আর এক বছর পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন উপলক্ষে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ছোট দলের নেতাকর্মীরাও ইতোমধ্যে প্রচার-প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। আর এ প্রচার চালাতে এবারের পবিত্র ঈদুল ফিতর হয়ে উঠেছে বড় মাধ্যম।
Advertisement
সাধারণের কাছে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে গ্রাম থেকে শহর সব অঞ্চলেই রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা নিজেদের নামে ঈদ শুভেচ্ছার ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন বানাচ্ছেন। সঙ্গে চালাচালি হচ্ছে ঈদ শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময়। পরিচিত নেতাকর্মীদের পাশাপাশি এভাবে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ে নেমে পড়েছেন অপরিচিত কর্মীরাও।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডামাডোলে এমন ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ে দীর্ঘ মন্দার পর কর্মব্যস্ততা বেড়েছে রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলসংলগ্ন ফকিরাপুল-আরামবাগের ছাপাখানায়। ঈদ উপলক্ষে শুভেচ্ছা কার্ড, ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন ছাপাখানার শ্রমিকরা। তবে অধিকাংশ ছাপাখানা ঈদ উপলক্ষে পাওয়া অর্ডারের কাজ ইতোমধ্যে শেষ করে ফেলেছে।
ফকিরাপুল-আরামবাগের ছাপাখানার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অঞ্চলটিতে ছাপাখানা ও ডিজাইনের (নকশা) দোকান আছে প্রায় ১০ হাজার। এর মধ্যে ছাপাখানা আছে পাঁচ হাজারের ওপর। এসব ছাপাখানা ও ডিজাইনের দোকান মালিকরা এবারের ঈদ উপলক্ষে ২০০ কোটি টাকার ওপর ব্যবসা করেছেন।
Advertisement
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, স্বাভাবিক সময়ে ফকিরাপুল-আরামবাগের এক একটি ছাপাখানায় প্রতিদিন গড়ে কাজ হয় ৫ থেকে ৭ হাজার টাকার। সে হিসাবে প্রতিদিন ছাপাখানাকেন্দ্রিক অঞ্চলটিতে ব্যবসা হয় ৬ কোটি টাকার ওপর। আর উৎসব উপলক্ষে কাজের পরিমাণ বেড়ে যায় কয়েকগুণ।
উৎসবকেন্দ্রিক (ঈদ ও বৈশাখ) কাজ সাধারণত চলে ৭ থেকে ১০ দিন। দুই ঈদ এবং পহেলা বৈশাখ এই তিন উৎসবেই সব থেকে বেশি কার্ড, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনের কাজ হয়। ২০১২-২০১৩ সালের দিকে ঈদ ও বৈশাখ উপলক্ষে ফকিরাপুল-আরামবাগের এক একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন গড়ে কাজ করেছে ৫০ হাজার টাকার ওপরে। অর্থাৎ ওই সময় ফকিরাপুল-আরামবাগে ঈদ উপলক্ষে ছাপাখানাকেন্দ্রিক ব্যবসা হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকার ওপরে।
তবে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে এক প্রকার রাজনৈতিক সংকট দেখা দেয়। অস্থির রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার ও কার্ডের ব্যবসায়। এরপর রাজনৈতিক সংকট কাটলেও রাজনৈতিক কার্যক্রম অনেকটাই থমকে দাঁড়ায়। ফলে উৎসবের শুভেচ্ছা বিনিময়ও থেকে যায় আড়ালে। যে কারণে উৎসব উপলক্ষে ফকিরাপুল-আরামবাগের ছাপাখানায় যেখানে সাড়ে ৩শ কোটি টাকার ওপরে ব্যবসা হতো তা ১০০ কোটি টাকার নিচে নেমে আসে। ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সাল জুড়েই এ মন্দাভাব অব্যাহত থাকে।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ফকিরাপুলের ছাপাখানায় যে মন্দা দেখা দিয়েছিল তা এখনও পুরোপুরি কাটেনি। তবে এবারের ঈদুল ফিতর উপলক্ষে কাজের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। এবার প্রতিটি প্রতিষ্ঠান গড়ে প্রতিদিন ৩০ হাজার টাকার মতো কাজ করেছে। এ হিসাবে এক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ঈদের কাজ পেয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা। অর্থাৎ ফকিরাপুলের ছাপাখানাগুলোতে এবার ব্যবসা হয়েছে ২১০ কোটি টাকার ওপর।
Advertisement
‘বাংলাদেশ প্রিন্টার্স’র মো. মোবারক হোসেন বলেন, ফকিরাপুল-আরামবাগের ছাপাখানার ব্যবসায় কয়েক বছর ধরেই মন্দা বিরাজ করছে। গত বছর তো ঈদ ও বৈশাখে কোনো কাজই পাইনি। এবার ৬টি কাজ পেয়েছি। সব কাজ শেষ। এখন নতুন করে কেউ কাজের অর্ডার দিলে নিচ্ছি।
তিনি বলেন, ঈদের পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন তৈরির কাজ হয় সাধারণত ৭ থেকে ১০ দিন। রোজার দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ১৫ রোজার মধ্যেই সাধারণত সব কাজ শেষ হয়ে যায়। এরপর ছোট ছোট কিছু কাজ আসে। এবার প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন গড়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকার কাজ করেছে। ২০১৩ সালের আগে এক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ৬০-৭০ হাজার টাকার ওপরে কাজ করত। ‘আলিফ প্রিন্টার্স’র মালিক রাজু বলেন, ২০১৩ সালের আগে ঈদ অথবা পহেলা বৈশাখে যে পরিমাণ কাজ আসত, তা তুলতে কর্মীদের দিন-রাত কাজ করতে হতো। এখন আর সেই অবস্থা নেই। উৎসব সামনে, কাজের চাপ কিছুটা বেড়েছে, তবে আগের মতো না। মাঝে তো কাজই ছিল না। এবারের ঈদে কাজের চাপ কিছুটা বেড়েছে।
তিনি বলেন, একটা সময় ছিল যখন কাজের চাপ সামাল দিতে নতুন কর্মী নিয়োগ দিতে হয়েছে। তারপরও নির্ধারিত সময়ে গ্রাহককে মাল (ব্যানার, পোস্টার, কার্ড, ফেস্টুন) সরবরাহ করতে না পারায় অনেকের সঙ্গে মনোমালিন্যও হয়েছে। এসব এখন বললে সবই গল্প মনে হবে।
ন্যাশনাল প্রিন্টার্সের মো. আরিফুল বলেন, ‘আমি ২০১০ সাল থেকে ফকিরাপুলে ছাপাখানার সঙ্গে আছি। আগে ঈদের আগে এক সপ্তাহের মতো ঘুমানোর সুযোগই পেতাম না। অথচ গত দুই বছর আমরা ঈদ ও বৈশাখে কোনো কাজই পাইনি। এবার চারটি কাজ পেয়েছি। যারা ঈদের শুভেচ্ছা ব্যানার, পোস্টারের কাজ করেন এবার সবাই কিছু না কিছু কাজ পেয়েছেন। এম আর প্রিন্টার্সের ফারুক বলেন, এবার ঈদের কাজ এসেছে ১৩টি। সবগুলো কাজ শেষ করে মাল গ্রাহককে বুঝিয়ে দিয়েছি। এখন আর ঈদের কাজ নেই। কেউ চাইলে ঈদের কাজ করে দেয়া যাবে।
টপ ডিজাইনারের মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ফকিরাপুল-আরামবাগে ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার, কার্ড বানানোর কাজে জড়িত আছে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এসব প্রতিষ্ঠানের সবগুলোই ২০১০ সালের আগে গড়ে উঠেছে। কেউ কেউ ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এখানে কাজ করছেন।
এবারের ঈদ উপলক্ষে এক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে কেমন কাজ পেয়েছে, এমন প্রশ্নের উত্তরে এই ব্যবসায়ী বলেন, এটা বলা মুশকিল। কারণ এমনও প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে দিনে এক লাখ টাকার ওপরে কাজ হয়। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে ২০-৩০ হাজার টাকার কাজ হয়। তবে একটা কথা বলা যায় এবার ঈদ উপলক্ষে ভালোই কাজ পাওয়া গেছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা প্রচার প্রচারণায় নেমে পড়েছেন। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় উপলক্ষে যেসব পোস্টার ও ব্যানার ছাপা হচ্ছে তার সবগুলোই রাজনৈতিক। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকেও কাজের অর্ডার আসছে।
এমএএস/ওআর/এমএস