বাজেট বাস্তবায়নে প্রশাসনিক সংস্কার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। বুধবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার মিলনায়তনে ব্র্যাক ও আইআইডি আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০১৭-১৮ : প্রত্যাশা, প্রাপ্তি ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্যানেল আলোচক হিসেবে এ মন্তব্য করেন তিনি।
Advertisement
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, একদিকে আমাদের বাজেটের আকার বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যয়ের মাত্রা আনুপাতিক হারে প্রত্যেক বছর কমছে। ২০১২ অর্থবছরের বাজেটের ৯৩ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছিল। প্রত্যেক বছর কমতে কমতে ২০১৬-তে সেটা ৭৮ শতাংশে এসেছে। আমার মনে হয়, ২০১৬ সালের প্রকৃত চিত্রটা পেলে হয়তো দেখা যাবে আরও কমেছে।
এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে- প্রথমত, প্রশাসনিক দক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের প্রশাসনিক খাতে ইনসেনটিভের কোনো ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ কোনো কর্মকর্তা ভালো কাজ করলে তার জন্য কোনো স্বীকৃতি নেই এবং খারাপ কাজ করলে শাস্তির আওতায় আনার ব্যবস্থা আমাদের প্রশাসনিক খাতে নেই। তাই প্রশাসনিক খাতে ইনসেনটিভের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) বেশকিছু অবকাঠামো খাতের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আপনারা জানেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ অবকাঠামো খাতে পিপিপিতে সাফল্য অর্জন করেছে। কি্ন্তু আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এটির অগ্রগতি মোটেই সন্তোষজনক না এবং প্রত্যেক বছরে পিপিপিতে যে বরাদ্দ রাখা হয় তার ব্যবহার হয় না। প্রশাসনিক দিক থেকে সরকার দ্বিমুখিতা সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি তত্ত্বাবধান করছেন, কিন্তু সে সত্ত্বেও এর অগ্রগতি সন্তোষজনক না।
Advertisement
মির্জ্জা আজিজুল বলেন, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সঙ্গে সরাসরি জড়িত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতের বরাদ্দ ২০১২ সালের তুলানায় আনুপাতিক হারে অনেক কমে গেছে। এক্ষেত্রে এনজিও ও বেসরকারি খাতের সঙ্গে অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করা গেলে সফলতা পাওয়া যেতে পারে।
প্রকল্প ব্যয় নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিতর্ক আছে। সেই বিতর্কে আমি এখন যেতে চাই না। আমরা দেখি প্রত্যেকটি প্রকল্পের যে সময় নির্ধারণ করা থাকে, তা নির্ধারিত সময়ে শেষ হয় না। যে প্রকল্পের জন্য তিন বছর সময় ধরা হয়, তা শেষ হতে পাঁচ বছর থেকে ছয় বছর লেগে যায়। এতে ব্যয়ের পরিমাণও বেড়ে যায়।’
ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল বায়েস বলেন, ‘বাংলাদেশ হয়তো প্রবৃদ্ধির মহাসড়কে আছে, কিন্তু উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে বলে আমার মনে হয় না। উন্নয়নের মহাসড়কে উঠতে এখনও অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। তবে এক দশক ধরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে রয়েছে- এটি প্রশংসনীয়, যদিও প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু এখনও দুই কোটি মানুষ চরম দরিদ্র, প্রাথমিক স্কুলে যাবার বয়সীদের এক-পঞ্চমাংশ কখনও স্কুলে যায় না, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নেই প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীর এবং নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ভ্যাট আইন আমরা স্বাগত জানাই। তবে আমরা মনে করি, ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশের নিচে হলে ভালো হয়। ব্যাংকের হিসাবের ওপর যে আবগারি শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে, আমরা চাই তা তুলে নেয়া হোক।
Advertisement
স্ট্র্যাটেজি, কমিউনিকেশন অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট’র ঊর্ধ্বতন পরিচালক আসিফ সালেহ’র সভাপতিত্বে সভায় প্যানেল আলোচক হিসেবে আরও অংশগ্রহণ করেন ব্র্যাকের মাইক্রোফিন্যান্স ও টিইউপি কর্মসূচির পরিচালক শামেরান আবেদ, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচির পরিচালক ড. শফিকুল ইসলাম, ব্র্যাকের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচির প্রোগ্রাম হেড মো. আরিফুল আলম।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থান করেন ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক আব্দুল বায়েস এবং ইনস্টিটিউট ফর ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’র প্রধান নির্বাহী সাঈদ আহমেদ।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সামষ্টিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যাশা ও প্রবৃদ্ধিমুখী, প্রাক-নির্বাচনী, শিক্ষায় আপস এবং মধ্যবিত্ত নির্ভর- এ চারটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়।
প্রত্যাশা ও প্রবৃদ্ধিমুখীর বিষয়ে প্রবন্ধে শঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়, বিগত বছরগুলোতে ৬ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি আশানুরূপ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেনি। আবার প্রকল্প বাস্তবায়নের বিদ্যমান ব্যর্থতা ও দীর্ঘসূত্রিতা সংস্কারের দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই।
এ সমস্যা সমাধানে প্রবন্ধে দুটি সুপারিশ করা হয়েছে। এক, বড় অবকাঠামো প্রকল্পের অনেক ক্ষেত্রেই দেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই, যা নিরসনে প্রকল্পভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। দুই, এডিপি বাস্তবায়নে সেবা খাতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব বা পিপিপি উদ্যোগ প্রয়োজন।
প্রাক-নির্বাচনীর শঙ্কার বিষয়ে বলা হয়েছে, দৃশ্যমান উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রাধিকার পেয়েছে, কিন্তু তুলনামূলক অগ্রাধিকার বিবেচনায় সামাজিক অবকাঠামো- যেমন শিক্ষা খাতে তুলনামূলক বরাদ্দ কমেছে। আবার প্রাক-নির্বাচনী ব্যয় বাজারে মুদ্রাসরবরাহ বৃদ্ধি ও খাদ্যবহির্ভূত খাতে মুদ্রাস্ফীতির সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে, যা চলমান খাদ্য মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে মিলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
শিক্ষায় আপসের বিষয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষা খাতের গতানুগতিক প্রকল্পের সঙ্গে নতুন কর্মসংস্থানের সংযোগ না থাকায় শিক্ষিত বেকারের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবর্তনশীল কর্মবাজারের অস্তগামী ও উদীয়মান কর্মচাহিদার বিশ্লেষণ না করে বাজেটের গতানুগতিক বরাদ্দ কর্মবাজারের কাঠামোগত পরিবর্তনে উদ্ভূত ‘কর্মহীন প্রবৃদ্ধি’র সমাধানে ব্যর্থ হবে।
মধ্যবিত্ত নির্ভরের বিষয়ে প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ব্যয় করের ওপর নির্ভরশীলতা মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তকে বাড়তি চাপের মধ্যে ফেলবে এবং আয়-করের মাধ্যমে যে সম্পদ পুনর্বন্টনের সুযোগ তৈরি হয়, তার বদলে অর্থনৈতিক বৈষম্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। বাজেট পরোক্ষ কর নির্ভরতা না কমালে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সম্পদ বৈষম্য বৃদ্ধি করবে।
মূল প্রবন্ধে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের ৬৪ জেলায় বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার পাঁচ হাজার ১২৫ জনের ওপর একটি জরিপ চালানো হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৮৭ শতাংশ জানিয়েছে, তারা বাজেট সম্পর্কে জানেন। বাকি ১৩ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা বাজেট সম্পর্কে জানেন না।
বাজেটের কোন খাত-উপখাত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ- জরিপে অংশগ্রহণকারীদের এমন প্রশ্ন করা হলে উত্তরদাতাদের ৫১ দশমিক ৫০ শতাংশ বলেছেন, শিক্ষা প্রথম গুরুত্বপূর্ণ খাত। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা খাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন ৩১ দশমকি ৭০ শতাংশ। উত্তরদাতাদের ৬১ দশমিক ৫০ শতাংশ বলেছেন, বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কৃষকের জন্য কম দামে কৃষি/মাছচাষের উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এমএএস/এমএআর/জেআইএম