বিশেষ প্রতিবেদন

কৃষিপণ্য উৎপাদনে দেশ এগিয়েছে বহুদূর

স্বাধীনতার ৪৬ বছরে কৃষিক্ষেত্রে দেশ বহুদূর এগিয়ে গেছে। ১৯৭০ সালের আগে বাংলাদেশ ছিল খাদ্য ঘাটতির একটি অঞ্চল, দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ। আশ্বিন-কার্তিক মাসে প্রতি বছর আমন ধান কাটার আগে খাদ্যের অভাব দেখা দিত। এখন আর এ অবস্থা নেই। কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য রেকর্ড ছুঁয়েছে। প্রতি বছর ধান, গম, ভুট্টা মিলিয়ে তিন কোটি ৮৮ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে। বর্তমানে বছরে মাছ উৎপাদন হচ্ছে ৩৬ লাখ টন। পাট উৎপাদনেও এবার রেকর্ড হয়েছে। শাকসবজি উৎপাদন হচ্ছে এক কোটি ৫০ লাখ টন। ফল উৎপাদন হচ্ছে বছরে এক কোটি ছয় লাখ টন (২০১৭ সালের মার্চ মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী)।

Advertisement

কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বছরে ৮০০ কোটি টাকার কৃষিপণ্য রফতানি হচ্ছে পৃথিবীর শতাধিক দেশে। প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে শতকরা সাত দশমিক ২৮ ভাগ। মাথাপিছু আয় এক হাজার ৬১০ মার্কিন ডলার।

কৃষিবিদরা বলছেন, কৃষিবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও সময়োপযোগী বিভিন্ন প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিতের পদক্ষেপ গ্রহণ করায় দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এখন রেকর্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বিশ্বে পথিকৃৎ বাংলাদেশ। কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর মতে, কৃষিতে বিজ্ঞানভিত্তিক নানা পদক্ষেপের কারণে খাদ্য উৎপাদনে আজ আমরা নিজেদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছি। বন্যা, দুর্যোগ, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি ও মহাদুর্যোগ না হলে দেশে খাদ্য সংকট হবে না। বরং আমরা কিছু হলেও এখন অন্যকে দেয়ার ক্ষমতা রাখি।

Advertisement

জানা যায়, স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি ১০ লাখ টন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। এর পরের ৪৬ বছরে এখানে মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণ, আর আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। অথচ দেশে এখন খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে তিনগুণ বেশি। ভুট্টাসহ খাদ্যশস্যের পরিমাণ এখন পাঁচ কোটি টনের বেশি।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্য অনুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সবজির উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণ। গত এক যুগে রীতিমতো ঘটে গেছে সবজি বিপ্লব। গত এক দশকে বাংলাদেশে সবজির আবাদি জমির পরিমাণ পাঁচ শতাংশ হারে বেড়েছে। এ হার বিশ্বে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে এফএও।

বিশ্বে ফল উৎপাদন বৃদ্ধির হার এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে উঠে এসেছে।

এফএও’র বৈশ্বিক পরিসংখ্যান প্রতিবেদন বলছে, ফল উৎপাদনের দিক থেকে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিল বিশ্বের পর্যায়ক্রমে শীর্ষস্থানে রয়েছে। আর মোট ফল উৎপাদনের দিক থেকে বিশ্বে ২৮তম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে দুই বছর ধরে বাংলাদেশের ফলের উৎপাদন বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ থেকে দ্রুতগতিতে বাড়ছে।

Advertisement

এফএও পূর্বাভাস দিয়েছে, ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বের যে চারটি দেশ মাছ চাষে বিপুল সাফল্য অর্জন করবে, তার মধ্যে প্রথম দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এরপর থাইল্যান্ড, ভারত ও চীন।

এফএও’র হিসাবে সমুদ্রে মাছ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২৫তম। তবে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মীমাংসার পর বঙ্গোপসাগর থেকে বাংলাদেশের মৎস্য আহরণ কয়েক গুণ বাড়বে বলে সংস্থাটির ধারণা। অবশ্য মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, বর্তমান সরকার তার মেয়াদকালে দক্ষতার সঙ্গে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আত্মনিয়োগ করে। এ সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক খাতে সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান বিষয় যেমন মোট দেশজ আয়, কর্মসংস্থান, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি হ্রাস, সামাজিক খাতে দারিদ্র্য নিরসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারী ও শিশু নিরাপত্তায় অগ্রগতি এবং খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে ব্যাপক সাফল্য এসেছে। সেই ধারাবাহিকতায় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। কৃষি খাতে সরকারের ভর্তুকি, কৃষকদের মাঝে কৃষি যন্ত্রপাতি হস্তান্তর, কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করে তোলাসহ নানা উদ্যোগের ফল হচ্ছে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা অনস্বীকার্য যে, কৃষিক্ষেত্রে যেটুকু অর্জন হয়েছে তার সিংহভাগই এসেছে দেশের কৃষক ও কৃষিজীবীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের হাত ধরে। কৃষক নিজে বাঁচার তাগিদেই কৃষিপণ্য উৎপাদন করেন। নিজেদের জীবন-জীবিকার উন্নয়নে তারা কৃষিকে এগিয়ে নিচ্ছেন। সরকার তাদের সহায়তা দিচ্ছে মাত্র। এটা যে কোনো দেশের সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

এফএইচএস/জেডএ/এমএআর/বিএ