পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সহযোগিতা চেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হামলার আতঙ্কে মার্কিন মিত্রের কাছে সহযোগিতা চান তিনি।
Advertisement
সফররত মার্কিন সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মুন জানান, সমস্যাটি অবশ্যই কূটনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।
তার প্রস্তাবে জেনারেল জোসেফ ডানফোর্ড জানান, কূটনৈতিকভাবে সংকট সমাধানকেই যুক্তরাষ্ট্র প্রাধান্য দেবে। তবে উত্তর কোরিয়ার চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য আগে থেকেই মার্কিন সেনাবাহিনী প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে।
সোমবার উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যদি কোনো যুদ্ধ হয় তাহলে সেটা হবে পারমাণবিক যুদ্ধ। একইদিন চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উত্তর কোরিয়াতে কোনো পণ্য রফতানি করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অবশ্য আগে থেকেই জাতিসংঘের আদেশে ওই ঘোষণা দিয়েছিল চীন।
Advertisement
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এবং উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের জেরে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উত্তর কোরিয়ার সর্বশেষ পারমাণবিক পরীক্ষার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সতর্ক করে দিয়ে বলেন, এতো অগ্নি এবং রাগ বিশ্ব অতীতে কখনও দেখেনি, সেরকমভাবে উত্তর কোরিয়াকে শায়েস্তা করা হবে।
উত্তর কোরিয়া প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপ গুয়ামে হামলা চালানোর হুমকি দেয়ার পর তিনি আরও বলেন, গুলিভর্তি বন্দুক তাক করা রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৮ হাজার পাঁচশ মার্কিন সেনাবাহিনী রয়েছে। প্রয়োজনে তাদের কাজে লাগানোর ইঙ্গিত দেন তিনি।
এরকম পরিস্থিতিতে বৈঠকের কথা বলছেন মুন। তার ভাষায়, দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ; আর শান্তি রক্ষা করা আমাদের সবচেয়ে বড় জাতীয় স্বার্থ।
তিনি আরও বলেন, আমি নিশ্চিত যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের নীতিমালার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে সুস্থির ও দায়িত্বের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে।
Advertisement
মুন বলেন, ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত কোরিয়া যুদ্ধে এক মিলিয়নের বেশি লোক প্রাণ হারিয়েছে, শহর ছাড়া হয়েছে বহু মানুষ এবং ভাগ হয়ে গেছে কোরিয়া। এবার সেরকম চান না তিনি।
কয়েক যুগ আগে কোরিয়া যুদ্ধে দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য এক লাখ ৭৮ হাজার দুইশ ৩৬ জন নিহত হয়েছে, ৩২ হাজার আটশ ৪৪ জন নিঁখোজ এবং পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার তিনশ ১৪ জন আহত হয়।
উত্তর কোরিয়া, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সৈন্য নিহত হয় চার থেকে পাঁচ লাখ, এক লাখ ৫২ হাজার নিঁখোজ এবং প্রায় সাত লাখ জন আহত হয়েছিল।
উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মোট নিহত ও আহতের সংখ্যা প্রায় আড়াই মিলিয়নে দাঁড়ায়। সেকারণে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চান না মুন জে-ইন। অবশ্য উত্তর কোরিয়া হামলা চালানোর পরই ওই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র ও এক সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তির প্রতিযোগিতা ও রাজনৈতিক মতানৈক্য তথা স্নায়ুযুদ্ধের কৌশলগত ভারসাম্যের বলি হিসেবে বিভক্ত হয়েছিল বিশ্ব। জার্মানি যেমন বিভক্ত হয় তেমনি বিভক্ত হয়েছিল কোরীয় উপদ্বীপ। উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে কোরিয়া যুদ্ধের সমাপ্তি হলেও বলা চলে আজও শেষ হয়নি সেই যুদ্ধ।
উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়কে ইঙ্গিত দিয়ে মুন বলেন, সব ধরনের উস্কানিমূলক মন্তব্য এখনই বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া পরিস্থিতি বেগতিক হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
মুন জে-ইনের কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে জেনারেল ডানফোর্ড মুনকে জানিয়েছেন কূটনৈতিকভাবে সংকট সমাধানকেই প্রাধান্য দেবে যুক্তরাষ্ট্র; তবে অর্থনৈতিকভাবে উত্তর কোরিয়ার ওপর তাদের নিষেধাজ্ঞা চলবে। অবশ্য সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি সম্পন্ন বলেও জানান তিনি।
জেনারেল ডানফোর্ড আরও বলেন, তিনি সেনাবাহিনীর একজন নেতা হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়াতে এসেছেন। প্রয়োজনে চীন এবং জাপানেও যাবেন তিনি। উত্তর কোরিয়ার বার্তা সংস্থা কেসিএনএ সোমবার সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, যদি যুদ্ধ শুরু হয় তাহলে সেটা হবে পারমাণবিক যুদ্ধ।
কেসিএনএ আরও জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের পৃথক সবরকম কর্মকাণ্ড আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।
গুয়ামে উত্তর কোরিয়ার চারটি মাঝারি ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিকল্পনার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আশঙ্কা, তারা কেবল ১৪ মিনিট সময় পাবে। তবে সেই হামলা থেকে যুক্তরাষ্ট্র গুয়ামকে রক্ষা করবে বলে বিশ্বাস সেখানকার অধিবাসীদের।
ট্রাম্প অবশ্য গুয়ামের লোকজনকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখুন। আপনাদের কিচ্ছু হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র আর উত্তর কোরিয়া একে অপরের সঙ্গে কার্যত বাকযুদ্ধ শুরু করেছে। দু’দেশের এমন পরিস্থিতিতে চীনের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ফোন করে সংযত থাকতে বলেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
চীনের সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে গত শুক্রবার বলা হয়েছে। যদি উত্তর কোরিয়া আগে হামলা চালায়, তাহলে চীন নিরপেক্ষ থাকবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি হামলা চালিয়ে এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করে, তাহলে চীন অবশ্যই তা প্রতিহত করবে।
এরই মধ্যে জাতিসংঘের নির্দেশে উত্তর কোরিয়ায় পণ্য রফতানি বন্ধ করেছে চীন। তবে সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া ঘুরে যাওয়ার পর রয়টার্সের একদল সাংবাদিক জানান, বাইরের দেশের ওপর নির্ভর না করে নিজেদের দেশেই পণ্য উৎপাদন করছে দেশটি। ফলে আমদানি বন্ধ হলেও সংকটে না পড়ারই কথা কিমের দেশের।
২০১৬ সালেই উত্তর কোরিয়ার সরকার ঘোষণা করেছিল যে, তারা হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা সফলভাবে করেছে। এবার তারা আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা সফল হওয়ার দাবি করেছে। ছোট্ট দেশ উত্তর কোরিয়া যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে শাসাচ্ছে, পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে; তাতে করে সামনে কী ঘটছে না দেখে অনুমান করার কোনো উপায় নেই। এখন দেখার বিষয়, কথার যুদ্ধ কূটনৈতিকভাবে সমাধান হয় নাকি আরেকটি যুদ্ধের সূত্রপাত করে।
সূত্র : বিবিসি
কেএ/এমএস