কৃষি ও প্রকৃতি

মাছ চাষে সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব

ড. ফোরকান আলী

Advertisement

কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচন এবং পুষ্টি চাহিদা পূরণে ক্রমবর্ধমান হারে অনন্য অবদান রেখে চলেছে মৎস্য খাত। মৎস্য খাতের এ ধারা অব্যাহত রাখার পক্ষে আভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় থেকে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য মৎস্য অধিদপ্তর কতিপয় বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এমন একটি পদক্ষেপের সফল উদাহরণ ময়মনসিংহ মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প।

১৯৯০ সালের জুলাই মাস থেকে ময়মনসিংহ জেলার ৬টি থানার একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে এ প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল—উন্নত মৎস্য চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণের মাধ্যমে লক্ষিত জনগোষ্ঠীর (ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষি)—১. আত্মকর্মসংস্থান২. পুঁজি সংগঠন এবং৩. দারিদ্র বিমোচন।

এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য নিম্নলিখিত কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়— প্রদর্শনী পুকুর স্থাপনের মাধ্যমে মৎস্য চাষে উদ্বুদ্ধকরণ

প্রকল্পের শরুতেই সংশ্লিষ্ট এলাকার জনসাধারণকে উন্নত মাছ চাষের কলাকৌশল হাতেকলমে শেখানো ও উৎসাহিত করণের লক্ষ্যে নির্বাচিত পুকুরে প্রদর্শনী মৎস্য চাষ কার্যক্রম শুরু করা হয়। ১ম ধাপে ৪৩ হেক্টর জলায়তনে ৫১১টি প্রদর্শনী পুকুর পরিচালিত হয় যার মাধ্যমে ১১৬ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদন সম্ভব হয়। ১৯৯৩-৯৪ সালে আরও ৫.৯ হেক্টর এলাকায় ১২৮টি পুকুরে এ জাতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। এ প্রদর্শনী মৎস্য চাষ কার্যক্রম এলাকার জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়।

Advertisement

ঋণ কার্যক্রম

প্রকল্প শুরু থেকেই ভূমিহীন এবং প্রান্তিক চাষিদের মৎস্য চাষ অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রযুক্তিগত সহায়তায় পাশাপাশি বিনা বন্ধকী ঋণপ্রদান কার্যক্রম চালু করা হয়। কার্প জাতীয় মাছের মিশ্র চাষ ও নার্সারি স্থাপনের জন্য ১ম ধাপে ৮২৩ জন চাষির মাঝে ৮৫.৮৫ লক্ষ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়। এর মাঝে শতকরা ভাগ ছিলেন মহিলা চাষি। ১-৩ বৎসর মেয়াদী এ ঋণের প্রায় শতকরা ৯৯ ভাগ আদায় করা সম্ভব। পরবর্তী পর্যায়ে (দ্বিতীয় ধাপের শুরুতে) প্রকল্প থেকে ঋণ বিতরণের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহকে সম্পৃক্ত করে এ কার্যক্রম জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কৌশলগত কারণে এনজিওদের সম্পৃক্ততার বিষয় বিবেচনায় আনা হয়।

সংযোগ চাষি কার্যক্রম

প্রকল্প এলাকার ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে যাতে উন্নত মৎস্য চাষ প্রযুক্তি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়। সেজন্য প্রদর্শনী ও ঋণদান কার্যক্রমের পাশাপাশি সংযোগ মৎস্য নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ কার্যক্রম জোরদার করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। ১ম ধাপ ও ২য় পর্যায়ের ১ম দিকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত এ কার্যক্রমে মোট ২৫৯৪ জন চাষি অন্তর্ভুক্ত হন। এসব চাষির পুকুরের মোট আয়তন ২৯৭ হেক্টর এবং উৎপাদন ১০৬৫ মেট্রিক টন মাছ।

প্রশিক্ষণ কার্যক্রম

প্রকল্পের আওতাভুক্ত সব পর্যায়ের মাছ চাষিদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি প্রকল্প এলাকায় কর্মরত সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সম্প্রসারণ কর্মীদের যুগোপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রকল্পের প্রথম ধাপের অভূতপূর্ব সাফল্যে দাতা সংস্থা ডানিডা প্রকল্পকে দ্বিতীয় ধাপ পর্যন্ত সম্প্রসারণের সুপারিশ করে। সরকার ও দাতা সংস্থার সমঝোতার প্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালের জুলাই মাস থেকে নতুন করে বৃহত্তর মনমনসিংহ এবং গাজীপুর তথা ৭টি জেলার ২৬টি থানায় প্রকল্প কার্যক্রমের ২য় পর্যায় বাস্তবায়ন শুরু হয়। এপ্রিল ১৯৯৯ সালে দাখিলকৃত প্রজেক্ট ডকুমেন্টে বিবৃত প্রপ্রোজল রিপোর্ট অনুযায়ী ২য় ধাপের ১ম বছর প্রকল্প থেকে লক্ষিত জনগোষ্ঠী তথা ভূমিহীন ও প্রান্তিক মৎস্য চাষিদের সরকারি ঋণ প্রদানের প্রস্তাব রাখা হয়। ২য় বছর থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং উপযুক্ত এনজিওকে এ কাজে সম্পৃক্ত করতে পরামর্শ দেওয়া হয়।

প্রদর্শনী ও ঋণপ্রদান কার্যক্রম

প্রথম ধাপের মতো অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করার জন্য ২য় ধাপে থানা পর্যায়ে প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৯৩-৯৭ পর্যন্ত এনজিওদের অংশগ্রহণ ব্যতিরেকেই প্রকল্প কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়। নানা কারণে এ সময়ের মাঝে এনজিও সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়নি। এরই মাঝে মধ্যবর্তী মূল্যায়ন (যা ১৯৯৬ সালে দাতা সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত হয়) রিপোর্ট অনুযায়ী বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ, দাতা সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহের গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা ও সমঝোতা অনুযায়ী ৯৮ সালের ৩ মে তারিখ থেকে ত্রিপাক্ষিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ প্রকল্পের নতুন পদযাত্রা শুরু হয়। এদিন এনজিও দাতা সংস্থা (ডানিডা) এবং সরকারের মনোনীত প্রতিনিধির মাঝে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে।

Advertisement

নব আঙ্গিকে দ্বিতীয় ধাপ

প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ভৌত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৫ হাজার পুকুরে গড়পড়তা ২.৫ টন/হেক্টর মাছ উৎপাদন করা হবে। এরই মধ্যে ২০ হাজার পুকুরে ঋণ প্রদান/প্রযুক্তি সম্প্রসারণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। অবশিষ্ট ৫ হাজার পুকুরে উন্নত মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এনজিওদের ঋণ প্রদানের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়েছে। ত্রিপাক্ষিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।

বর্তমানে বাস্তবায়নাধীন কার্যাবলির কতিপয় কৌশল নিম্নে বর্ণিত হলো—

১. উন্নত মৎস্য চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণে এক কেন্দ্রিক লক্ষ্যমাত্রার পরিবের্ত দলীয় লক্ষ্যমাত্রার কাজ করা। ২. ঋণ কার্যক্রমের ক্ষেত্রে মৎস্য চাষি দল গঠনের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা প্রদান করা। ৩. প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণমূলক কর্ম সম্পাদন ও শিখন পদ্ধতি বাস্তবায়ন করা। ৪. কম ব্যয় করে মাছ উৎপাদন করার পদক্ষেপ গ্রহণ সম্ভাব্য উৎপাদন উপকরণ চাষির নিজ উদ্যোগে আহরণ ও বিনিয়োগ করা। যেমন- গোবর, ক্ষেত্র বিশেষ কুড়া ইত্যাদি।৫. সহজ শর্তে এনজিওদের মাধ্যমে ঋণদান কর্মসূচি।৬. পুনঃপৌনিক মাছ ধরা এবং পুনঃমজুত কৌশল অবলম্বন।৭. নিম্ন পর্যায় থেকে মৎস্য চাষি দলের মাধ্যমে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি ও বাস্তবায়ন।৮. ১০-১৫ জন সদস্যের যে মৎস্য চাষি দল গঠিত হবে, সেখানে খাবার মাছ উৎপাদনকারী মৎস্য চাষি, নার্সারি পরিচালনাকারী, পোনা ব্যবসায়ী মাছ ধরা ও বাজারজাতকারী উপকরণ প্রস্তুতকারী (যেমন জাল নির্মাতা) প্রভৃতি মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনার বহুমুখী কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গকে একত্রিত করা।৯. চাষি দলের নির্বাহী কমিটি গঠন করে স্থানীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণক্ষম নেতৃত্ব গড়ে তোলা। সব পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি ও ক্ষমতায়নের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।১০. প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ও (অন্যূন ৫ বছর) প্রচলিত কার্যক্রম পরিচালনার এনজিও (ডিওএফ) সহযোগিতা অব্যাহত রাখা।

এ ছাড়া প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কতিপয় নতুন ও অভিনব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে। এর মাঝে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো:কেন্দ্রীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সরকার ও দাতা সংস্থার অংশীদারত্বের পাশাপাশি সহযোগী এনজিওদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে।

দল গঠনে ও প্রেরণা সৃষ্টি প্রশিক্ষণ, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিপ্রযুক্তি হস্তান্তর ও ঋণকর্মসূচি বাস্তবায়ন–প্রতিটি ক্ষেত্রে ডিওএফ, ডিটিএ এবং এনজিওদের ও সরাসরি অংশগ্রহণের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করা হয়েছে।

প্রকল্পভুক্ত কর্মকর্তাদের থেকে প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ও থানা মহিলা উন্নয়নকারী এবং তদনিম্নপদস্ত কর্মচারীদের সংশ্লিষ্ঠ এনজিওদের নিকট ন্যাস্ত করা হয়েছে। প্রকল্প মেয়াদে এদের যাবতীয় ব্যয় (বেতন ভাতাদি) ডিটিএ বহন করবে। এটি করা হয়েছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ জনবলকে এনজিওদের সহায়তা দানে নিযুক্ত করার জন্য। যাতে প্রকল্পের সুচারুরূপে সম্পন্ন করা যায়।

কেন্দ্রীয় ব্যবস্থপনার পাশাপাশি জেলা ও থানা পর্যায়ে ও ত্রিপাক্ষিক ব্যবস্থাপনার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এনজিওদের ভৌত সুবিধাদি অফিসও সম্প্রসারণ সরঞ্জামাদি যানবাহন ইত্যাদি প্রকল্প মেয়াদকালীন ব্যবহারের জন্য প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরবরাহ করা হয়েছে।

আশা করা যায়, নতুন পর্যায়ে প্রকল্পের এ পদযাত্রার মাধ্যমে আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে একটি সফল লাভজনক কর্মসূচি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। একই কৌশল অবলম্বন করে পটুয়াখালী বরগুনা মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প এবং বৃহত্তর নোয়াখালী জেলায় মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য উৎপাদনের ক্রমহ্রাসমান প্রবণতার মোকাবিলা ময়মনসিংহ মৎস্য চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্প একটি সাহসী ও বাস্তবমুখী কর্মপ্রয়াস হিসেবে ইতোমধ্যে চিহ্নিত হয়েছে।

আমাদের প্রত্যাশা

প্রকল্পের লক্ষ্যে জনগোষ্ঠীর তথা ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিরা নারী ও পুরুষ উন্নত মৎস্য চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে আয়বর্ধনমূলক কর্মকাণ্ডে সরাসরি অংশগ্রহণ করে স্ব-কর্মসংস্থানে সক্ষম হবেন। যার ফলশ্রুতিতে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থান ও ভৌত অবস্থার উন্নয়ন হবে। থানা পর্যায়ে মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ বর্তমান ক্ষমতা আরও বাড়বে এবং প্রকল্প এলাকার বদ্ধ জলাশয় উন্নত মৎস্য চাষ প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে মৎস্য উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। এনজিওদের মাধ্যমে পুকুর পরিচালনাকারীরা মৎস্য উৎপাদন জন্য সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়ে নিশ্চয়তা লাভ করবেন।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ।

এসইউ/জিকেএস