এ প্রশ্ন কেউ করি না যে, তখন সংবাদপত্র ছিল ক’টা। তারপরও যদি একটি সংবাদপত্র বন্ধ করা হয়ে থাকে তাহলে সেটিও নিন্দনীয়। সে সময়কার সরকারি মালিকাধীন বিচিত্রা’র দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, পত্রিকাটি কেবল সরকার-বিরোধীই ছিল না, পত্রিকাটি লাগাতার দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির উস্কানি দিয়ে গেছে।

পরবর্তীতে পত্রিকাটি অবৈধ মুশতাক সরকারের গুণগান থেকে দেশের প্রথম স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়ার সাক্ষাৎকারসহ তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছে। বলা যেতে পারে যে, যেহেতু সরকারি মালিকানার পত্রিকা সেহেতু যে সরকারই ক্ষমতায় থাক না কেন তাদেরকে সরকারের নির্দেশ মানতে হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সরকার পত্রিকাটির ওপর কোনোরূপ চাপ প্রয়োগ করেছিল বলে পত্রিকাটির তৎকালীন সম্পাদক/সাংবাদিক কোনো অভিযোগ এনেছেন বলে জানা যায় না। কিন্তু দু’দু’টি সামরিক শাসনের কালে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কোন্ অবস্থায় ছিল সে বিষয়ে যতো কম বলা যায় ততোই ভালো।

তারপর এলো নতুন গণতন্ত্রের যুগ। যে গণতন্ত্র এমন এক গণতন্ত্র যাতে স্বৈরাচারসৃষ্ট রাজনৈতিক দল দু’টি কেবলমাত্র প্রচারের কারণে এদেশে বৈধতা লাভ করেছে। এদেশের গণমাধ্যম তখন থেকেই একটা ‘নিরপেক্ষতার’র ভান্ ধরে মুড়ি-মুড়কির একদর করে ফেলে। একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসের অংশীদার, স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দলকে তুলনায় নিয়ে আসা হয় জেনারেল জিয়ার সৃষ্ট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে, যাদের জন্ম প্রক্রিয়া ও বেড়ে ওঠা সম্পূর্ণভাবে অনৈতিক, দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে এবং অ-রাজনৈতিক। সমস্যার শুরু সেখানেই। এক স্বৈরাচারকে হত্যার পর আরেক স্বৈরাচার ক্ষমতা দখল করলে প্রথম স্বৈরাচারের রাজনৈতিক দল যদি দ্বিতীয় স্বৈরাচারের রাজনৈতিক শক্তিকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর আন্দোলন করে তাহলে প্রথম স্বৈরাচারের স্বৈরাচারী ইতিহাস, নোংরামি, অত্যাচার, নির্যাতনের সত্যটা বদলে যায় না। কিন্তু বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সহযোগিতাতেই সেটা সম্ভব হয়েছে।

Advertisement

জেনারেল জিয়াকে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের জনক’ বানানোর তরে এদেশের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দেয়া হয়েছে। আজকে সকলেই যার মাশুল গুণছি আমরা। মজার ব্যাপার হলো, জেনারেল জিয়ার তৈরি এই রাজনৈতিক দলকে জায়গা করে দিতে গিয়ে জেনারেল এরশাদের রাজনৈতিক দলকেও যে এদেশে জায়গা করে দিতে হয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য। কারণ মানুষ জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদকে আলাদা করার মতো কোনো নিক্তির সঙ্গে পরিচিত নয়। দু’জনেই সেনা বাহিনী থেকে এসেছেন, দু’জনের বিরুদ্ধেই পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যার অভিযোগ আছে, দু’জনেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন, নতুন রাজনৈতিক দল খুলেছেন, দু’জনেই সেনা বাহিনীর ভেতরকার শৃঙ্খলা নষ্ট করে সেনা বাহিনীর রাজনৈতিকায়ন করেছেন এবং দু’জনেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানকে কচুকাটা করেছে এবং দু’জনেই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ এইসব শব্দকে যমের মতো ভয় পেতেন কিংবা ঘৃণা করতেন।

ফলে দুই জেনারেলে তৈরি রাজনৈতিক দলগুলি এদেশে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর লিগেসি বহন করবে সেটাই স্বাভাবিক, বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী গড়ে ওঠার কথা ছিল এদেশের গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, দেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে কিন্তু শুরুতেই তাদের ভেতর রাজনীতির জায়গা করে দেওয়ায় সে সুযোগ থেকে এই বাহিনীটি বঞ্চিত হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে বাহিনীটি সে দুর্নাম ঘুচিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই সে সফলতা অর্জন করেছে কিন্তু এখনও তাদের বিরুদ্ধে যায় এমন সংবাদ প্রকাশে কুণ্ঠিত এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রকাশিত সংবাদকে হত্যা করার চেষ্টা করে থাকে। গণমাধ্যমকে তখন নানাদিক থেকে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়, কারণ সাধারণ মানুষ সত্যটা জানলেও গণমাধ্যম সেটা তুলে ধরতে না পারাটা গণমাধ্যমের ব্যর্থতা হিসেবে নয়, দেখা হয় গণমাধ্যমের ওপর সরকারের চাপ হিসেবে।

আমরা দেখেছি যে, বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে প্রকৃত গণমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৬ সালের আওয়ামী লীগ সরকার টেরিস্টোরিয়াল লাইসেন্স দিয়ে একুশে টেলিভিশন চালু করার অনুমতি দেয়। কোনো ভাবেই এই টেলিভিশনকে সরকার-তোষণকারী কিংবা আপোসকামী মনে হওয়ার কোনো কারণ নেই। একই সঙ্গে একটি টেরিস্টেরিয়াল রেডিও চ্যানেলেরও অনুমোদন দেয় সরকার। একুশে টেলিভিশনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সাংবাদিকতাও নতুন মোড় নেয়। যে মোড়ে আমরা দেখি একদল ঝকঝকে তরুণ সাংবাদিক যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে রিপোর্টিং থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের প্রকৃত কর্মী হয়ে ওঠে। প্রতিষ্ঠান হিসেবেও একুশে টেলিভশন পথ দেখাতে শুরু করে গণমাধ্যমে। কিন্তু কী হলো?

২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে আদালতকে নিজের প্রয়োজনে এবং অত্যন্ত নোংরাভাবে ব্যবহার করে একুশে টেলিভিশনের সম্প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হয়ে সম্প্রচার বন্ধের কাজটি করেন। ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে যে তাণ্ডব চালায় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার তার সচিত্র প্রমাণ থাকার কারণেই একুশে টেলিভিশনের ওপর সরকার ক্ষিপ্ত হয় যদিও একুশে টেলিভিশনে কর্মরত সাংবাদিক বন্ধুরাই বলেন যে, ঘটনা যা ঘটেছিল তার কিয়দংশও একুশে টেলিভিশন দেখানোর সাহস করেনি। তার মানে বাঙালির সেই দুঃসময়ের কথা আসলে এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভাবে জানা যায় না।

Advertisement

এ নিয়ে কোনো গবেষণাও হয়েছে বলে জানিনে। কিন্তু একুশে টেলিভিশনেরই এক সাংবাদিক বন্ধু আক্ষেপ করে বলেছেন যে, সেই যে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ৯-তলা থেকে নামানো হলো আর তারা ওপরে ওঠার সুযোগই পাচ্ছে না। সত্যিই তাই, কারণ এখন আর এদেশে টেরিস্টেরিয়াল টিভি/রেডিও চ্যানেল কল্পনাও করবে না কেউ। নতুন টেলিভিশন চ্যানেলগুলির প্রতি সম্মান রেখেই বলছি তারা রুটিন কাজ করে যাচ্ছেন কেবল, সাংবাদিকতার নতুন কোনো দিগন্ত উন্মোচন সম্ভব হচ্ছে না তাদের পক্ষে। কারণ, তাদেরও ভয় আছে যে, একুশে টেলিভিশনের মতো এরকম একটি শক্তিশালী গণমাধ্যমই যদি বিএনপি-জামায়াত সরকার বন্ধ করে দিতে পারে তাহলে এখনতো যে কোনো টেলিভিশন বন্ধ করে এক মিনিটের কাজ।

 আমরা স্বীকার করি যে, এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যুগ। কিন্তু তাতেই বা কি? ব্লগ লিখে একটি দশক এক দল উজ্জ্বল-উচ্ছল তরুণ যে আনন্দ আর উৎসাহ লাভ করেছে তার অবসান হলো কি রক্তাক্তভাবে এবং তারও উস্কানিদাতা কিন্তু আমাদেরই গণমাধ্যম সেকথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলি কিন্তু যখন দেশেরই একটি প্রধান দৈনিক ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করে এবং টকশো’কে ব্যাবহার করে মিথ্যাচারের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয় আর এসবের ভিত্তিতেই একের পর এক ব্লগারকে চাপাতিবাজরা হত্যা করে তখন গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা কোথায় থাকে?

আজ অবধি কোনো গণমাধ্যম এর দায়টুকু স্বীকার করেছে? করেনি। তাহলে গণমাধ্যম দাঁড়াবে কী করে? নিজেই যখন নিজের শত্রু হিসেবে দাঁড়িয়ে পড়ে কেবলমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য তখন তাকে বাঁচায় সাধ্য কার? আরো বড় কথা হলো, গণমাধ্যমকে আজকে সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলগুলো গাল দিতে সাহসী হয় মূলতঃ এ কারণে যে, প্রতিটি গণমাধ্যম মালিকের হয় রাজনৈতিক নাহয় ব্যবসায়িক ‘ইন্টারেস্ট’ রয়েছে, ফলে এই ‘ইন্টারেস্ট’কে কাজে লাগিয়ে তাদের ওপর চাপ দেওয়া সহজ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় গণমাধ্যমগুলি নিজেই নিজেদের ওপর স্ব-উদ্যোগে ‘সেন্সরশিপ’ আরোপ করে, হয়তো এ বিষয়ে সরকার কিংবা রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো মাথাব্যথাই নেই। কিন্তু ধরেই নেওয়া হয় আগে থেকে যে, সমস্যা হতে পারে। কারণ সেরকম সমস্যা হওয়ার উদাহরণ রয়েছে।

আরো বড় কথা হলো কতিপয় গণমাধ্যম এদেশের ‘এনজিও কালচার’ একরকম আত্মীকরণ করে নিজেদেরকে সেই জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে, ফলে সংবাদ প্রকাশে তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ প্রশ্ন করার সুযোগ পায়। এমনকি নিউজকে ভিউজ হিসেবে প্রকাশ করার উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি। সর্বোপরি গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে রাজনৈতিক দলগুলির বিকল্প একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম যাকে আমরা ‘সুশীল’ বলে অভিহিত করে থাকি, সেটি তৈরি করায় কোনো ভাবেই গণমাধ্যমের উপকার হয় না বা হয়নি, বরং তা এদেশের গণমাধ্যমকে বিপদগ্রস্ত করেছে আরো বেশি।

যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম, বিরোধীকণ্ঠ আসলেই রুদ্ধ কিনা সে প্রশ্নের উত্তর আশাকরি এতোক্ষণে কিছুটা হলেও পরিষ্কার হয়েছে। বিরোধী কণ্ঠ রুদ্ধ নয় এখন কোনো ভাবেই, চাইলেই যে কেউ যে কোনো কথা বলে থাকেন এবং তা টেলিভিশন, সংবাদপত্র, ব্লগ বা ফেসবুক যেখানেই হোক না কেন। কিন্তু বলে ফেললেই সেটা কতোটুকু কি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করছে সে প্রশ্ন আমরা কেউ তুলছি না। ভয়তো আছেই বলে ফেলায়, কিন্তু তারপরও টেলিভিশনের টক শো-য় যেভাবে দু’পক্ষকে বসিয়ে পক্ষে ও বিপক্ষে আলোচনা হয় বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি আগে কখনও দেখা যায়নি বিশেষ করে বিরোধী কণ্ঠের নামে বা পক্ষে বলার নামে ঢালাও মিথ্যাচারের।

একথা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে, বিরোধীকণ্ঠ হওয়ার জন্য মিথ্যাচারের প্রয়োজন পড়ে না। সত্যটা তুলে ধরলেই হয়, এই মুহূর্তে সত্য প্রকাশে দেশে কোনো প্রকার চাপ আছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই, কারণ, সত্য প্রকাশের জন্য কেবলমাত্র একটি মাধ্যম নয়, বহু মাধ্যমই এখন উন্মুক্ত রয়েছে। প্রশ্ন হলো, সত্য প্রকাশ করার নামে মিথ্যা প্রচারণা কতোটুকু হচ্ছে? এবং সেটা কতোটুকু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে? এবং সে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে দেশের মানুষ একাত্ম হয় কিনা? উত্তর হলো, না, হয় না। মানুষকে বোকা ভাববার দিন গত হয়েছে, এটাই সবচে সুখের কথা।

ঢাকা ২০ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার ২০১৮

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট। masuda.bhatti@gmail.com

এইচআর/আরআইপি