ফিচার

প্রাণঘাতী ব্লু হোয়েল গেম থেকে সাবধান

বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও কম নয়। মানুষের অসচেতনতা বা আসক্তির ফলে প্রায়ই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। কেননা তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে মানুষ যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে। বর্তমান প্রজন্ম স্মার্টফোন আর ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে কখনো কখনো প্রাণঘাতি সিদ্ধান্ত নিতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না।

Advertisement

বর্তমান বিশ্বের আতঙ্ক এখন একটি অনলাইন গেম নিয়ে। যার নাম ‘ব্লু হোয়েল সুইসাইড গেম’। এই খেলার জন্ম হয় রাশিয়ায়। গেমটির প্রস্তুতকারক ২২ বছরের তরুণ ফিলিপ বুদেকিন। সে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত মনোবিজ্ঞানের ছাত্র। ২০১৩ সালে রাশিয়ায় প্রথম গেমটির সূত্রপাত হয়। ২০১৫ সালে এই গেমের কারণে প্রথম আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়।

বিশ্বের উন্নত দেশ থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি দেশে ছড়িয়ে পড়ছে গেমটি। তারই ধারাবাহিকতায় এবার বাংলাদেশেও হানা দিয়েছে ব্লু হোয়েল গেম। গত ৫ অক্টোবর সকালে এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয় তার পড়ার কক্ষ থেকে। কিশোরীর নাম অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণা। ধারণা করা হয়, মেধাবী এই ছাত্রীও ব্লু হোয়েল গেমে আসক্ত ছিলো।

আরও পড়ুন- আত্মহত্যায় শেষ হচ্ছে যে অনলাইন গেম

Advertisement

বর্তমানে সাধারণ ভিডিও গেমের পরিবর্তে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠেছে অনলাইন গেম। সারা বিশ্বের যেকোন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে এখানে প্রতিযোগিতা করা যায়। ফলে বর্তমান প্রজন্ম নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। এক সময় তাদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে হতাশা। আর তারপরই এই অনলাইন গেমের মাধ্যমে ঘটছে মর্মান্তিক ঘটনা।

অবাক করার মত বিষয় হলেও সত্য যে, ব্লু হোয়েল গেম খেলতে খেলতে এক সময় আত্মহত্যা করতেও হৃদয় কাঁপে না তাদের। কারণ ওই খেলায় একের পর এক ভয়ংকর সব কাজ করতে বলা হয়, যার শেষ পর্যায়ে আত্মহত্যার নির্দেশ দেওয়া হয়ে থাকে।

ব্লু হোয়েল গেম আসলে কী? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, অনলাইনে একটি কমিউনিটি তৈরি করে চলে এ প্রতিযোগিতা। এতে মোট ৫০টি ধাপ রয়েছে। ধাপগুলো খেলার জন্য ওই কমিউনিটির অ্যাডমিন বা পরিচালক খেলতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ দিয়ে থাকে। প্রতিযোগী সে চ্যালেঞ্জ পূরণ করে তার ছবি আপলোড করে। শুরুতে মোটামুটি সহজ এবং কিছুটা চ্যালেঞ্জিং কাজ দেওয়া হয়। যেমন- মধ্যরাতে ভূতের সিনেমা দেখা, খুব সকালে ছাদের কিনারা দিয়ে হাঁটা, ব্লেড দিয়ে হাতে তিমির ছবি আঁকা ইত্যাদি। ধাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কঠিন ও মারাত্মক সব চ্যালেঞ্জ দেয় পরিচালক। যেগুলো অত্যন্ত ভয়াবহ এবং সর্বশেষ ধাপ হলো আত্মহত্যা করা। অর্থাৎ গেম শেষ করতে হলে প্রতিযোগীকে অাত্মহত্যা করতে হবে।

আরও পড়ুন- নীল তিমির ছোবল : খেলতে না চাইলেই খুনের হুমকি

Advertisement

শুরুতে তুলনামূলক সহজ এবং সাহস আছে কিনা- এমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ায় যুবক-যুবতীরা আকৃষ্ট হয়। একবার এ খেলায় ঢুকে পড়লে বের হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমনকি খেলার মাঝপথে চলে আসতে চাইলে প্রতিযোগীকে ব্লাকমেইল করা হয়। এছাড়া তার আপনজনদের ক্ষতি করার হুমকিও দেওয়া হয়। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কথা হচ্ছে- গেমটি একবার মুঠোফোনে ব্যবহারের পর তা আর ডিলিট করা যায় না।

অথচ এই গেমের আবিষ্কারক বুদেকিন এমন কাজের জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবছেন না। উপরন্তু নিজেকে সমাজ সংস্কারক বলে দাবি করছেন। তার মতে, যারা এই চ্যালেঞ্জের শিকার; তারা এ সমাজে বেঁচে থাকার যোগ্য নয়। অপরদিকে গেমটি নিয়ে রীতিমত চিন্তিত রাশিয়া পুলিশ। তদন্তে জানা যায়, রাশিয়ায় এ পর্যন্ত অন্তত ১৬ কিশোরী এ গেমের কারণে আত্মহত্যা করেছে। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১৮০ জনের আত্মহত্যার খবরও পাওয়া গেছে। এ গেমের আসল অ্যাডমিন বুদেকিন আটক থাকলেও তাদের কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। ফলে গেমের প্রভাব এখন ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে।

এ নিয়ে চিন্তিত মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও। গেমটি কিভাবে তরুণ-তরুণীদের আত্মঘাতী করে তুলছে; সে বিষয়ে গবেষণা চলছে এবং প্রতিকারের উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। বিশেষ করে ব্রিটেন-আমেরিকায় এ গেম জনপ্রিয়তা পাওয়ায় দেশগুলো স্কুল-কলেজসমূহে এ গেমের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে। সম্প্রতি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও এ গেমের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। তরুণ-তরুণীদের এ গেম থেকে বিরত রাখতে রীতিমত চিন্তিত হয়ে পড়েছেন দেশগুলোর বিশেষজ্ঞরা।

আরও পড়ুন- আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে যে পাতা

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যে বাচ্চারা এ রকম গেম বেছে নিচ্ছে, তাদের মধ্যে বিরূপ পরিবেশ, হতাশা, আত্মমর্যাদার অভাব এবং মনোকষ্ট থাকে। সেজন্য তারা এমন একটা কিছু করে দেখাতে যায়, যাতে মানুষ তাদের অকুতোভয় বলে মনে করবে।

বাংলাদেশেও এ গেমের প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার আত্মহত্যা যদি ব্লু হোয়েল গেমের কারণে হয়ে থাকে; তবে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি। এ ক্ষেত্রে বেশি তৎপর হতে হবে অভিভাবকদের। অপরিণত বয়সে তাদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। দিলেও স্মার্টফোনটি পর্যব্ক্ষেণ করুন। এই গেমে আসক্ত হলে সন্তান আপনাকে তার ফোনটি ধরতে বাধা দেবে। এমনকি কোনভাবে স্পর্শ করলেও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠবে। তাই আমাদের প্রত্যেককেই সাবধান হতে হবে।

সন্তানের আচরণ ও গতিবিধি লক্ষ্য রাখতে হবে। তাকে নিঃসঙ্গ থাকতে দিবেন না। কিছুক্ষণ পর পর তার কার্যক্রম মনিটরিং করতে হবে। আসক্ত হওয়ার আগেই মুঠোফোনটি নিস্ক্রীয় করে ফেলবেন। স্মার্টফোনের অ্যাপগুলো প্রতিদিন যাচাই-বাছাই করে দেখতে পারেন। পরিবার ছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে ব্লু হোয়েল গেম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে আমাদের দেশের গণমাধ্যমকেও।

আরও পড়ুন- কাক ডাকলে কী হয়

ব্লু হোয়েল গেম ছড়িয়ে পড়ার আগেই সাবধান হতে হবে। এখন থেকে ইন্টারনেট নিয়েও ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা দিতে হবে। ইন্টারনেটে কোন কাজটি করা উচিত, কোনটা অনুচিত- সেগুলো শেখাতে হবে। কারণ গেমটি একবার ছড়িয়ে পড়লে মহামারি আকার ধারণ করতে পারে। তাই এখনই সময় রুখে দাঁড়াবার। তরুণ সমাজকে এমন আসক্তির হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের সবার।

তথ্যসূত্র: বিবিসি, ডয়েচে ভেলে, বিভিন্ন গণমাধ্যম

এসইউ/এমএস