মতামত

জানের সদকা

“তোমার বাবা আজ আর তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন না। উনি বিব্রত।” আম্মা কোন রাখ ঢাক না করেই বললেন। আমার বাসা থেকে হাসপাতালে পৌঁছাতে প্রায় আধা ঘণ্টা লাগে। প্রতিদিন ভোরে রুটিন মাফিক তাঁদের সাথে কথা বলি। আজও কথা বলছিলাম তাঁদের সাথে। আমার বাবা বড়ই বিব্রত। কারণ তিনি ‘ধরা’ খেয়েছেন ( আমার মায়ের ভাষায়)।

Advertisement

গতকাল সকালে তিনি একটি ফোন কল পেলেন। বাবু নামে একটি ছেলে তাঁকে ফোন করেছিলো। বাবু বলল, “নানা, কেমন আছেন? ভারী বিপদে পড়েছি। আমার কিছু টাকা দরকার।” আমার বাবা বেশ হিসেবী মানুষ। এটি কোন বাবু তা তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না। তার মনে হোল এই ‘বাবু’ বোধ হয় আমাদের গ্রামের বাড়ির কেয়ারটেকার রফিক মিয়ার ছেলে। তিনি তাড়াহুড়ো করে কয়েক হাজার টাকা বাবুকে “বিকাশ” করে পাঠিয়ে দিলেন। ঘরে এসে রফিক মিয়াকে জানাতেই সে চমকে উঠলো। তিনি জানালেন, বাবু তো আমার বাবার কাছে টাকাই চায়নি। আমার বাবা তো বেকুব বনে গেলেন। তিনি সেই বাবুকে ফোন করে আর খুঁজে পাচ্ছেন না এখন। কি বিব্রতকর ব্যাপার! আমরা সবাই এক গাল হাসছি। আর আমার বাবা কেবল চুপসে যাচ্ছেন। তাঁকে সান্ত্বনা দেবার জন্য আম্মা তাঁকে বলেছেন, “ মন খারাপ করো না। ধরে নাও ‘জানের সদকা’ দিয়ে দিলে।”

অফিসে কাজ শুরু করেছি। হ্যারিকেন ‘ইরমা’ চলে যাবার পর ও রোগীর পরিমাণ কমেনি। একের পর এক রোগী দেখছি। দিনের শেষ রুগীটা বাতিস্তা সাহেব। আশি বছরের চির তরুণ যুবক। ভীষণ স্বাধীনচেতা মানুষ। এখনও নিজের সব কাজ নিজে নিজেই করেন। বাতিস্তা সাহেবের আসার কথা ছিল ঘণ্টা খানেক আগে। দেরীতে এলেও অফিসের কেউ তাঁকে না বলতে পারে না। তার মতো এত মধুর স্বভাব খুব কম মানুষেরই আছে। প্রতিদিনই হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসেন অফিসের কর্মচারীদের জন্য। আজ তিনি কিছু নিয়ে আসেননি। আমাকে দেখেই তার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলেন বাতিস্তা সাহেব। দেরি করে আসার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। তার পর দেরি হবার কারণটা আমাকে জানাতে শুরু করলেন।

আমি আমার রোগীদের কথা মন দিয়ে শুনবার চেষ্টা করি। সৌজন্য সহকারে তাঁর দেরীতে আসার কারণটা শুনলাম। হ্যারিকেন ‘ইরমাতে’ তাঁর বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁকে আমাদের শহরের সমাজ কল্যাণ বিভাগ ফোন করেছে আজকে। তারা তাঁকে জরুরি ভিত্তিতে কিছু টাকা তাঁর ব্যাংকের মাধ্যমে আজই ‘ওয়ার’ করে পাঠাতে বলেছেন। অল্প কিছু টাকার বিপরীতে তারা তাঁর বাড়ির সব কিছু মেরামত করে দেবে। তিনি ব্যাংকে গিয়ে আটকে গিয়েছিলেন। সে জন্যই তিনি আসতে দেরী করেছেন। আমিতো শুনেই অবাক। বাতিস্তা সাহেবও তো দেখি আমার বাবার মতো ‘ধরা’ খেয়ে গেছেন আজকে। আমি তাঁকে কিভাবে “জানের সদকার” ফজিলত টা বোঝাবো?

Advertisement

লেখক : পরিপাকতন্ত্র ও লিভার বিভাগীয় প্রধান, ফ্লোরিডা হাসপাতাল, ফ্যাকাল্টি, কলেজ অব মেডিসিন, সেন্ট্রাল ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটি।

এইচআর/পিআর