চন্ডিকা হাথুরুসিংহে এমন এক সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যখন ক্রমাগত হারের বৃত্তেই বন্দী থাকতে হচ্ছিল মুশফিকুর রহীমের দলকে। ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হংকংয়ের মত দলের সঙ্গে পর্যন্ত হারতে হচ্ছিল টিম বাংলাদেশকে। তার আগে এশিয়া কাপে হারতে হয়েছিল আফগানিস্তানের কাছে। সুরেশ রায়নার নেতৃত্বে ভারতের ‘বি’ ক্যাটাগরির দলের সামনেও দাঁড়াতে পারছিল না।
Advertisement
ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর কোচ শেন জার্গেনশেন বিদায় নিলে চন্ডিকা হাথুরুসিংহেকে প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। অচেনা-অজানা এক কোচকে নিয়োগ দেয়ার কারণে কিছুটা সমালোচনাও সইতে হয়েছিল বিসিবিকে। যদিও হাথুরুসিংহের ততদিনে শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের সহকারী কোচ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছিল।
কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর হাথুরুর প্রথম কাজই ছিল বাংলাদেশ দলকে একটি ‘দল’ হিসেবে তৈরি করে তোলা। যদিও হাথুরুর দায়িত্ব নেয়ার পরই বাংলাদেশের কঠিন একটি পরীক্ষা গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। নিষেধাজ্ঞার কারণে এই সিরিজে ছিলেন না সাকিব আল হাসান। ৩-০ ব্যবধানে ওয়ানডে, টেস্ট সিরিজে ২-০ ব্যবধানে হারের পর একমাত্র টি-টোয়েন্টিটা ভেসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজে দুঃস্বপ্নের সিরিজ শেষ করার পর টাইগাররা ফিরে এলো নিজের দেশে। জিম্বাবুয়ে সিরিজ সামনে। হাথুরুর প্রেসক্রিপশনে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনা হলো। সাদা পোষাকে মুশফিকুর রহীমকে রেখে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টির দায়িত্ব দেয়া হলো মাশরাফির ঘাড়ে। পরিবর্তনের শুরু সেখান থেকেই। শুরুতে টেস্ট সিরিজ। জিম্বাবুয়েকে ৩-০ ব্যবধানে বিধ্বস্ত করার পর মাশরাফির নেতৃত্বে ওয়ানডে সিরিজেও ৫-০ ব্যবধানে হোয়াইটওয়াশ করলো। হাথুরুর ক্যারিশমাও যেন শুরু হলো তখন থেকে। এরপর ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপ। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের কঠিন কন্ডিশনে বিশ্বকাপে কেমন করবে বাংলাদেশ? এই আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন বাংলাদেশ দলকে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে অস্ট্রেলিয়া উড়িয়ে নিলেন কোচ হাথুরু।
Advertisement
সেখানে অস্ট্রেলিয়ান কন্ডিশনে নিবিঢ় অনুশীলন করালেন। দলের মধ্যে তৈরি করলেন কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা। দলও পেলো দারুণ সাফল্য। ইংল্যান্ডের মত শক্তিশালী দলকে হারিয়ে নাম লেখালো কোয়ার্টার ফাইনালে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা সাফল্য। ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি করে সবার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
সাফল্যের তরি বেয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে নিজ দেশে চলে আসলে টিম বাংলাদেশ। প্রথমেই ঘরের মাঠে পেলো পাকিস্তানকে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর এই একটি মাত্র দলই ছিল বাংলাদেশের সামনে অপারজেয়। সেই পাকিস্তানকে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে হোয়াইটওয়াশ। টেস্ট সিরিজেও সমানভাবে জবাব দিয়েছিল টাইগাররা। এরপর ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঐতিহাসিক সিরিজ জয়। ঘরের মাঠে যেন বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে যে কারও জন্য বধ্যভূমি। যে কেউ এখানে আসতেই যেন ভয় পেতে শুরু করে। বাঘ তো নিজের গুহায় তার শিকার ধরবেই!
কোচ হাথুরুসিংহের ছোঁয়ায় বদলে যাওয়া এই বাংলাদেশ জিম্বাবুয়েকে টি-টোয়েন্টি এবং ওয়ানডে সিরিজে আরও একবার করে বিধ্বস্ত করে। খেলতে নামলো এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টিতে। সেখানে মাশরাফির দল খেললো ফাইনাল। এরপর ভারতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ টি-টোয়েন্টি। প্রথম রাউন্ডে আশানুরূপ ফল করলেও দ্বিতীয় রাউন্ডে ভালো করতে পারেনি। যদিও ভারতের মত দলের বিপক্ষে একেবারে শেষ মুহূর্তে গিয়ে হারতে হয়েছিল অনভিজ্ঞতার কারণে।
সাফল্যের ধারাবাহিকতা এরপরও অব্যাহত ছিল। ঘরের মাঠে ইংল্যান্ডকে প্রথমবারের মত টেস্টে পরাজয়ের স্বাদ দিতে পারলো টাইগাররা। শ্রীলঙ্কার মাটিতে গিয়ে জিতলো শততম টেস্ট। ইংল্যান্ডে গিয়ে উঠলো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে। এরপর ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়াকেও টেস্প পরাজয়ের স্বাদ উপহার দিল টিম বাংলাদেশ। মাঝে নিউজিল্যান্ড, ভারতে গিয়ে সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলি হয়েছে সমৃদ্ধ।
Advertisement
কঠোর হেড মাস্টার হাথুরুসিংহের অধীনে দারুণ সুশৃঙ্খল একটি দলে পরিণত হয়েছিল টিম বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে দ্বি-পাক্ষিত সিরিজে খুব বেশি ভালো করতে না পারলেও আইসিসি টুর্নামেন্টগুলোতে রেখেছে দারুণ সাফল্যের স্বাক্ষর। চার বছরের কোচিংয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে দারুণ এক অবস্থানে নিয়ে গেছেন কোচ হাথুরুসিংহে।
যদিও তার একনায়কতন্ত্র বেশ সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল। নির্বাচক কমিটিকে দ্বি-স্তর বিশিষ্ট করে নিজের পকেটস্থ করে ফেলারও দুর্নাম ছিল। নিজের পছন্দমত ক্রিকেটার বাছাই করারও দুর্নাম ছিল; কিন্তু এসবই তো ছিল বাংলাদেশ দলের সাফল্যের জন্য। অথচ, এসবই চক্ষুশূল হয়ে পড়েছিল কারও কারও। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে ব্যর্থতার কারণে সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছে।
অবশেষে হাথুরুসিংহে মেয়াদ শেষ না করেই নিজ দেশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছেড়ে গেলেন বাংলাদেশ দলকে। লঙ্কানদের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম অ্যাসাইনমেন্টেই আসলেন বাংলাদেশে। টাইগারদের বিপক্ষে নিজের প্রথম চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ দলে আগে থেকেই আলোচনা, হাথুরুই হতে পারেন টাইগারদের প্রধান প্রতিপক্ষ। তিনি তো এই দলটির ক্রিকেটারদের হাঁড়ির সব খবর জানেন। আর রাতারাতি তো কোনো কিছুর খোলনলচে বদলে দেয়া যায় না!
যদিও বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা এর তুমুল বিরোধিতা করেছিল। হাথুরুর প্রতিপক্ষ দলে থাকাটাকে তারা থোড়াই কেয়ার করলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হলো, হাথুরুই ছিলেন মূল ফ্যাক্ট। তার কাছেই ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনাল, টেস্ট সিরিজ এবং টি-টোয়েন্টি সিরিজ হেরেছে বাংলাদেশ।
চার বছরে চন্ডিকা হাথুরুসিংহে যে সাফল্য বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছিলেন, তিনি চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশ দলে যেন তৈরি হয়েছে দারুণ এক শূন্যতা। সেই শূন্যতার ভিত্তিমূলে আঘাত হেনে চার বছরে দেয়া সাফল্যকে এক সফরেই ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন হাথুরুসিংহে।
কেউ কেউ বলবেন, এক সিরিজে হারে তো সব কিছু শেষ হয়ে যায় না। তা ঠিক; কিন্তু বাংলাদেশ দলের যে চেহারা ত্রিদেশীয় সিরিজের শেষ দুই ম্যাচ থেকে প্রদর্শিত হতে শুরু করেছে, সেটা আড়াল করা যাবে কী দিয়ে। হাথুরুর মত একজন কঠিন হেডমাস্টারই হয়তো পারেন, এই ছন্নছাড়া দলটিকে এক সুতোয় গাঁথতে। যদিও, টিম বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মানসিক শক্তি এবং মনোবলকে ফিরিয়ে আনা কঠিনই হবে যে কারও জন্য।
আইএইচএস/এমআরএম