বিশেষ প্রতিবেদন

‘হেনস্তা’র জন্যই ৫৭ ধারায় মামলা

গত ২৩ এপ্রিল নতুনসময়-এ ‘ওয়ালটন মোবাইল ক্রেতাদের গলার কাঁটা’ শিরোনামে এবং ২৪ এপ্রিল ‘ওয়ালটন মোবাইলের ভোগান্তি, ক্ষোভে উত্তাল ফেসবুক’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ওই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ এপ্রিল রমনা থানায় ‘ওয়ালটনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে’- এমন অভিযোগ এনে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেন ওয়ালটন গ্রুপের আইন বিভাগের সহকারী পরিচালক টি এম আব্দুল্লাহ আল ফুয়াদ।

Advertisement

মামলায় আসামি করা হয় নতুনসময় ডটকমের সম্পাদক শওগাত হোসেন, নির্বাহী সম্পাদক আহমেদ রাজু ও ডেইলি শেয়ার বিজ’র নিজস্ব প্রতিবেদক নিয়াজ মাহমুদ সোহেলকে। ৩০ এপ্রিল চাঁদাবাজি ও হুমকি দেয়ার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা হয়।

মামলার পরিপ্রেক্ষিতে নতুনসময়’র নির্বাহী সম্পাদক আহমেদ রাজুকে আদালতের মাধ্যমে পরপর দু’দিন রিমান্ডে নেয়া হয়।

গত ১০ জুন রমনা থানার ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) মশিউর রহমান তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় আসামিদের অব্যাহতি দানের প্রার্থনা করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘আসামিদের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগে অভিযুক্ত করার মতো কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। এছাড়া আসামিপক্ষ ও কোম্পানির প্রতিনিধিত্বকারীরা স্থানীয়ভাবে আলোচনার মাধ্যমে উভয়পক্ষের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝির অবসান করে আপস-মীমাংসা করেছেন। তাই মামলার দায় থেকে আসামিদের অব্যাহতি প্রদানের আবেদন জানিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো।’

Advertisement

সম্প্রতি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরের সংখ্যা বাড়ছে। এ বছরের প্রথম ছয় মাসেই এই ধারায় দেশের বিভিন্ন জেলায় ২০টির বেশি মামলা হয়েছে। সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহল ধারাটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এই ধারায় মামলা হওয়ার পর যা হবার তা হয়েই যাচ্ছে। পুলিশের হয়রানি, সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন- কোনোকিছুই বাকি থাকছে না।

সাইবার ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত ৭৯টি মামলার রায় দিয়েছেন সাইবার ট্রাইব্যুনাল। বিচারাধীন রয়েছে ৫৫৪টি মামলা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত মামলাগুলো হেনস্তার জন্যই করা হয়েছে। মামলার পর সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না। ২০১৩-১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত সাক্ষী প্রমাণ খুঁজে না পাওয়ায় ৯৮টি মামলার আসামিদের অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

অধিকাংশ মামলার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মামলা প্রমাণের জন্য কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মূলত উভয়ের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণেই মামলা করা হয়।

Advertisement

এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেলী ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, ‘তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেক মামলা নেয়া হয়। বাদীরা যখন থানায় এসে মামলা নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করেন তখন পুলিশের কিছুই করার থাকে না। অধিকাংশ মামলা হেনস্তার জন্যই করা হয়।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়েরকারী অধিকাংশই সরকার দলের প্রভাবশালী ব্যক্তি। যে কারণে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই ছাড়াই মামলা গ্রহণে বাধ্য হন সংশ্লিষ্ট থানা কর্তৃপক্ষ।

সোহেলী ফেরদৌস এই ধারায় মামলার অপপ্রয়োগ বন্ধ প্রসঙ্গে বলেন, বর্তমানে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করতে হলে পুলিশ সদর দফতরের পরামর্শ নিতে হবে। পরামর্শ ছাড়া কোনো মামলা এজাহার হিসাবে নেয়া যাবে না। এতে হয়রানি অনেকটা কমে যাবে।

চূড়ান্ত প্রতিবেদন- ১ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক এবং সে দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করে হুমকি দেয়ার অভিযোগে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) এক ছাত্রী তার বন্ধুর বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেন। ২০১৬ সালের ২৭ এপ্রিল হাজারীবাগ থানায় বন্ধু শাতিল আরাফাত চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলাটি করেন ওই ছাত্রী।

২০১৭ সালের ৭ জানুয়ারি আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় অব্যাহতি প্রদানের আবেদন করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনটি দাখিল করেন হাজারীবাগ থানার উপ-পরিদর্শক মোজাফফর হোসেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘প্রকৃতপক্ষে কে বা কারা ওই ছাত্রীর অশ্লীল ডিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন তার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।’

চূড়ান্ত প্রতিবেদন- ২

‘মোটেও সত্য নয়’ এমন সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করায় ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর অনলাইন পত্রিকা ঢাকা টাইমস ডটকম’র সম্পাদকসহ দু’জনের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেন ঠাকুরগাঁও- ২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি)।

২০১৭ সালের ৩০ এপ্রিল মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বালিয়াডাঙ্গি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এ টি এম শিফাতুল মাজদার আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রমাণ না পাওয়ায় মামলার দায় হতে অব্যাহতির জন্য প্রার্থনা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন।

প্রতিবেদনে মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ‘পত্রিকার সম্পাদক ও প্রতিনিধি নিজের কোনো বক্তব্য প্রকাশ করে নাই। আসামিরা তাদের পেশাগত কাজে সংশ্লিষ্ট সবার কাছ হতে তথ্য প্রাপ্ত হয়ে প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে তাহারা নিজের কোনো মতামত প্রকাশ করেনি। বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি হবার কারণে বাদী মামলা করেন। তাই মামলার দায় হতে আসামিদের অব্যাহতি দানের প্রার্থনা করে চূড়ান্ড প্রতিবেদন দাখিল করিলাম।’

জাগো নিউজের তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেরিতে হলেও আসামিরা জামিন পাচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, অপরাধ যদি সত্যিই গুরুতর হয়, তাহলে জামিন হচ্ছে কী করে?

এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, কোনো অপরাধের শাস্তি দিতে আইন করতে হলে সেই অপরাধকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করতে হবে। সংজ্ঞায়িত না থাকলে আইনের অপপ্রয়োগ হতে বাধ্য। ফৌজদারি আইনে অপরাধ হচ্ছে, এতে যে ক্ষতি হচ্ছে তা দেখা যায়, বোঝা যায় এবং মাপা যায়। এখন কারও ভাবমূর্তি নষ্ট হলো এবং এর জন্য মামলা হলো; কার ভাবমূর্তি, কিসে নষ্ট হয় এবং তার পরিমাপ কী- তা যদি নির্ধারিত না হয়, তাহলে শাস্তি দেবেন কিসের ভিত্তিতে?

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, এই ধারায় যে অপরাধগুলোর কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করা হয়নি। যেমন ধরুন ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন’। এ দিয়ে কী বোঝা যায়? যেহেতু সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করা হয়নি, ফলে কেউ মনঃক্ষুণ্ন হলেই মামলা করছেন।

‘আইনটি যে অবস্থায় আছে এবং যেভাবে ব্যবহার হচ্ছে তা বিপজ্জনক’ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা বারবার বলছি কারও মানহানির অভিযোগে যেন ফৌজদারি মামলা না হয়।’

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ এবং পরবর্তীতে আসামিদের অব্যাহতি প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগরের সাবেক পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) ফারুক আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, আইন মেনে আইসিটি মামলা দায়ের করা হয় না। মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে বাদীরা আইনের অপপ্রয়োগ করেন। অন্যকে হেনস্তা/হয়রানি করার জন্যই এই আইনের অপপ্রয়োগ করা হয়।

আইনজীবী হেলাল উদ্দিন বলেন, এই আইনে মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় না। পুলিশও মামলা নেয়ার ক্ষেত্রে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে না। এ কারণে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। একটু সচেতন হলেই এটি রোধ করা সম্ভব।

৫৭ ধারায় যা বলা হয়েছে

তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।’ এই ধারার অপরাধগুলো আমলযোগ্য ও অজামিনযোগ্য। তবে আদালতের বিবেচনায় আসামি জামিন পেতে পারেন।

৫৭ ধারায় শাস্তি

আইসিটি আইনে ৫৭ ধারার অপরাধের জন্য অনধিক ১৪ বছর ও অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে।

জেএ/এমএআর/জেআইএম