নজরুল ইসলামের কবিখ্যাতি আজ সর্বজনবিদিত, এমনকি বহির্বিশ্বেও বহুভাষায় ব্যাপ্ত। কেননা, বাংলা সাহিত্যের বিপ্লবাত্মক কাব্যচেতনার তিনি প্রধানতম কবি। যদিও এটিই তাঁর প্রধান পরিচয় নয়। তিনি শুধু কবিতাতেই বিপ্লব-বিদ্রোহের কথা উচ্চারণ করেননি। সাহিত্যের অন্যান্য মাধ্যম-প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও সঙ্গীতেও তাঁর বিপ্লবাত্মক চেতনার বিপুল উপাদান ছড়িয়ে আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, তাঁর অনন্য মৌলিক কীর্তির বিশ্লেষণ এ যাবৎ আমরা খুব কমই করতে পেরেছি। তাই দ্রষ্টব্য, তাঁর জীবন ও সাহিত্য কর্মের গবেষণায় এ যাবৎ বিষয় ও বক্তব্য প্রাধান্য পেয়েছে কম, বরঞ্চ কোন রচনা কোথায়, কার অনুরোধে কখন রচিত এবং কে তা উদ্ধার করেন এই বিতর্কেই অর্ধশতাধিক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে।
Advertisement
নজরুল নিছক রস সঞ্চারের জন্য সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেননি। জাতির প্রতি তাঁর একটি কমিটমেন্ট ছিলো। দেশকে বিদেশী শাসকদের হাত থেকে মুক্ত করা, গরিব মানুষের-শ্রমজীবী দেশবাসীর অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে অত্যন্ত সচেতনভাবেই আত্মনিয়োগ করে ছিলেন তিনি। বলতে কি, একবারে শূন্য হাতে শুরু হয়েছিলো তাঁর এই সংগ্রাম কলম ছিলো একমাত্র সঙ্গী। করাচির সেনানিবাস থেকে ছাড়া পেয়ে স্থায়ীভাবে কলকাতা এসে সরকারি চাকরির সুযোগ উপেক্ষা করে, সচ্ছল অর্থনৈতিক জীবনের হাতছানিকে মাড়িয়ে অনিশ্চিত সংগ্রামী জীবন-ই বেছে নিলেন কবি। দেশকে মুক্ত করার জন্য কেবল বিদ্রোহ ও সশস্ত্র সংগ্রামের কথাই বললেন না, সমাজের কুসংস্কার-বন্ধন, জরা, সাম্প্রদায়িক সংঘাত ও মৌলবাদীদের ফতোয়াবাজির মর্মমূলেও কুঠারাঘাত করলেন।
বাঙালি মুসলমান এই নজরুল ইসলামের রচনাতেই সেদিন প্রথম দেখতে পেয়েছে যে, তার মাতৃভাষা বাংলার সঙ্গে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরিফের ভাষা আরবি একই সঙ্গে উচ্চারিত হতে পারে। অথচ ধর্মান্ধ মোল্লাসমাজ বহুকাল এই আরবি ভাষা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞানতার সুযোগকে নানাভাবে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটেছে। তার উপর সমকালে একমাত্র মুসলমান লেখক ছিলেন নজরুল ইসলাম, যে তাঁর স্বজাতি ও স্বধর্ম সম্পর্কে চূড়ান্তভাবে দায়িত্বশীল থেকেও চূড়ান্তভাবে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর এসব ভূমিকা, সেইসঙ্গে সাম্যবাদী ধারার রাজনৈতিক আদর্শ, দলিতের মুক্তির ঘোষণা অথবা ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে হাইদরী হাঁক ১৯৪২ সালে কবির অসুস্থতার সঙ্গে সঙ্গেই যেন মিইয়ে গেল। এর কারণ যে কি, তার বহুরূপ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হতে পারে। তবে আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভীতি-অনিশ্চয়তা এবং যুদ্ধোত্তর দেশভাগের নানা সংকট, মধ্যবিত্ত বাঙালি, বৈশিষ্ট্যে যে আত্মকেন্দ্রিকতার সমাজে কবিকে নিয়ে ভাবার সময় সুযোগ খুব একটা হয়নি। কিন্তু দেশ ভাগের ২/৩ বছরের মধ্যে এইসব ঝক্কি-ঝামেলা কেটে যাবার পর বাঙালি সত্যি আর ত্রিশের দশকের মতো কবিকে নিয়ে মেতে উঠলো না। সমকালের বাঙালি নেতৃত্ব বা নজরুলপ্রেমীরা কোন অবস্থাতেই এই ভূমিকার জন্য ধন্যবাদর্হ নন।
চুরুলিয়ার দুখু মিঞা বালক বয়সে যে একদিন গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অজয় নদীর প্রবাহের মতো জীবনকে জয় করতে বেরিয়ে ছিলো, সে আজ বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাঙালি জাতিসত্তার এক মহিমান্বিত মহানায়ক। জাতিসত্তার প্রভাবকে যে সীমান্ত কখনো বিপন্ন করতে পারে না তারও প্রমাণ নজরুল ইসলাম। এই নজরুল আজ তাই বাংলাদেশ ও ভারতের-পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও বিশ্বের সব প্রবাসী বাঙালির জাতীয় কবি।
Advertisement
এখানে উল্লেখ করা অপরিহার্য যে, বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবাংলা, আসাম, ত্রিপুরাসহ বিশ্বের প্রায় ত্রিশ কোটি বাঙালির অধিকাংশেরই সাহিত্য ও সাহিত্যিক সম্পর্কে, সাহিত্যিকের কর্তব্যবোধ সম্পর্কে স্বচ্ছ কোন ধারণা নেই। কারণ, ভূমিহীন নিরন্নের ক্ষেত্রে অশিক্ষা এবং উচ্চবিত্ত সমাজে সাহিত্য মার খায় বিত্তের জৌলুসের কাছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজেই মূলত সাহিত্য রচয়িতা ও ভোক্তার উপস্থিতি। কিন্তু সংখ্যায় এই শ্রেণীটি নগণ্য, ত্রিশ কোটির এক-তৃতীয়াংশেরও কম। নিম্নবিত্ত-অশিক্ষিত, জীবিকাই যার জীবন সংগ্রামের প্রধান ধর্ম, তার কাছে সাহিত্য তেমন কোন অপরিহার্য বিষয়ই নয়। সেই বাঙালি সমাজে আপামর হয়ে এই যে উঠে এলেন নজরুল ইসলাম। তার মূলে যতটা না ক্রিয়াশীল তাঁর সাহিত্য, তার চেয়ে বেশি তাঁর রাজনৈতিক-সামাজিক ভূমিকা ও সঙ্গীতের যুগান্তকারী আবেদন। নজরুল নিজেই বলেন, ‘অশিক্ষিত বাঙালি যে লিখতে পড়তে জানে না, সে গান বোঝে।’ সঙ্গীতের মাধ্যমেই তিনি তাদের জাগিয়ে তোলার ব্রত গ্রহণ করেন। সাহিত্যকে এই যে গণমুখি করে তোলা, সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া- বাংলায় আর কোনো লেখকের কলমের এমন ধার সেদিন পরিলক্ষিত হয় না।
রবীন্দ্র যুগে, বাঙালি যখন তাঁর কলমের ঐশ্বর্যে গৌরবান্বিত। তখন নজরুলের উত্থানপর্বটি অনায়াস সাধ্য ছিলো না। কিন্তু প্রবল বিক্রমে নজরুল উঠে এলেন, রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে সাহিত্য-সাংবাদিকতায় বিপ্লবাত্মক বিদ্রোহ চেতনার নতুন ধারা সৃজন, যুগ মনষ্কতার বিচারে যা রেঁনেসাসরূপী, নজরুলের এই স্বাতন্ত্র্য ও যুগস্রষ্টার গৌরবকে কেউ অস্বীকার করতে পারলেন না। রবীন্দ্রনাথও করেননি। বরং অসীম মমতায় অদ্যোপান্ত অনুপ্রাণিত করেছেন নজরুলকে। কিন্তু অশিক্ষাজর্জর অধিক অনুর্বর মস্তিষ্কের বাঙালি সমাজে যখনই রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে কথা ওঠে, তখনই ধর্মকাতর হীনম্মন্য সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে যান তাহলে নজরুল কি? এরা নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে দাঁড় করিয়ে সাম্প্রদায়িক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টায় বরাবরই লিপ্ত ছিলো। বাঙালির দুর্ভাগ্য ওইখানেই। বিপুল অশিক্ষা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের অচলায়তন অতিক্রম করে শিক্ষিত হয়ে ওঠার পরই সে যে চরিত্র অর্জন করে, তা অশিক্ষিতের চাইতেও ভয়ঙ্কর। এদের অবিচারের হাত থেকে সমাজের আর সব বিষয় যেমন অনায়াস অব্যাহতি পায় না, তেমনি রবীন্দ্র-নজরুলও পাননি। সংখ্যায় এরা নগণ্য হলেও তাদের ভূমিকার প্রভাব নানা কারণে বিস্তৃত।
রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে নজরুলকে বা নজরুল প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে টেনে আনা দূরভিসন্ধিমূলক। কারণ রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে গেছেন। ‘ধূমকেতু’ মামলায় কারারুদ্ধ তরুণ নজরুলকে ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি উৎসর্গ করে তার একটি কপি কারাগারে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গপত্রে তাঁকে ‘কবি’ বলে সম্বোধন করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছে। আর পড়ে থাকলেও তার মধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করনি, অবজ্ঞা ভরে চোখ বুলিয়েছ মাত্র। ... কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এও তোমাদের আবদার বটে। সমগ্র জাতির অন্তর যখন সে সুরে বাধা অসির ঝনঝনায় যখন সেখানে ঝঙ্কার তোলে, ঐক্যতান সৃষ্টি হয়, তখন কাব্যে তাকে প্রকাশ করবে বৈকি! আমি যদি আজ তরুণ হতাম, তাহলে আমার কলমেও এই সুর বাজত। .... আমি তাকে সমস্ত অন্তর দিয়ে অনুণ্ঠে আর্শীবাদ জানাচ্ছি। আরো বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জোগাবার কবিও তো চাই।’
রবীন্দ্র-নজরুলকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টিকারীদের মতো আরেকটি মহল নিজের মাথায় পাথর ভাঙ্গার মতো রবীন্দ্র ছায়ায় অবস্থান করেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও বিতর্কে লিপ্ত হয়। বাঙালি সমাজের এইসব তথাকথিত বুদ্ধিজীবী মহলের উদ্ধত অনাচার অতীতের সকল মাত্রাকে অতিক্রম করে। বিশ্বচেতনায় ধার বা আত্মসাতের কোন প্রশ্নই আসে না। চেতনাগত সাদৃশ্য থাকতেই পারে। রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’ বা ‘ঘরেবাইরে’র মধ্যে এই সাদৃশ্য যদি পরিলক্ষিত হয়ই, তাতে দোষটা কি তা কেউ স্পষ্ট করে বলছেন না। আবার একথাও বলছেন না যে, রবীন্দ্রনাথ এগুলো অনুবাদ করে নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন।
Advertisement
যে রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনে কর্মচ্যুতদের শান্তিনিকেতনে চাকরি দিয়ে, স্বর্ণপদকে ভূষিত করে, স্বদেশীভাণ্ডার গড়ে রাজশক্তি ব্রিটিশের বিরাগভাজন হন এবং ব্রিটিশরা সরকারি পোষ্যদের শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া নিষিদ্ধ করে, সন্দেহভাজন বিশিষ্ট কলকাতাবাসীদের তালিকায় রবীন্দ্রনাথের নাম ওঠে এবং পুলিশকে অবহিত না করে কলকাতার বাইরে না যাওয়ার সমন জারি হয় তার বিরুদ্ধে, সেই রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ওঠানো হয়েছে সরকারের কাছ থেকে টাকা খেয়ে ‘চার অধ্যায়’ রচনার।
টাকা দিয়ে যদি রবীন্দ্রনাথকে কেনা যেতো-বা ফরমায়েসি কাজ করানো সম্ভব হতো, তা হলে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনকে সমর্থন, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি বর্জন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংকটে টাকা দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সমর্থন আদায় না করে তারও দীর্ঘদিন পর গান্ধী আরউইন চুক্তিতে ভারতীয়দের শাসনাধিকার স্বীকৃতির প্রেক্ষাপটে ১৯৩৪ সালে ‘চার অধ্যায়’ ফরমায়েশ করে লেখানোর কি দায় পড়লো ব্রিটিশ সরকারের তার কোথাও ব্যাখ্যা নেই।
একইভাবে ‘বিদ্রোহী’ রচনার পর নজরুলকে নিয়েও টানা-হেঁচড়া কম হয়নি। কবি মোহিতলাল ছিলেন এই অনাসৃষ্টির হোতা। অথচ ‘মোসলেম ভারতে’ এই নজরুলের কবিতা পড়েই মোহিতলাল প্রথম বাংলা সাহিত্যের স্বারশ্বত মণ্ডপে নজরুলকে স্বাগত জানিয়ে ছিলেন। একইভাবে ‘সবুজপত্রে’র প্রমথ চৌধুরী কর্তৃক নজরুলের অমনোনীত লেখাটি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে পেয়ে এবং ছেপে যে ‘প্রবাসী’ আরো চাই বলে মন্তব্য করেছিলো, হিন্দু রমণী প্রমীলাকে বিয়ে করায় সেই ‘প্রবাসী’সহ আরো কয়েকটি পত্রিকা চিরতরে নজরুলকে অপাঙক্তেয় ঘোষণা করে। আর কোনদিনই এরা নজরুলের লেখা ছাপেনি।
মৌলবাদী ধর্মব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কলম ধারণ করায় শুরু থেকেই ‘মোহাম্মদী’ নজরুল ইসলাম ও ‘সওগাতে’র অব্যাহত নিন্দাবাদ করেছে। ‘সওগাত’ সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন তাঁর ‘সওগাত-যুগে নজরুল ইসলাম’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, পশ্চাৎপদ ধ্যান ধারণার লালন ও প্রগতিবাদের বিরোধিতার কারণে বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে থাকায়- এক পর্যায়ে মোহাম্মদী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আপোষ করতে বাধ্য হয় এবং নজরুল ইসলামের লেখা ছেপেই সেদিন পত্রিকাটি তাঁর পড়ন্ত বাণিজ্যিক অবস্থাকে চাঙ্গা করে তোলে। এ প্রসঙ্গে ‘নজরুল এছলাম’ শীর্ষক মাসিক ‘মোহাম্মদী’র পঞ্চম বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা ১৯৩২-এর সম্পাদকীয় প্রতিবেদনটি প্রাণিধানযোগ্য। দীর্ঘ প্রায় এক দশক অব্যাহতভাবে নজরুল ইসলামের বিরোধিতা ও নিন্দাবাদের পর দীর্ঘদিনের অনাচারকে ‘মোহাম্মদী’ তীব্র অভিমান হিসাবে উল্লেখ করে বলছে, ‘কবি ও সাহ্যিতিক হিসাবে নজরুল এছলাম বিপুল খোদাদাদ শক্তির অধিকারী, একথা বোধহয় কেহ অস্বীকার করিতে পারিবে না। তাঁহার প্রতিভা ও শক্তিমত্ততার প্রতিষ্ঠায় যে আনন্দ ও গৌরব, তাহা উপভোগ করার জন্য আমাদের প্রাণও দীর্ঘকাল হইতে ব্যাকুল হইয়াছিল। কিন্তু নিরঙ্কুশভাবে তাহা ভোগ করিবার সুযোগ আমাদের ভাগ্যে ঘটিয়ে উঠে নাই, তাহা নজরুলের প্রতি আমাদের এবং আমাদের ন্যায় অধিকাংশ সমাজ সেবকের একটা তীব্র অভিমান ছিল। .... এছলামের আদর্শ এবং মুছলমানের দরদ ও অনুভূতি আজ তাঁহার কণ্ঠকে যে মুখরিত করিয়া তুলিতেছে, তাঁহাকে অন্তরের অভ্যর্থনা জানাইবার জন্য নজরুলের এই শ্রেণীর গজল, সঙ্গীত ও কবিতাগুলি আমরা মোহাম্মদীতে ছাপিবার ব্যবস্থা করিতেছি। এই সংখ্যা হইতে তাহার সূত্রপাত করা হইল।’১
প্রবাসী গোষ্ঠীর সাপ্তাহিক ‘শনিবারের চিঠি’র প্রধান কাজই ছিলো নজরুলের বিরুদ্ধাচরণ ও ব্যঙ্গ বিদ্রুপ। এই সব প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করেই নজরুল উঠে এলেন বাঙালি জাতিসত্তার ডাক দিয়ে মহানায়কের দৃপ্ত পদচারণায়।এই প্রতিক্রিয়াশীল বিরুদ্ধবাদীরা সব জায়গাতেই তৎপর। এদেরই বশংবদরা রাজনৈতিক স্বার্থে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায়, ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বর্জন করে। অথচ ধর্মের সবচেয়ে বড় শিক্ষাই হচ্ছে নিরপেক্ষতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থান। যারা এসব উদ্যোগ নিচ্ছে, তাদের মধ্যে হিন্দু বা মুসলমান কোন বৈশিষ্ট্যেরই অস্তিত্ব নেই। কারণ এরা ছাত্রজনতার মিছিলের উপর ট্রাক তুলে দেয়, গুপ্তহত্যার মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষ খুন করে। কোন ধর্মেই এই শিক্ষা নেই। এগুলো এরা করেছে রাজনৈতিক স্বার্থে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার অসৎ উদ্দেশ্যে।১৯৪৭ এ দেশভাগের পর পূর্বপাকিস্তানে এরাই সেদিন বাঙালির ভাষা ধ্বংসের উদ্যোগ নিয়েছে। উচ্চারণ ঠিক রেখে বাংলার স্থলে আরবি হরফ ব্যবহারের অপচেষ্টা করেছে। রবীন্দ্র বর্জন আন্দোলনের সূচনা করে পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের স্তাবকতায় লিপ্ত হয়েছে। বর্তমান পশ্চিমবাংলায় জন্মগ্রহণকারী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে হিন্দুস্থানের হিন্দু কবি হিসেবে তকমা পরিয়ে তাঁর প্রতিপক্ষ রূপে পাকিস্তানের মুসলমানদের কবি হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছে পশ্চিমবাংলাতেই জন্মগ্রহণকারী নজরুল ইসলামকে। কি নির্মম কদাচারে পূর্ণ সেই চাটুকারিতা। ঐ উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য নজরুলের কবিতা- গানকেও এরা তাদের ভাষায় তথাকথিত ইসলামীকরণের প্রয়াস চালিয়েছে। সনাতন ঐতিহ্যাশ্রয়ী ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক শব্দ ও রচনা বাদ দিয়ে তারা খণ্ডিত মুসলমান নজরুলের জন্ম দিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু সফল হয়নি। আবহমান বাংলা ও বাঙালি তা গ্রহণ করেনি।
পশ্চিমবাংলার বাঙালিরা এত অনাসৃষ্টির ঝামেলায় জড়িয়ে নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেননি। বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করেও হিন্দির অব্যাহত আগ্রাসন মোকাবিলায় ক্লান্ত এই কবিপ্রেমিরা কিছু গান শোনা ছাড়া নজরুল চর্চার ধারে কাছেও যাননি। গোড়ায় গলদ থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে সেহেতু অনাসৃষ্টির অভিযোগ আসছে না। ফলে কবি অসুস্থ হওয়ার পরপর নজরুল চর্চা ও অসুস্থ নির্বাক কবির জীবনে ১৯৪২ সাল থেকেই নেমে আসে অন্ধকার যুগ। মহাযুদ্ধ সংকটকে এর অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা গেলেও কিছুতেই দায় এড়ানো সম্ভব নয়। কারণ নজরুল চর্চা ব্যতীত আর সব কাজই কম বেশি চলেছে। একমাত্র নজরুল জন্মজয়ন্তী কমিটি কবির জন্মজয়ন্তী উদযাপন ছাড়া এসময় তেমন গুরুত্বপূর্ণ আর কোন কাজই করতে পারেনি।
আমাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে যে, নজরুল চর্চা মানে কেবল জন্মজয়ন্তী পালনকে বোঝায় না। অথবা নজরুলের গানের প্রসার দ্বারাও নজরুল চর্চার ব্যাপকার্থের প্রতিনিধিত্ব দাবি করা চলে না। যদি সে গান হয় বাণী ও সুরের বিকৃতিতে পূর্ণ। এখানে যারা নজরুলের গানের চর্চা নিয়ে গর্ববোধ করেন, তাদের জন্য কবি স্বয়ং একটি দুঃসংবাদ রেখে গেছেন। মঞ্চ বা সভা-সমাবেশের কথা ছেড়েই দেয়া যাক। প্রতিদিন রেডিওতে নিজের গানের বাণী ও সুরের বিকৃতিতে ক্ষুব্ধ কবি সাপ্তাহিক ‘নবশক্তি’ পত্রিকার ২৩ আগস্ট ১৯২৯ সংখ্যায় লিখেছিলেন,‘ ... আমার নিজের দিক থেকে কিন্ত স্পষ্ট গোটা কতক কথা বলবার আছে এ নিয়ে। তার কারণ আমার গান প্রায় প্রত্যহই কোন না কোন আর্টিস্ট রেডিওতে গেয়ে থাকেন এবং আমার সৌভাগ্যবশত তা শুনেও ফেলি। এক উমাপদ ভট্টাচার্য মহাশয় এবং কদাচিৎ দু-একজন গাইয়ে ছাড়া অধিকাংশ ভদ্রলোক বা মহিলা আমার গান ও সুরকে অসহায় ভেবে (বা একা পেয়ে) তার পিণ্ডি এমন করেই চটকান যে মনে হয় ওর গয়ালাভ এখানেই হয়ে গেল। সে একটা রীতিমতো সুরাসুরের যুদ্ধ।’২কবির এই খেদোক্তিতে তাঁর গানের করুণাবস্থার সঙ্গে সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আরো যে একটি নতুন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাহলো নজরুল সঙ্গীতের প্রায় অধিকাংশ গবেষকেরই অভিমত যে, তাঁর গানের বাণী ও সুরের বিকৃতি শুরু হয়েছে ১৯৪২ সালে অসুস্থ হওয়ার পর। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। কবির জীবদ্দশাতেই বেসরকারিভাবে জাতীয় সংবর্ধনা পাবার আগেই নিয়মিত রেডিওতে তাঁর গান প্রচারিত হচ্ছে এবং সমতালে তার বাণী ও সুরের বিকৃতিও ঘটছে।
মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে সরকারি আনুকূল্য অর্জনের অভিযোগে প্রতিক্রিয়াশীলরা যতটা তৎপর ছিলো, নজরুলের ক্ষেত্রে তাদের ততটা তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি। তাদের দুর্ভাগ্য যে, নজরুল ইসলামের প্রায় সব বিখ্যাত ও উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় বইগুলোই শাসক ব্রিটিশরা বাজেয়াপ্ত ও নিষিদ্ধ করে। বইগুলো হচ্ছে, ‘যুগবাণী’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘দুর্দিনের যাত্রী’, ‘প্রলয়শিখা’ এবং ‘চন্দ্রবিন্দু’। শেষপর্যন্ত বাজেয়াপ্ত বা নিষিদ্ধ হয়নি কিন্তু এ উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকার চিহ্নিত করেছিলো এ ধরনের গ্রন্থগুলো হচ্ছে ‘অগ্নিবীণা’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণি-মনসা’, ‘রুদ্রমঙ্গল’, ‘সঞ্চিতা’ ও ‘কুহেলিকা’।
একজন লেখকের এতগুলো বই বাজেয়াপ্তির ঘটনা কেবল ব্রিটিশ ভারতেই নয়-সমগ্রবিশ্বেও বিরল। কিন্তু এদেশে একমাত্র নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রেই তা ঘটেছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে চরমভাবে লাঞ্ছিত দেশের স্বাধীনতা প্রয়াসী এই বিপ্লবী কবিকে যতটুকু মর্যাদা দেওয়া অপরিহার্য ছিলো বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে, বাস্তবিক তা দেয়া হয়নি। প্যান ইসলামীকরণের উদ্যোগ বা মঞ্চ নির্মাণ দ্বারা মর্যাদা দেয়া সম্ভবও নয়। এগুলো হচ্ছে অশিক্ষিত মূর্খ দেশবাসীকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা। যে অসহায় মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন কবি সেই মানুষগুলো আজো খেতে পায় না, লজ্জা নিবারণের অত্যাবশ্যকীয় এক টুকরো কাপড় ব্যতীত তাদের শীতবস্ত্র নেই, ঈদ-পার্বণ-পূজায় তার ঘরে আজো উৎসবের ছোঁয়া লাগে না এবং প্রতিনিয়তই বাড়ছে এদের সংখ্যা। অন্যদিকে ধনপতি পুঁজির কুমিরেরাও বেড়েই চলেছে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে অর্ধশতাধিক বছর আগে, অথচ প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে আজো তাদের প্রতিনিধিরাই এদেশকে শাসন করছে। তার উপর যে কবি আজীবন আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন, দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতিরই সেই আমলাতন্ত্রের হাতেই দুই দেশেই আজ দায়িত্ব বর্তেছে নজরুল বিষয়ক কার্যক্রম সম্প্রসারণের। এই আমলাতন্ত্র এবং পুঁজিবাদী বুর্জোয়া সমাজ তাই প্রকৃত নজরুলকে আড়াল করতে চাইবে, তাতে আর সন্দেহ কি? তার উপর নজরুলকে ইসলামীকরণের প্রবক্তাদের আশংকা, তাঁর বিপ্লবী স্বভাব ও ভণ্ড-ধর্মাচারী, মৌলবাদী কাঠমোল্লাদের স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াসটি সাধারণ জনগোষ্ঠীর গোচরীভূত হলে, তাদের অবস্থানের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়ে সৃষ্টি করতে পারে সমূহবিপদের আশঙ্কা। একইভাবে অপর গোষ্ঠী দেখছেন, নজরুলের এই বিপ্লবাত্মক স্বদেশপ্রেম চেতনা ও রাজনৈতিক ভূমিকাটিকে নাড়াচাড়া করতে গেলে অনেকের আগেই নামোচ্চারিত হবে নজরুলের। এরা যদি নেতাজী সুভাষ বসুর মন্তব্যটি আত্মস্থ করতে পারতেন, তা হলে বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও নজরুল ইসলাম প্রকৃত সমাদর লাভ করতো। ১৫ ডিসেম্বর ১৯২৯ সালে কলকাতার এলবার্ট হলে বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে নজরুল ইসলামকে প্রদত্ত সংবর্ধনা সভায় নেতাজী মন্তব্য করেন, ‘নজরুলকে বিদ্রোহী কবি বলা হয়-এটা সত্য কথা। তাঁর অন্তরটা যে বিদ্রোহী তা স্পষ্টই বোঝা যায়। আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাব, তখনও তাঁর গান গাইব।’২ নজরুল ইসলামের স্বাতন্ত্র্য কোথায়? এত আলোচনার পর এই প্রশ্ন আসতেই পারে। বিদ্রোহী কবি হিসেবে তাঁর একটি অনন্য সাধারণ পরিচয় গড়ে উঠলেও তার স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াসটি দীর্ঘ নয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলায় মুষ্টিমেয় নিবেদিতপ্রাণ গবেষক নানা প্রতিকূলতার মোকাবিলা করেও ব্যক্তিগত চেষ্টায় নজরুল সাহিত্যের স্বরূপ উন্মোচনের প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন।সমকালে সমগ্র বাংলাদেশে কবির যে গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা গড়ে উঠেছিলো, তা কেবল তাঁর কবিতা-গানের জন্যই নয়। আরো অন্য কিছু অন্যরকম বিস্তৃত সে ভূমিকা। রাজনৈতিক-সামাজিক ঐ সব কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের তরুণ-যুব সম্প্রদায়ের চোখের মণি হয়ে উঠেছিলেন কবি সেদিন। তাঁর এসব ভূমিকার চারণক্ষেত্র ছিলো সমকালীন পত্র-পত্রিকা, স্বদেশী মঞ্চ এবং কংগ্রেস ও বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দল।
যদিও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে যে, কিছু পত্রিকা নজরুল ইসলামকে অপাঙক্তেয় ঘোষণা করেছিলো। তা সত্তেও সমকালের অধিকাংশ-পত্রিকাগুলোই বলতে কি নজরুল ইসলামকে নিয়ে প্রবল এক উন্মাদনায় মেতে উঠেছিলো। ঐরকম প্রবল ঝড়ের আলোড়ন তুলেই যে আর্বিভূত হয়েছিলেন কবি। শৃঙ্খল মুক্তির তাগিদে, নতুন সৃষ্টির নেশায় তোলপাড় করে বেরিয়েছেন সব। তাঁর এই দুর্গম গিরি লংঘনের সহযোগী হয়েছিলো সমকালের বেশ কিছু পত্রিকা। এসব পত্রিকা-সাময়িকীর নজরুল মনষ্কতা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে গত অর্ধশতাব্দীরও অধিককাল যাবৎ। যদিও এক্ষেত্রে উদ্যোক্তা গবেষকের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত। ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে কবি আবদুল কাদির সম্পাদিত যে নজরুল রচনাবলি প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে প্রকাশিত রচনাগুলোর সূত্রনির্দেশ কালে অর্ধশতাধিক পত্রিকা-সাময়িকীর নাম ও প্রকাশকাল সংযুক্ত হয়েছে। ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমি ঐ রচনাবলির ৪ খণ্ডে যে নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে, তাতে পুনশ্চঃ পর্বে আরো বেশকিছু পত্রিকার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র’ গ্রন্থটিতেও মুসলমান পরিচালিত সাময়িকপত্রে নজরুলের রচনা প্রকাশের তথ্যগুলো যত্নের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তবে সাময়িকপত্রের সঙ্গে নজরুল সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে প্রথম স্বতন্ত্র গ্রন্থ অধ্যাপক মুস্তাফা নূর উল ইসলাম সম্পাদিত ‘সমকালে নজরুল ইসলাম’। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী বইটি প্রকাশ করে। এতে ৭৪টি পত্রিকা-সাময়িকী থেকে নজরুল সম্পর্কিত মন্তব্য ও সারাংশ উদ্ধৃত হয়েছে। এটি এ ধরনের বড় মাপের প্রথম কাজ। এরপর ১৯৯৪ সালে ঢাকার নজরুল ইনস্টিটিউট প্রকাশ করে অধ্যাপক মোবাশ্বের আলীর ‘নজরুল ও সাময়িকপত্র’। এতে ২৩টি সাময়িকপত্রের সঙ্গে নজরুল সংশ্লিষ্টতা ও প্রকাশিত রচনার বিবরণ পর্যালোচিত হয়েছে।
বর্তমান প্রাবন্ধিক ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন গ্রন্থাগার, গবেষক, বিশিষ্ট সংবাদপত্র কর্মী ও রাজনীতিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য দ্বারা ১৩১টি পত্রিকার একটি তালিকা প্রণয়ন করেন। যাতে কবির লেখা প্রকাশিত হয়েছে বা কবি সম্পর্কে মত ব্যক্ত হয়েছে। চিহ্নিত কিছু স্থানে সময়ের স্বল্পতার জন্য অনুসন্ধান বাকি রয়েছে। অবশিষ্ট কাজ সম্পন্ন হলে আশা করা যায় ঐ তালিকাটি আরো বাড়বে। কেবল তালিকা সংগ্রহের মধ্যেই নজরুল গবেষণার এই ক্ষেত্র সমৃদ্ধ নয়, এসব পত্রিকায় প্রকাশিত কবির অধিকাংশ রচনাই যে আজো অগ্রন্থিত, সেই আশাপ্রদ ও উপাদেয় তথ্যটিও সংকলিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ ধরনের ১৪টি রচনা সংগৃহিত হয়েছে। আশা করা যায়, এ ধরনের অগ্রন্থিত রচনার সংখ্যা বাড়বে।
মতাদর্শগত ভিন্নতার কারণেই ১৩১টি কাগজের সবগুলোতে নজরুলের বিপ্লবাত্মক ও সমাজমনস্ক লেখা প্রকাশিত হয়নি। এ ধরনের পত্রিকার সংখ্যা হাতে গোনা, মাত্র ২০ থেকে ২৫টি। বাকিগুলোতে প্রেম-প্রকৃতি চেতনা ও অন্যান্য ভাবধারার রচনা প্রকাশিত হয়। যেমন ‘মোহাম্মদী’। কবির শুধুমাত্র গজল গান ও ধর্ম সঙ্গীত ছেপেছে। আবার ‘সওগাতে’র কথা ধরাযাক। সম্পাদক নাসিরউদ্দীন তাঁর ‘সওগাত যুগে নজরুল ইসলাম’ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, সাহিত্যিক জীবনের আর্বিভাব কালে ‘সওগাতে’র সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ট সংযোগ থাকলেও মাঝখানের কিছুকাল (১৯২০ সালের ‘নবযুগ’ থেকে ১৯২৫-২৬ সালের ‘লাঙল’ পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ হওয়া অবধি) তা ছিলো না। কারণ ঐ সময় কবির রাজনৈতিক মত ও পথ ছিলো ‘সওগাতে’র মত ও পথ থেকে ভিন্ন। অবশ্য যে সময়কালকে উদ্দেশ্য করে নাসিরউদ্দীন এই মন্তব্য করেন, তার অধিকাংশ সময়ই পত্রিকাটি বন্ধ ছিলো।
নবপর্যায়ে ‘সওগাত’ প্রকাশের পর নজরুল কিছুকালের মধ্যেই তাতে যোগদান করেন। চুক্তিপত্রের শর্তানুযায়ী এ সময় অন্য কাগজে কবি লিখতেন না। তবে ‘সওগাতে’ মুদ্রিত লেখা অন্য কাগজে পুর্নপ্রকাশিত হতে দেখা গেছে। ১৩১টি কাগজের মধ্যে সান্ধ্যদৈনিক ‘নবযুগ’ (১৯২০), অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ (১৯২২) সাপ্তাহিক ‘লাঙল’ (১৯২৫) নবপর্যায়ের দৈনিক ‘নবযুগ’ নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ও পরিচালিত কাগজ। এ ছাড়াও ‘মোসলেম ভারত (১৯২০), দৈনিক ‘সেবক’ (১৯২১), মাসিক ‘নওরোজ’ (১৯২৭) এবং নবপর্যায়ের ‘সওগাত’ (১৯২৭) এ বিভিন্ন সময় কবি লেখক হিসেবে চাকরি করেন। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’, প্রথম পর্যায়ের ‘সওগাত’, সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ ও সাপ্তাহিক ‘গণবাণী’র সঙ্গেও লেখক নজরুল জড়িত ছিলেন ঘনিষ্ঠভাবে।
১৯২০ সালে ‘মোসলেম ভারতে’ লিখে বাঙলার সাহিত্যিক পাঠক-সমাজে পরিচিতি অর্জন করলেও এবং ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি সাপ্তাহিক ‘বিজলী'তে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশ করে দেশজুড়ে ‘বিদ্রোহী কবি’র ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করলেও ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির মানস গঠনকাল ১৯২০ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা ‘নবুযাগ’। তাঁর গরম গরম প্রতিবাদী চেতনার লেখার জন্যই ‘নবযুগ’ সেদিন জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে অনতিকালের মধ্যে রাজরোষ কবলিত হয়। এই ‘নবযুগে’র বিপ্লবাত্মক চেতনাই কবিকে চালিত করেছে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। এই কাগজের প্রতিবাদী লেখাগুলোই ছিলো প্রকৃতপক্ষে ভাবী বিদ্রোহী ও বিপ্লবী কবি নজরুল ইসলামের লড়াইয়ের প্রস্তুতি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে শর নিক্ষেপের আয়োজন। ঐ যুদ্ধ শুরু হলো তাঁর ১৯২২ সালের আগস্টে অর্ধসাপ্তাহিক ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে।
পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির সংগ্রামে আত্মোৎসর্গী সশস্ত্র বিপ্লবীদের এই কাগজে কবি ‘নাগশিশু’ সম্বোধন করে বিবর থেকে বেরিয়ে আসার আহŸান করলেন। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতায় কামনা করলেন দেশোদ্ধারে আত্মোৎসর্গের যজ্ঞ। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশকে চিহ্নিত করলেন অত্যাচারী শক্তি চাড়াল হিসেবে এবং সেই প্রবল উত্তাপ-উন্মাদনার মধ্যেই ‘ধূমকেতুর পথ’ প্রবন্ধে প্রথম প্রকাশ্যে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে লিখলেন, ‘সর্বপ্রথম, ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা, ও-কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা-রক্ষা, শাসনভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়ের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যাঁরা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ-দেশে মোড়লী ক'রে দেশকে শ্মশান-ভূমিতে পরিণত করছেন, তাঁদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকা-পুঁটলি বেঁধে সাগর-পারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন নিবেদন করলে তাঁরা শুনবেন না। তাঁদের অতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদেরও এই প্রার্থনা করার ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকুকে দূর করতে হবে।
পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে সকলের আগে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সকল-কিছু নিয়ম-কানুক বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।’ নজরুল ইসলাম কখন, কোন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ঘোষণা দিচ্ছেন, যখন কিছুকাল আগে মাত্র (১৯২১) কংগ্রেসের রুদ্ধদ্বার অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করায় গান্ধীজী উর্দু কবি হসরত মোহানীকে তিরস্কার করেন এবং দলীয় সিদ্ধান্তের পরিবর্তে ব্যক্তিগতভাবে আইন অমান্য আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। মুসলিম লীগ বা স্বরাজ্য দলও প্রত্যক্ষ আন্দোলনে না গিয়ে অটোমেটিক স্বরাজের স্বপ্নে ছিলো বিভোর এবং ভারতীয় সংবাপত্রের ইতিহাসে তখন চলছে সর্বাধিক ক্রান্তিকাল ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ সম্পাদক মহাত্মা গান্ধী এবং প্রকাশক শংকরলাল বাঙ্কার, মাদ্রাজের ‘কোয়ামি রিপোর্টে’র সম্পাদক এল.এম. গোলাম মহম্মদ, ‘হিন্দুস্তান’ সম্পাদক ললিতমোহন গুপ্ত, জব্বলপুরের হিন্দু সাপ্তাহিক ‘তিলক’ সম্পাদক, কলকাতার বাংলা দৈনিক ‘বন্দেমাতরমে’র প্রকাশক পঞ্চশীথ ভট্টাচার্য, সিন্ধু হায়দরাবাদের ‘হিন্দু’ সম্পাদক জেঠানন্দ, ‘শক্তি’ সম্পাদক ক্ষেমচাঁদ বাজনী, ‘বন্দেমাতরমে’র সহকারি সম্পাদক লালা রামপ্রসাদ, চট্টগ্রামের ‘জ্যোতি’ সম্পাদক কালীশংকর চক্রবর্তী ও মহমম্দ কাজিম আলি, বার্মার ‘রেঙ্গুন মর্ডান টাইমস’ ও ‘নলেজ’ প্রকাশক এসময় রাজদÐে দÐিত ও করারুদ্ধ হন। দেশের বাঘাবাঘা এইসব লেখক-সাংবাদিকের পরিণতি দেখেও কিন্তু কবি পিছপা হলেন না। বরঞ্চ তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করলেন। ডাক দিলেন পূর্ণ স্বাধীনতার। কামানের গোলা আর আগুনের দাবদাহের চাইতেও প্রচণ্ড শক্তি ও উত্তাপে নজরুলের বিপ্লবাত্মক-বিদ্রোহ চেতনা সেদিন আঘাত করেছে ব্রিটিশ রাজশক্তিকে। ২৩ বছরের যুবক নজরুলের এই রণঝঙ্কার সেদিন রাজনৈতিক দলগুলোর রণকৌশলনকেও হার মানিয়ে ছিলো।
কোথায় পেলেন নজরুল এই অমিতবিক্রমী তেজ, মুক্তিক্ষুধা। স্বশিক্ষা, নিপীড়ন বঞ্চনার শতাব্দীর ইতিহাস পাঠ আর বিপ্লবাত্মক জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতো বটেই, বিশিষ্ট বিদ্বগ্ধজনের অনুপ্রেরণাও তাঁকে এই বিদ্রোহী কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করেছে। ‘ধূমকেতুর পথ’ প্রবন্ধের ঠিক আগের সংখ্যাতেই নজরুলকে দেশের স্বাধীনতা দাবি করার আহ্বান জানিয়ে চিঠি প্রকাশিত হতে দেখা যায়। দুর্দিনের দুর্গশিরে বিজয় কেতন উড়িয়ে চমক মেরে অর্ধচেতনকে জাগিয়ে তোলার আহ্বান করে কবিগুরুও সেদিন ‘ধূমকেতু’র অগ্নিযাত্রাকে আর্শীবাদ করেছিলেন। ‘ধূমকেতু’র ২য় সংখ্যা ২০ শ্রাবণ ১৩২৯ থেকে পরবর্তী সবগুলো সংখ্যার মুখপাতে এই আর্শীবাণীটি উদ্ধৃত হয়েছে।
ব্রিটিশ রাজত্ব আর কালবিলম্ব করলো না। জ্বালাময়ী রচনা নিয়ে প্রকাশিত পত্রিকার ঐ সংখ্যাগুলো বাজেয়াপ্ত করে কবিকে কারারুদ্ধ করলো। সরকার বুঝতে পারছিলো ‘নবযুগে’র মতো কেবল সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বা জামানত বাজেয়াপ্ত করে সত্যোচ্চারণের এই যন্ত্রটি বিকল করা যাবে না। তাই সরাসরি এবার কবির উপরই খড়্গ ফেললো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, কবিকে কারারুদ্ধ করার পর সেদিন কোন রাজনৈতিক দলই ন্যূনতম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। কারণ তাঁর দূরদর্শি রাজনৈতিক মেধা ও প্রজ্ঞা। তাঁর স্বাধীনতার ডাক সেদিন রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকাকে খাটো করেছিলো নিঃসন্দেহে। তাই তারা ঈর্ষান্বিত ছিলো এই উদ্দাম বিপ্লবী যুবক কবির প্রতি। অবজ্ঞাও হয়তো ছিলো। যার জন্য কারাগারে নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদে টানা ৩৯ দিনের অনশনে কবি যখন মৃত্যুন্মুখ, তখনো এই রাজনীতিকরা টুঁ-শব্দ করেননি। কবিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেননি। কিন্তু জনতার স্রোতকে সেদিন দাবিয়ে রাখা যায়নি।
সংবাদপত্র পরিষদের উদ্যোগে কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনতার বিশাল সমাবেশে কবিকে অনশন ত্যাগের আবেদন জানানো হয়। সভার তারিখ ২১ মে ১৯২৩। বিকেল সাড়ে ৫টা। চিত্তরঞ্জন দলীয়ভাবে স্বরাজ্য দলের নেতা হিসেবে উক্ত সভায় আসেননি। ব্যক্তিগতভাবেই অংশগ্রহণ করেন। কবি অনুরাগী রাজনীতিক হেমন্তকুমার সরকার, হরিদাস হালদার, বৈরাগী ত্রিপাঠী, অতুলচন্দ্র সেন, ভারতীয় সংবাদপত্র সংস্থার সম্পাদক মৃণালকান্তি বসু, ‘ছোলতান’ পত্রিকার সম্পাদক মনিরুজ্জামান এছলামাবাদী প্রমুখ সভায় বক্তৃতা করেন। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ২৩ মে ১৯২৩ সংখ্যা জানাচ্ছে, ঐ সভার অনুরোধ নিয়ে ডাক্তার আবদুল্লাহ সহরাওয়ার্দ্দী, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির মৌলভী উমেদ আলী, ‘মোহাম্মদী’র সহকারী সম্পাদক ওয়াজেদ আলী, ‘যুগান্তর’ সম্পাদক বীরেন্দ্রকুমার সেন, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, আফজালুল হক ও সুলতান আহমদ হুগলি জেলে কবির সঙ্গে দেখা করতে গেলে একমাত্র আবদুল্লাহ সহরাওয়ার্দ্দী ব্যতীত আর কেউই সাক্ষাতের অনুমতি পাননি। ঐ দিনই কবির ধর্ম মা বিরজাসুন্দরী দেবী কুমিল্লা থেকে এসে কবির অনশন ভাঙান। এই ঘটনার আগে রবীন্দ্রনাথও সাহিত্যের দাবিতে অনশন ত্যাগের অনুরোধ জানিয়ে প্রেসিডেন্সি জেলের ঠিকানায় কবিকে তারবার্তা প্রেরণ করেন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ ঠিকানা ভুল বলে তা ফেরৎ পাঠিয়েছে।
‘ধূমকেতু’ মামলায় কারাভোগের পর নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক মত ও পথে কৌশলগত পরিবর্তন ঘটে। ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে নজরুল ইসলামের নামে ৭নং প্রতাপচাটুজ্যে লেন, কলকাতার ঠিকানাথেকে প্রকাশিত শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ-সম্প্রদায়ের ঘোষণাপত্রে স্বাধীনতা আন্দোলনে বোমা পিস্তলের সশস্ত্র ত্রাসনীতির অব্যাহত ব্যর্থতার ফলে বিকল্প শক্তি হিসেবে গণআন্দোলন সূচনার তাগিদ তুলে ধরা হয়। বৃহৎ জনগোষ্ঠী তথা শ্রমিক-কৃষক-মজুর শ্রেণী, যারা মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ-তাদের নিয়ে এই আন্দোলন সূচনার সংগ্রামে কবি প্রথম প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক কার্যক্রমেও ঝাঁপিয়ে পড়েন। এর আগে পর্যন্ত বিচ্ছিন্নভাবে কিছু রচনায় সাম্যবাদী চেতনার স্ফূরণ ঘটলেও ওই সময় ‘লাঙল’ পত্রিকাতেই কবি হয়ে ওঠেন পরিণত সাম্যবাদী। তাঁর বিখ্যাত ‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছ প্রথম এই কাগজেই প্রকাশিত হয়। যেখানে কবি সর্বপ্রথম এদেশে প্রকাশ্যে সাম্যের গান গাইলেন। ঘোষণা করলেন মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান! নজরুল ইসলামের এই সাম্যবাদী চেতনা-যতটা না সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত, তার চেয়ে অধিক মানবতাবাদে অলংকৃত।
‘লাঙল’ বঙ্গীয় কৃষক-শ্রমিক দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র হিসেবে শ্রমজীবী নিরন্ন মানুষের স্বার্থের কথা বলে এং সাম্যবাদী ধারার রাজনীতিকে সমর্থন করে। কবির এই পর্বের মনোভূমির একদিকে যেমন সমাজ ও রাজনীতি, অন্যদিকে তেমনি শোষিতের মুক্তি ও সাম্যবাদী সমাজের প্রত্যাশা। প্রবাসে, ১৯২০ সালে তাসখন্দে ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯২৬ সালে এদেশে প্রথম প্রকাশ্যে কম্যুনিস্টদের যে কানপুর কনফারেন্স হয়, তার বিস্তারিত বিবরণ ‘লাঙলে’ই প্রথম ছাপা হয় এবং ‘লাঙল’ই প্রথম ঘোষণা করে এদেশের আইন অনুযায়ী কম্যুনিস্ট আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট হওয়া কোন অপরাধ নয়।
১৯২৬-২৭ সালের সা¤প্রদায়িক দাঙ্গার সময় ‘লাঙল’ বন্ধ হয়ে যায় এবং কিছুকাল পর ‘গণবাণী’ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই কাগজে কবির সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো প্রকাশিত হয়। ‘লাঙলে’ সাম্যবাদী ধারার গণআন্দোলনের ডাক নিয়ে অগ্রসর হলেও বিপ্লবাত্মক চেতনাকে কবি কখনোই পরিহার করেননি। ‘নওরোজ’ এবং পরবর্তীতে সাপ্তাহিক ‘সওগাতে’ প্রকাশিত ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসের বিপ্লবাত্মক পটভূমি এবং প্রায় একই সময় মাসিক ‘সওগাতে’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসের নায়ক আনসারের হাতের খেলনা পিস্তল এবং ১৯৩১ সালে প্রকাশিত ‘প্রলয় শিখা’ কাব্যের বিপ্লব ধর্মই তার প্রমাণ।
‘ধূমকেতু'তে স্বাধীনতার ডাক-দিয়ে যার শুরু, ‘প্রলয় শিখা’তে পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের সর্বাত্মক বিদ্রোহের তাগিদ দিয়ে তিনি তার পরিণতি দেখতে চাইলেন। ১৯৪০ সালে মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হকের কাগজ দৈনিক ‘নবযুগ’ এ প্রধান সম্পাদক হিসেবে যোগদানের পর নজরুলের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় জাতিসত্তার শেকড় অনুসন্ধানের প্রবণতা। ১৯৪১-৪২ এর মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের হিন্দুস্তান-পাকিস্তান সৃষ্টির ডামাডোলে বাঙালিকে কবি উদ্বুদ্ধ করেন জাতিসত্তার অনুসন্ধিৎসায়। পাকিস্তান আন্দোলনের হোতা মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাকে কাফের এবং প্রস্তাবিত পাকিস্তানকে ‘ফাঁকিস্তান’ মন্তব্য করেন। মুসলিম লীগ শিবিরে এই বক্তব্য তাণ্ডবের সূত্রপাত করে। যার কাগজে চাকরি তার বিরুদ্ধেই লেখা। এই উষ্মার উত্তাপ ক্রমে কবিকে নানাভাবে স্পর্শ করতে থাকলে তিনি ‘নবযুগ’ ত্যাগ করেন। ঘটনা ছিলো এরকম, হক সাহেব গোপনে বড়লাটের সঙ্গে যোগাযোগ করে সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্য হতে চাইলে জিন্না তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। দীর্ঘ ২/৩ বছর কাঠখড় পুড়িয়ে হক সাহেব যখন জিন্নার সঙ্গে এই শীতল সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে যাচ্ছেন, সে সময় তারই কাগজে জিন্নাকে কাফের ও পাকিস্তানকে ‘ফাঁকিস্তান’ মন্তব্য করায় ভেঙ্গে যায় ঐ আপোস রফার উদ্যোগ। হক অনুসারীরা এ কারণেই কবির উপর ক্ষিপ্ত হয়।
‘নবযুগ’ ত্যাগ করার আগে, পরিস্থিতি ঘোলা হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটেই কবি লিখলেন ‘বাঙালির বাঙলা’ শীর্ষক বাঙালি জাতিসত্তার শেকড় নির্দেশক ঐতিহাসিক প্রবন্ধটি। এর আগে বাঙালি ছিলো মোঘল ও ব্রিটিশের প্রজামাত্র। কবি বাঙালিকে এই পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য তার সামনে অতীত ঐতিহ্যকে উপস্থাপন করে বলেন,‘বাঙালি শুধু লাঠি দিয়েই দেড়শত বছর আগেও তার স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চেষ্টা করেছে। আজো বাঙ্লার ছেলেরা স্বাধীনতার জন্য যে আত্মদান করছে, যে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, ইতিহাসে তা থাকবে স্বর্ণ লেখায় লিখিত। বাংলা সর্ব ঐশীশক্তির পীঠস্থান। হেথায় লক্ষ লক্ষ যোগী, মুনি, ঋষি, তপস্বীর পীঠস্থান, সমাধি, সহস্র সহস্র ফকির দরবেশ ওলী গাজীর দর্গা পরম পবিত্র। হেথায় গ্রামে হয় আজানের সাথে শঙ্খ ঘন্টার ধ্বনি। এখানে যে শাসনকর্তা হয়ে এসেছে, সেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বাংলার আবহাওয়ায় আছে স্বাধীনতামন্ত্রের সঞ্জবনী শক্তি। আমাদের বাংলা নিত্য মহিমাময়ী, নিত্য সুন্দর, নিত্য পবিত্র। ... বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে, ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।’
বাঙালির দিব্যজ্ঞান তার ক্ষাত্রশক্তি বিকাশে প্রধান প্রতিবন্ধক হয়েছে বলেই সে সৈনিক হতে পারেনি সত্য, তবে তার স্বাধীনতার আকাঙ্খা বরাবরই তাকে বিপ্লবী ধারণায় উজ্জীবিত করেছে। নজরুল ইসলামের বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকাশের এই তাগিদ সেদিন বাঙালির সামনে ছিলো প্রথম প্রেরণা। এর আগে পর্যন্ত এদেশের কোন লেখক-রাজনীতিকই এমন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের শেকড় অনুসন্ধানের কথা বলেননি। তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা বিকাশের ক্ষেত্রে নজরুল ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু বাঙালিরই দুর্ভাগ্য যে, ‘বাঙালির বাঙলা’ রচনার অল্পকালের মধ্যেই কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাঙালির স্বপ্ন বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তাই আরো ২৪টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আজ সেই বাঙালির বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।৩
১.মোহাম্মদী’র ৫ম বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা ১৯৩২ এর ‘নজরুল এছলাম’ শীর্ষক দুর্লভ সম্পাদকীয় উদ্ধৃতাংশটি বহরমপুর থেকে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক কবিতা পত্রিকা ‘অর্কেষ্ট্রা’র সম্পাদক সৈয়দ খালেদ নৌমান এর সৌজন্যে প্রাপ্ত।
২.সাপ্তাহিক ‘নবশক্তি’, ২৩ আগস্ট ১৯২৯। কবির এই প্রতিক্রিয়াটি নলিনাক্ষের খুড়তুতো ভাই শশাঙ্ক সান্যালের ‘কাজী নজরুল ইসলাম ও ফেনুদা’ শীর্ষক প্রবন্ধে প্রথম উদ্ধৃত হয়। কলকাতার নবজাতক প্রকাশকের প্রবন্ধ সংকলনেও (১৯৭৮) তা গ্রথিত হয়েছে (পৃঃ ১০৪)।
৩.বহরমপুর থেকে সরেজমিনে তথ্যানুসন্ধানে সর্বাত্মক সহায়তা করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন এম.এ. ১ম পর্বের ছাত্র বর্তমানে ঐ বিভাগের শিক্ষক কবি আবদুল কাফী এবং ইংরেজী বিভাগের তৎকালীন দ্বিতীয় বর্ষ অনার্সের ছাত্রী নিরুপমা চৌধুরী।
এইচআর/এমএস