ধর্ম

তিউনিসিয়ার আটশ বছরের পুরোনো মসজিদ জামে তালাকিন

তিউনিসিয়ার আটশ বছরের পুরোনো মসজিদ জামে তালাকিন
মওলবি আশরাফ

জামে তালাকিন—তিউনিসিয়ার জারবা দ্বীপের গিজান এলাকায় অবস্থিত প্রায় আটশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক মসজিদ।

Advertisement

মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল হিজরি ৬০১ সাল মোতাবেক ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে। এর নির্মাতা ছিলেন শায়খ সুলায়মান ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবু জায়েদ আস সিদগিয়ানি। তার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় কয়েকজন আলেম ও ধর্মপ্রাণ মানুষ, যাদের আন্তরিক সহায়তায় মসজিদটির ভিত্তি গড়ে ওঠে।

এই অঞ্চলে এসে সর্বপ্রথম বসতি স্থাপন করেছিলেন ‘লাকিন’ নামের এক ব্যক্তি, চতুর্থ হিজরি শতকে। তিনিই এখানে ছোট একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তার নামে ওই এলাকার নাম হয় ‘হুমাতু বনি লাকিন’ এবং পরবর্তীকালে নির্মিত মসজিদের নাম হয় ‘জামে লাকিন’। কিন্তু স্থানীয় আমিজাগি ভাষার লোকজন একে ‘জামে তালাকিন’ বলতে শুরু করে।

প্রথমে মসজিদটি ছিল মাত্র সাড়ে তিন মিটার চওড়া একটি চতুর্ভুজ ঘর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুসল্লির সংখ্যা বাড়তে থাকলে ৬০১ হিজরিতে স্থানীয় আলেমগণের উদ্যোগে মসজিদের আয়তন বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়। ৬৪৩ হিজরিতে আরও কিছু কাঠামোগত সংস্কার করা হয়।

Advertisement

ছবি: সংগৃহীত

এই মসজিদের ব্যবহার ছিল বহুমাত্রিক। এখানে যেমন নামাজের স্থান ছিল, আবার একই সঙ্গে ছিল একটি শিক্ষাকেন্দ্র, ইসলামি আইনচর্চার মজলিস, বিচারালয় ও পানি সরবরাহের উৎস। বহু যুগ পর্যন্ত এখানে বসেছে ইবাদি মাজহাবের ‘মজলিসুল ইজাবা’ যে মজলিসে জটিল জটিল সব সামাজিক প্রশ্নের ফয়সালা হতো। এই মসজিদের বিচারকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খ্যাতিমান আলেম শায়খ মুহাম্মদ ইবনু আবি সিত্তা আল মাহশি। ত্রয়োদশ শতকের বিখ্যাত আফ্রিকীয় কবি শায়খ সাইদ ইবনে আইয়ুব আল বারুনি তার এক কবিতায় এ মসজিদের কথা উল্লেখ করে বলেন:

سلوا مسجد لاكين إن كنتم تسألوا ولكن كلكم عن السؤال غفلযদি জানতে চাও, তবে জামে লাকিনকে জিজ্ঞাসা করোকিন্তু তোমরা সবাই তো প্রশ্ন সম্পর্কেই উদাসীন

এই কবিতা থেকে বোঝা যায় সেই যুগে জামে লাকিনের অবস্থান কোন পর্যায়ে ছিল।

Advertisement

জামে লাকিনের চারপাশে প্রাচীর, তিনটি প্রবেশপথ—পশ্চিমে দুটি, উত্তরে একটি। এর উত্তরদিকে আছে একটি খোলা বারান্দা, যেখানে বসে আলোচনা, পাঠ বা বিশ্রাম করা যায়।

চারটি ‘মিজওয়াল’ বা পাথরের তৈরি ছোট জলাধার আছে, যেখানে বৃষ্টির পানি জমা হয়। এই পানি ওজু ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হয়।

পাশাপাশি আছে একটি বড় ‘ফুসকিয়া’, অর্থাৎ খোলা আকাশের নীচে নির্মিত বিশাল হাউস, যা পুরো এলাকার জন্য ছিল একপ্রকার রেইনওয়াটার রিজার্ভার।একটি ‘মিদাহ’ আছে, অর্থাৎ পাথরের বেসিনবিশিষ্ট জায়গা, যেখানে মুসল্লিরা ওজু করেন।

একটি নিভৃত কক্ষ আছে, যেখানে ইতিকাফ, ধ্যান ও একান্ত সাধনার জন্য আলেম-সাধকরা অবস্থান করেন।

ছবি: সংগৃহীত

পশ্চিম পাশে আছে একটি ছোট লাইব্রেরি, যা শিশুদের জন্য ইসলামের মৌলিক শিক্ষার কেন্দ্র। একটি মজুদখানা আছে, যেখানে মসজিদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী, পুরাতন দলিল ও ধর্মীয় পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করা হয়।

আর আছে একটি মিনার, যেখান থেকে প্রাচীন কালে আমলে উপকূলের সংকেত দেখা ও উত্তর গিজানের মসজিদগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। মিনারের চূড়ায় আজও নজরদারির ছিদ্র রয়ে গেছে। উত্তরের উপকূলে কোনো ধোঁয়া বা আগুনের সংকেত দেখা গেলে এই মসজিদ থেকে সেই সংবাদ দ্বীপের কেন্দ্রে পৌঁছে দেওয়া হতো।

মসজিদটি এলাকাবাসীর জন্য পানির উৎসও বটে। বহু যুগ ধরে এখানকার মানুষ এখান থেকেই পানি সংগ্রহ করেছে। এই দিক দিয়ে জামে তালাকিন ছিল গিজান এলাকার প্রাণকেন্দ্র—ইবাদত, শিক্ষা, বিচার ও জীবনযাত্রার এক সম্মিলিত কেন্দ্রবিন্দু।

আজও মসজিদটি দাঁড়িয়ে আছে স্থানীয় জনগণের যত্নে, ভালোবাসায় কালের স্বাক্ষী হয়ে।

ওএফএফ/এএসএম