সাহিত্য

লঙ্কা

এক.এখন আর আগের মতো লিখতে ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা না করার পেছনে অবশ্য একটি কারণ আছে। আজকাল লিখতে বসলে কেন জানি না নিজের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। কখনো বা দু’চার পাতা লিখে ফেললে সেটা কী-বোর্ডের ব্যাকস্পেস চেপে মুছে ফেলি। মনে হয়, যা লিখেছি তা আদৌ কোন লেখা হয়নি। পাঠক পছন্দ করবে না। পাঠকের ভালো লাগার কাছেই তো লেখক জিম্মি। আর জিম্মিদশা ভালো লাগে না। তাই লেখার জগত থেকে নীরবে অবসর নিয়েই ফেলেছিলাম। যদিও এর মাঝে অনেক প্রকাশক, পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদকের অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছি। আজও অনুরোধে ল্যাপটপ হাতে বসলাম। সকালে একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক অনিমেষ বাগচী এসেছিলেন বাসায়। - অনেক দিন হলো পাঠক আপনার কোন লেখা পাচ্ছে না। আগামী সংখ্যায় আমার সাহিত্য পত্রিকার জন্য একটা ছোটগল্প চাই। - আমি তো লেখা ছেড়েই দিয়েছি অনিমেষ বাবু।  - লেখক কি চাইলেই লেখা ছেড়ে দিতে পারেন?- তা পারেন না। আমি পেরেছি। এই দেখছেন তো আমি লিখছি না। - লিখছেন না ঠিকই। তবে লেখা আপনাকে তাড়িয়ে বেড়ায় লেখার জন্য। অস্বীকার করতে পারবেন না। - সেটা ঠিক বলেছেন। আমি লিখতে চাই। অথচ পেরে উঠি না। কি এক অজানা কারণে আমি লিখতে লিখতে থেমে যাই। - আপনাকে লিখতে হবে দাদা। আপনার পাঠকরা যে আপনার লেখা পড়তে চায়। তাদের বঞ্চিত করার কোন অধিকার তো আপনার নেই। - আমাকে দিয়ে হবে না অনিমেষ বাবু। পাঠক আমার লেখা পড়ে এখন হাসবে। গালাগাল দেবে। তারচেয়ে বরং আমার জায়গায় অন্য একজন লেখকের লেখা ছাপান। - অনুরোধ করছি দাদা। আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না। আমাকে অনুরোধ রাখতে হচ্ছে। কিন্তু কি নিয়ে লিখবো? প্রেম, ভালোবাসা নাকি রূপকথা? যা লিখলে পাঠক এক নিশ্বাসে পড়ে ফেলবে। আজ কেন জানি না লঙ্কার কথা খুব মনে পড়ছে। লঙ্কা, আমার শৈশবের প্রেম। কারো চেনার কথা নয়। এর আগে কখনো তাকে নিয়ে কিছু লেখা হয়নি। আমার জীবনে লঙ্কা কতোটা জায়গা জুড়ে আছে সেটা হয়তো পরিমাপ করে বোঝানো যাবে না। যদি পরিমাণ খুব জানতে ইচ্ছা করে তাহলে মনগড়া কিছু ভেবে নেয়া যেতে পারে। লঙ্কার নাতিদীর্ঘ চুল। হাঁটার ধরন, চোখের চাহনি কিংবা হাসি। সবকিছু আমাকে প্রতিমুহূর্তে দূরন্ত প্রেমিক হতে উৎসাহ জোগাতো। কতোবার যে কল্পনায় লঙ্কাকে নিয়ে পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়ে তেপান্তরের মাঠ পাড়ি দিয়েছি তা বলে শেষ করা যাবে না। প্রথম প্রেম বলেই হয়তো কল্পনার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়নি কখনো। ইচ্ছা করেই কল্পনাকে উসকে দিয়েছি বারবার। আজকাল আর লঙ্কার সাথে দেখা হয় না। শেষ দেখা হয়েছিলো তিন বছর আগে। তখনই জেনেছিলাম ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। স্বামী বড় চাকরি করে। টাকা-পয়সা আর সোনা দিয়ে মুড়ে রেখেছে। লঙ্কার নিজের মুখ থেকে বিয়ের কথা শুনে থমকে গিয়েছিলাম। তারপর মনে হলো ঠিকই করেছে মেয়েটা। আমাকে বিয়ে করলে কিইবা পেতো। লেখালেখি আর সাংবাদিকতা করে যা আয় করতাম তাতে তাকে খুব একটা সুখে রাখতে পরতাম না। মেয়েরা তো সুখ চায়। কোন মেয়েকে অসুখী রাখার কোন অধিকার তো আমার নেই। ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার যন্ত্রণা যে আমাকে কুড়েকুড়ে খায় না তা কিন্তু নয়। আমার দীনতা আমাকে প্রিয় মানুষের হাত ধরে জীবনের বাকিটা সময় পার করতে দেয়নি। মাঝে মাঝে নিজের উপর খুব রাগ হয়। এভাবে অর্থহীন বেঁচে থাকার যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। তবু কেনো জানি না বাঁচতে খুব ইচ্ছা করে। আবার সেই প্রেমিকার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অথবা খুনসুটি করতে ইচ্ছা করে। হয়তো এই ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। থাকি না বেঁচে আরো কিছুদিন। কয়েক বছর। দুই.বাসার কাজের মেয়েটা আজ আসেনি। আসবে কিনা জানি না। কফি খেতে ইচ্ছে করছে। লিখতে বসে কফি খাওয়ার অভ্যাসটা পুরনো। কাজের মেয়েটা কফি ভালো বানায়। যেহেতু কাজের মেয়েটা আসেনি সেহেতু আজ আমাকেই কফি বানাতে হবে। কফি বানাতে যাবো এমন সময় ঘরের কলিংবেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই দেখি লঙ্কা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে লাল শাড়ি, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, চোখে কাজল। অবাক হলাম। কখনো ভাবিনি ও এভাবে আমার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াবে। - তুমি!- হ্যাঁ, আমি। অবাক হয়েছো?- সেটাই তো স্বাভাবিক।- বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলবে?- না না। ভেতরে এসো। লঙ্কা পুরো ঘরটা চোখ বুলিয়ে দেখলো। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে সোফায় বসলো। আমি কিছুটা দূরে বসলাম। - লিখছিলে?- লেখার চেষ্টা করছিলাম। লিখতে বসে তোমার কথা মনে পড়ে গেলো। আর তুমি এসে হাজির। আমি না বিশ্বাস করতে পারছি না। - টেলিপ্যাথি।- হতে পারে। কিন্তু আমার ঠিকানা কীভাবে পেলে?- পত্রিকা অফিস থেকে জোগাড় করেছি। যদিও ওরা দিতে চায়নি। কষ্ট করে জোগাড় করেছি। ওখানে একজন আমাকে চেনে।- চেনে! কীভাবে?- তোমার ঘরের দেয়ালে আমার ছবি টানানো দেখেছে। ল্যাপটপের ওয়ালপেপারে দেখেছে।- ওহ, তাই বলো।- আচ্ছা, এখনো কেন আমার ছবি রেখেছো?- উত্তরটা কখনো দেয়া সম্ভব না লঙ্কা। শুধু জেনে রাখো, এই ছবি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। - এতো বছরে তোমার কি ভুলে যাওয়া উচিত ছিলো না আমাকে? - সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। বাদ দাও এসব কথা। কফি খাবে? আমি বানিয়ে খাওয়াবো।- নাহ থাক। তোমার কি সময় হবে?- কেন বলো তো?- দু’জনে একটু বাইরে একসঙ্গে হাঁটতাম। - ঠিক আছে, চলো। দুপুর গড়িয়ে বিকাল। শীতের বিকালের মৃদু হাওয়া অনেকটা প্রেমিকার নরম হাতের স্পর্শের মতো। একটা সময় আমার এমনটা অনুভব হতো। আজকাল আর হয় না। আমার অনুভূতিগুলো ঠুঁকরে খাওয়া দাঁড়কাকের দখলে চলে গিয়েছে অনেক আগে। এখন আমি অনভূতিশূন্য এক মানুষ। আর সেই কারণে হয়তো পুরনো প্রেমিকার চোখ, নাক, ঠোঁট আমাকে টানে না।লঙ্কা কোন কথা বলছে না। চুপচাপ হাঁটছে। আমি নিজ থেকে বললাম,- তারপর বলো তোমার সংসার কেমন চলছে?- সংসার! খারাপ না। ‘সংসার’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে জোরে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো লঙ্কা। এই দীর্ঘশ্বাসের মানে বোঝার চেষ্টা করা ঠিক হবে না আমার।- খুব সুখে আছো, তাই না?- অনেক সুখে আছি। দেখতেই তো পাচ্ছো।- তা দেখতে পাচ্ছি। তুমি সুখে আছো জেনে খুব ভালো লাগছে। - কেন ভালো লাগছে?- তোমার সুখই যে আমার সুখ।- তুমি কেন বিয়ে করনি?- যাকে বিয়ে করতে চেয়েছি তাকেই যখন পেলাম না তখন বিয়ে করে কি হবে? এই তো দেখ দিব্যি আছি।- সেদিন কি তুমি পারতে না আমার বাবার কাছ থেকে আমাকে নিয়ে আসতে? - তা হয়তো পারতাম। কিন্তু তোমাকে কি খাওয়াতাম বলো? সামান্য কয়েক টাকা বেতনে তোমার মতো মেয়েকে নিয়ে টানাটানি করে সংসার চালাতে হবে- এটা আমি কখনো চাইনি। - এমনও তো হতে পারতো আমি মানিয়ে নিতাম তোমার সাথে।- পারতে না। কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে যেতো আমাদের সংসার।- আমরা কি এক হতে পারি না আর কখনো?- পারি। তবে পরের জীবনে। সেখানে নিশ্চয়ই আমরা এক হবো।- আমি এই জীবনে এক হতে চাই। - কি বলছো এসব তুমি? - যা বলছি ভেবে বলছি। আমি আর তোমাকে একা থাকতে দিতে চাই না। বাকিটা জীবন তোমার সঙ্গে হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দিতে। - তা হয় না লঙ্কা। আমার মতো মানুষের পৃথিবীতে জন্ম হয় কেবলই ব্যর্থ প্রেমের ঘানি টেনে বেড়াতে। তুমি ফিরে যাও। তোমার ফিরে যাওয়া উচিত। তুমি তোমার স্বামীর সঙ্গে এমন করতে পারো না। - আমি তো ফিরে যেতে আসিনি। যে মানুষটার কাছে তার স্ত্রীর চেয়ে মদের মূল্য বেশি তার সঙ্গে সংসার কীভাবে করি বলো? লঙ্কা কথা বলতে বলতে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। আমি এখন কি করবো? জড়িয়ে ধরবো? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। উত্তর পেলাম না।এসইউ/জেআইএম

Advertisement