দেশজুড়ে

রাজশাহীতে জলবায়ু পরিবর্তনে প্রতিনিয়ত বন্ধ হচ্ছে মুরগির খামার

রাজশাহী অঞ্চলে গরমকালে তীব্র গরম আর শীতকালে তীব্র শীত পড়ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। আবহাওয়াবিদরা একে বলছেন জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। পরিবেশের পাশাপাশি এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে এ অঞ্চলের কৃষিতেও। বিশেষ করে ঝুঁকিতে রয়েছে এ অঞ্চলের পোলট্রি শিল্প। অব্যাহত লোকসানে গত ছয় মাসে বন্ধ হয়ে গেছে ২ হাজার ১১৩টি খামার। বছর পাঁচেকের মধ্যে বন্ধ হয়েছে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ১০ হাজার খামার।রাজশাহী আবহাওয়া অফিস বলছে, গত সোমবার রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকা আবহাওয়া অধিদফতরের হিসেবে ডিসেম্বরজুড়েই রাতের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। ডিসেম্বরের শেষে তাপমাত্রা নামবে ১০ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। তবে সবচেয়ে বেশি শীত অনুভূত হবে আগামী জানুয়ারিতে। ওই সময় এ অঞ্চলের তাপমাত্রা নামবে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি থেকে তাপমাত্রা কিছুটা বাড়বে। গত কয়েক বছর ধরেই তীব্র শীত অনুভূত হচ্ছে রাজশাহী অঞ্চলে। অন্যদিকে খরা মৌসুমে তাপমাত্রার পারদ চড়ছে। গিয়ে ঠেকছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। বছরের ছয় মাস এমন চরম পরিস্থিতি দারুণভাবে ভোগাচ্ছে এ অঞ্চলের পোলট্রি খামারিদের। শীত ও গরম এ দুই মৌসুমে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মুরগি। বিশেষ করে ব্রয়লার মুরগি আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। আর লেয়ারের কমে যাচ্ছে ডিম। প্রতি বছরই লোকসান গুনতে হচ্ছে খামারিদের। এতে বাধ্য হয়ে অনেকেই বন্ধ করে দিচ্ছেন খামার। রাজশাহী নগরীর ছোটবন গ্রাম এলাকার বাসিন্দা মুনতাসীর রহমান শুভ। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষে জড়িয়ে পড়েন পোলট্রি খামারে। ১৯৯৭ সালে বাড়ির পেছনে একখণ্ড জমিতে টিনের চালা আর বাঁশের বেড়া ঘিরে তৈরি করেন স্বপ্নের খামার। ভালোই চলছিল খামার। পরের ১৫ বছর টানা লাভ করেছেন তিনি। কিন্তু শেষ কয়েক বছরের লোকসানে খেই হারিয়ে ফেলেন। ঋণে দাঁড়ানো ব্যবসা হয়ে পড়ে টালমাটাল। খামার গুটিয়ে এখন বেকার স্বপ্নবাজ এ মানুষটি।তার অভিজ্ঞতায়, শীতকালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং খরায় প্রচণ্ড গরম পড়ছে। এছাড়া শীতের রোগ হচ্ছে গরমে, গরমের রোগ ছড়াচ্ছে শীতকালে। রোগে মুরগি সাবাড় হচ্ছে। যেগুলো টেকানো যাচ্ছে কোনোমতেই সেগুলো ডিম দিচ্ছে না। থমকে যাচ্ছে বৃদ্ধি। ওষুধ কিনতে কিনতে পুঁজি শেষ। দীর্ঘ মেয়াদে চিকিৎসা দিয়ে ফল হচ্ছেনা।জেলার মোহনপুর উপজেলার কেশরহাট এলাকার খামারি মশিউর রহমান জানান, তিনি প্রায় ৫ বছর ধরে মুরগির খামার করছেন। শুরুর দিকে ভালো লাভ হলেও এখন উল্টো চিত্র। বিশেষ করে মার্চ থেকে জুন এবং ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি এই সাত মাস মুরগি সুস্থ রাখায় কঠিন হয়ে পড়েছে। ঠাণ্ডা থেকে গরম আবার গরম থেকে ঠাণ্ডা-এই হচ্ছে আবহাওয়া। একটু বেশি গরম বা ঠাণ্ডা পেলেও অসুখ হয়ে মারা যাচ্ছে মুরগি। আর কী অসুখ হচ্ছে তাও ঠিক মতো বলতে পারছেন না চিকিৎসকরা। বাধ্য হয়ে তাই খামার গুটিয়ে নিচ্ছেন অনেকেই।নওগাঁ সদরের শালুকা গ্রামের সফল বাণিজ্যিক টার্কি খামারি জিল্লুর রহমান চৌধুরীর ভাষায়, ২০০২ সালে তিনি মুরগি খামার শুরু করেন। তীব্র ঠাণ্ডা-গরমে রোগে আক্রান্ত হয়ে মুরগি মারা যাচ্ছিলো। কোনোভাবেই টেকানো যাচ্ছিলোনা। এর মাঝেই ছেড়ে দেন টার্কি। ধকল কাটিয়ে টিকে যায় খরা ও গরম সহিষ্ণু এ পাখি। এরপর ঝুঁকে পড়ের টার্কির বাণিজ্যিক চাষে। সঙ্গে যুক্ত হয় তিতিরও। তবে আবহাওয়া এখানেও পিছু ছাড়েনি। সারাবছর ডিম দিলেও শীতে বন্ধ হয়ে যায় টার্কির ডিম দেয়া। এতে বাচ্চা উৎপাদনও বন্ধ। ফলে এ দুই মাস অর্ডার নেয়াও বন্ধ। জিল্লুর রহমানের এ খামার থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ হচ্ছে টার্কির বাচ্চা। পোলট্রি গবেষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এনিমেল হাজবেন্ডারি অ্যান্ড ভেটেরিনারি সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ সারোয়ার জাহান জানান, খামারে পালন করা মুরগির স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় থাকে ১৫ থেকে ২২ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। এর বেশি বা কম হলেই বিপদ। কিন্তু রাজশাহীতে গরমকালে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। আর শীতে তাপমাত্রা নেমে যায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। একারণে হিটস্ট্রোক ও কোল্ড ইঞ্জুরিতে আক্রান্ত হয় মুরগি। দেখা দেয় রোগবালাই। জীবিত মুরগি অতিরিক্ত গরম-শৈত্য সহ্য করতে না পেরে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। নানা ধরনের রোগ দেখা দেয়। তখন স্বাভাবিক ডিম দেয়া বন্ধ করে দেয়। এসময় চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়ে যায়। লোকসানে পড়ে খামারিরা বাধ্য হন খামার বন্ধে।এ বিষয়ে বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ড. জালাল উদ্দিন সরদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে রাজশাহী অঞ্চলে মুরগিতে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- এভিয়েন, ব্রঙ্কাইটিস ও মাইক্রোপ্রজমা প্রভৃতি। খামারিরা সচেতন না হলে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। পাশাপাশি নতুন নতুন রোগের প্রতিষেধকও উদ্ভাবন করা জরুরি। জলবায়ু পরিবর্তনে পোলট্রি শিল্পের নানা সমস্যার কথা স্বীকার করে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের বিভাগীয় উপ-পরিচালক ডা. রেজাউল ইসলাম বলেন, আবহাওয়ার হেরফের হওয়ায় এভিয়েন ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সোয়ান ফ্লুর মতো রোগ আমাদের দেশে এসে গেছে। যা আগে ছিল না। নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে সমস্যা বাড়ছে। এনিয়ে সরকারের তরফ থেকে এখনো ওষুধ বা প্রতিষেধক নেই। খামারিরা নিজ উদ্যোগে এসব এনে প্রয়োগ করছেন। তবে খামারিদের পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছে প্রাণিসম্পদ দফতর।বিভাগীয় প্রাণসম্পদ দফতরের হিসেবে, বর্তমানে রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে মুরগির খামার রয়েছে ১৫ হাজার ৩২১টি। এর মধ্যে লেয়ার খামার ৩ হাজার ৩৬০ ও ব্রয়লার খামার ১১ হাজার ৯৬১টি। গত জুন মাসে এ অঞ্চলের ৪ হাজার ১৮৯টি লেয়ার ও ১৩ হাজার ২৪৫টি ব্রয়লার খামার ছিলো। এ ক’মাসে ৮২৯টি লেয়ার এবং এক হাজার ২৮৪টি ব্রয়লার খামার বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে লোকসানে পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে এসব খামার। তবে তীব্র ঠাণ্ডা ও গরম সহনশীল হাঁসের খামার বেড়েছে। গত সাত মাসে ২১টি বেড়ে বর্তমানে এ অঞ্চলে হাঁসের খামার রয়েছে ২ হাজার ৬৮৯টি।  ফেরদৌস সিদ্দিকী/এমএএস/জেআই

Advertisement