কক্সবাজার শহরের আলির জাহাল সাইফুল কমিউনিটি সেন্টারের পাশে টমটম গেরেজের পশ্চিম পাশে বিশাল একটি পাহাড়। সেটি কেটে অবৈধ টিনসেড সেমিপাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন রামু জোয়ারিয়া নালার এক ব্যক্তি।
Advertisement
শুধু বসত বাড়ি নয়, তিনি সেখানে পাহাড় কেটে ঘর ভাড়াও দিয়েছেন কয়েকটি। রাস্তার পাশে আম গাছের তলায় টিনসেড এই অবৈধ স্থাপনার আড়ালে প্রকাশ্যে কাটা হচ্ছে আরও পাহাড়। প্রশাসনের নাকের ডগায় শুধু এখানেই নয়, কলাতলীসহ জেলার আনাচে কানাচে চলছে পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণের ধুম।
পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় পাহাড় ধসে মঙ্গলবার একদিনেই মারা গেছেন সেনা কর্মকর্তাসহ অর্ধশতাধিক লোক। এসব তথ্য প্রচার পেলেও কাটা বন্ধ হচ্ছে না কক্সবাজারের পাহাড়। উল্টো দিনরাত সমানে চলছে পাহাড কেটে ঘর-বাডি তৈরির কাজ। পরিবেশ অধিদফতর মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়ে কিছু ঘর-বাডি উচ্ছেদ করলেও তা পুনরায় তৈরি হচ্ছে। অথচ গত পাঁচ বছরে ২৫টির বেশি পাহাড় ধসের ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
পরিবেশবাদী সংগঠনের কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে শহরের ১১টির বেশি সরকারি পাহাড দখল করে তৈরি করা হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি অবৈধ স্থাপনা। এসব স্থাপনায় বসবাস করছেন এক লাখের বেশি মানুষ।
Advertisement
সম্প্রতি কলাতলী পাহাড ঘুরে দেখা গেছে, সরকারি এই উঁচু পাহাড কেটে ইতোমধ্যে তৈরি করা হয়েছে ৩০টির বেশি অস্থায়ী টিনের ঘর। সেখানে বসবাস করছেন ভাসমান লোকজন।
একটি ঘরের বাসিন্দা ছৈয়দ আলম (৪৪) জানান, এক মাস আগে পাহাডের এক খণ্ড জমিতে তিনি টিনের ঘরটি তৈরি করেন। পাশের আরও দুটি টিনের ঘর শহরের একজন প্রভাবশালী তৈরি করে পাহারাদার হিসেবে দুটি পরিবারকে থাকতে দিয়েছেন।
এই পাহাডের পাশে আদর্শগ্রাম, টিঅ্যান্ডটি টাওয়ার, লাইট হাউস, সার্কিট হাউস, পাহাড়তলী, লারপাডা, এবিসি ঘোনাসহ শহরের আরও অন্তত ১০টি পাহাড় কেটে ঘর-বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, প্রভাবশালীরা মিয়ানমারের অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে পাহাড় কাটা চালাচ্ছেন।
Advertisement
পরিবেশবাদী সংগঠন ইয়ূথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (ইয়েস) ও কক্সবাজার বন পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ কঠোর আন্দোলন সংগ্রাম করেও পাহাড় কাটা বন্ধ করতে পারছে না। তাদের মতে পাহাড় থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা না গেলে ভবিষ্যতে শহরে কোনো পাহাড়ের চিহ্ন থাকবে না। তা ছাড়া বর্ষায় পাহাড় ধসে মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে ২৫টির বেশি পাহাড় ধসের ঘটনায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
আলির জাহাল, লারপাড়া ও পাহাড়তলীতে দেখা গেছে, শ্রমিকেরা ৫০ থেকে ৭০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় ও পাদদেশে ঘর-বাড়ি তৈরি করছেন। পাহাড় কাটার মাটি ঠেলা গাড়িতে করে ফেলা হচ্ছে শহরের বাঁকখালী নদীতে। এতে সামান্য বৃষ্টিতে শহরে জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে।
পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র বলেন, পর্যটন শহরের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় কয়েক লাখ ভাসমান মানুষ ঠাঁই নিয়েছে কক্সবাজার শহরে। তারা পাহাড় কেটে ঘর-বাড়ি তৈরি করছে।
ফলে পাহাড় কাটার মাটি নেমে শহরের নালা ভরাট হচ্ছে। বাঁকখালী নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে সংকুচিত হয়ে পড়েছে নৌ-চলাচলের পথ। বর্ষায় পাহাড় ধসের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে। তারপরও পাহাড় কাটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরকে কঠোর হতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল ইসলাম বলেন, গত মে মাসেও একাধিক অভিযান চালিয়ে পাঁচটির বেশি ট্রাকসহ পাহাড় কাটার সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই পুনরায় পাহাড় কাটা চলে।
জনবল সংকটের কারণে নিয়মিত অভিযান চালানো সম্ভব হচ্ছে না। শহরের একাধিক পাহাড় কেটে ঘর-বাড়ি তৈরির দায়ে গত কয়েক মাসে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় শতাধিক দখলদারের বিরুদ্ধে ১৫টির বেশি মামলা করা হয়েছে। অন্য দখলদারদেরও তালিকা তৈরি হচ্ছে।
এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ ও প্রশানের চিহ্নিত কিছু দুর্নীতিবাজের বিরুদ্বে পাহাড় কাটায় জড়িতদের নানাভাবে আশ্রয়প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। তাদের কারণে অনেক সময় পাহাড়কাটা বন্ধ করা সম্ভব হয়না।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, অনাকাঙ্খিত মৃত্যুরোধে প্রশাসন সর্বদা সচেষ্ট। ঝুঁকিতে বসবাসকারীদের সরে যেতে বার বার মাইকিং করা হয়। এরপরও অনেক জায়গায় ঝুঁকিতে থাকা লোকজন সরে না। প্রশাসন ইতোমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়েছে। এটি অব্যাহত রয়েছে।
সায়ীদ আলমগীর/এমএএস/আরআইপি