কৃষি ও প্রকৃতি

পুকুরে পাঙাশ মাছ চাষে কমবে বেকারত্ব

পুকুরে পাঙাশ মাছ চাষে কমবে বেকারত্ব

আবহমানকাল থেকেই পাঙাশ মাছ বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যতালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এ মাছ একসময় নদ-নদী ও উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাভাবিকভাবেই পাওয়া যেত। দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলো ছিল পাঙাশের প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র। একসময় পাঙাশ ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। কিন্তু নদীর নাব্য হ্রাস পাওয়ার ফলে এবং প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হওয়ায় এখন এর প্রাপ্য কমে যাচ্ছে। তবে আশার কথা হলো, পুকুরে পাঙাশ মাছের চাষের সুযোগ এখনো বিপুল এবং এ খাতে আশির দশক থেকেই উদ্যোগ চালু আছে।

Advertisement

বাংলাদেশে পাঙাশ মাছের প্রধানত দুটি জাত দেখা যায়। প্রথমত দেশি পাঙাশ এবং থাই পাঙাশ। দেশি পাঙাশ দেখতে রুপালি রঙের, পিঠে কালচে এবং পার্শ্ব রেখার ওপরে হালকা ধূসর রঙের হয়ে থাকে। আঁশবিহীন এ মাছ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে বেশি পাওয়া যায়। এখনো সুস্বাদু ও দামে বেশি। অন্যদিকে থাই পাঙাশের উৎস থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম সফলভাবে এ মাছের প্রজনন হয়। দেশি প্রজাতির তুলনায় থাই পাঙাশ দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং বাণিজ্যিক চাষে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

পাঙাশ চাষের ধরন নির্ভর করে চাষের পরিবেশ, পুকুরের বৈশিষ্ট্য, পানির গুণমান, পুঁজি, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং মানসম্মত পোনার প্রাপ্যের ওপর। একক বা নিবিড় চাষ পদ্ধতিতে তুলনামূলক কম সময়ে বেশি উৎপাদন সম্ভব। এতে হেক্টরপ্রতি ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার পোনা মজুত করা যায়। আমিষসমৃদ্ধ কৃত্রিম খাদ্যের মাধ্যমে হেক্টরপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টন মাছ উৎপাদন সম্ভব।

চাষের জন্য আয়তকার পুকুর সবচেয়ে উপযোগী। পুকুরের তলা সমতল করে পানির গভীরতা ১.৫ থেকে ২ মিটার রাখা উত্তম। দোআঁশ মাটির পুকুর এ চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে গভীর বা অগভীর নলকূপ থাকা জরুরি। অতিবৃষ্টিতে পুকুর যেন ভেঙে না যায়, সেজন্য আগেই মেরামতের কাজ শেষ করা উচিত। সেইসঙ্গে এমন জায়গায় পুকুর নির্বাচন করতে হবে; যেখানে যোগাযোগের সুবিধা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো।

Advertisement

পুকুর প্রস্তুতির প্রথম ধাপ হলো সব ধরনের আগাছা সরিয়ে ফেলা এবং রাক্ষুসে বা অনাকাঙ্ক্ষিত মাছ অপসারণ করা। একাধিকবার ঘন ফাঁসের জাল টেনে এসব মাছ তুলে ফেলতে হয়। তারপর পানি পরিষ্কার করে পুকুরের তলার মাটি চাষ করলে উপকার হয়। প্রয়োজনে স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। পুকুরে চুন দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি হেক্টরে ২৫০-৩০০ কেজি চুন দিতে হয় এবং তা গুঁড়ো করে মিহি করলে কার্যকারিতা বাড়ে।

আরও পড়ুনপুকুরে মাছ ও ভাসমান লাউ চাষযেভাবে শিং মাছ চাষ করবেন

চুন দেওয়ার ৪-৫ দিন পর সার দিতে হয়। নতুন বা বেলে মাটির পুকুরে জৈব সার বেশি, পুরাতন বা কাদাযুক্ত পুকুরে রাসায়নিক সার বেশি দিতে হয়। প্রতি শতকে ৮-১০ কেজি গোবর বা ৪-৫ কেজি মুরগির বিষ্ঠা ব্যবহার করা হয়। এরসঙ্গে ১০০ গ্রাম টিএসপি মিশিয়ে ৮-১০ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখা হয়। পরে ১০০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে পুকুরজুড়ে ছিটিয়ে দেওয়া হয়। সার প্রয়োগের ৪-৫ দিন পর যখন পুকুরের পানির রং সবুজ বা বাদামি হয়ে আসে। তখন পোনা মজুতের উপযুক্ত সময়।

পোনা সংগ্রহের ক্ষেত্রে বিশ্বস্ত হ্যাচারির ওপর নির্ভর করা দরকার। পরিবহনের আগে পোনাকে চৌবাচ্চায় ৪-৫ ঘণ্টা উপোস রেখে তাদের টেকসই করে তুলতে হয়। পরিবহনের সময় পোনাগুলো যাতে অতিরিক্ত উত্তেজিত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

পাঙাশ মাছের উৎপাদন বাড়াতে মানসম্মত ও সুষম খাদ্য প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হয়। শুধু প্রাকৃতিক খাবার যথেষ্ট নয়। খাদ্যের পরিমাণ মাছের বয়স এবং ওজনের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হয়। ১৫ দিন পরপর কয়েকটি মাছের ওজন মেপে দেখা উচিত, মাছ সঠিকভাবে বাড়ছে কি না। খাদ্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় এবং পুকুরের ৬-৮টি নির্ধারিত স্থানে ছিটিয়ে দেওয়া উচিত। দানাদার খাবার ছিটিয়ে এবং বল আকারের সম্পূরক খাবার দিয়ে পুষ্টি নিশ্চিত করতে হয়। খাবার একবারে না দিয়ে ২-৩ বারে ভাগ করে দিলে উপকার হয়। পাশাপাশি চুন ও সার দেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে।

Advertisement

পাঙাশ মাছ সাধারণত ৫-৬ মাস পর গড়ে ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজন হয়। তখন বাজারের চাহিদা অনুযায়ী মাছের প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ বিক্রি করে দিলে অবশিষ্ট মাছ দ্রুত বাড়তে পারে।

মাছের চাষ বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যদি দেশের প্রায় আড়াই লাখ হেক্টর পুকুর ও ৬-৭ লাখ হেক্টর জলাশয়ে পরিকল্পিত ভাবে পাঙাশ চাষ করা হয়, তবে সামগ্রিক মৎস্য উৎপাদনে বিপুল উল্লম্ফন ঘটবে। এতে বেকার তরুণ ও নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ‘মাছেভাতে বাঙালি’ চেতনা ফিরিয়ে আনতে পাঙাশ মাছের চাষ হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।

এসইউ/জেআইএম