১৯ বছর—সময়টা অল্প নয়। এই দীর্ঘ সময়ের মাঝে আমি অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশবার এসেছি এস্তোনিয়ার রাজধানী তালিনে। কেউ হয়তো ভাববেন, এতবার একই শহরে যাওয়া—তাতে আর নতুন কী পাওয়ার থাকে? কিন্তু তালিন যেন তার প্রতিবারের সফরে নিজেকে নতুন করে আমার সামনে মেলে ধরে। প্রতিবার আমি কিছু একটা নতুন খুঁজে পাই। কখনো তা কোনো পুরোনো দেওয়ালের গায়ে লেগে থাকা শ্যাওলা, কখনো অচেনা কোনো অলিতে পড়ে থাকা কবোলস্টোন গলি, আবার কখনো নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো ইতিহাস-ভেজা টাওয়ারের চূড়া।
Advertisement
এ শহরের সাথে আমার প্রেম প্রথম দর্শনে হয়ে ওঠেনি। বরং ধীরে ধীরে, একেকটা সফরে, একেকটা ঋতুর রঙে তালিন আমার ভেতরে গেঁথে গেছে—গভীরভাবে, এক অদৃশ্য মায়াজালে। আজ আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, শহরটি শুধু আমার ভ্রমণের গন্তব্য নয়, এটি আমার আত্মার এক নির্জন আশ্রয়।
প্রতিবার এখানে এসে আমি হাঁটি সেই প্রাচীন পথ ধরে—যেখানে সময় থেমে গেছে। তালিনের পুরোনো শহর, তার গাঢ় লাল ছাদের টাওয়ার, পাথরের দেওয়াল, সরু গলিপথ আর প্রাচীন চার্চের ঘণ্টাধ্বনি—সব মিলিয়ে যেন এক রূপকথার শহর।
তালিনের প্রাচীর—ওল্ড টাউন ওয়াল—এ শহরের সেই অংশ; যা আমাকে বারবার ডেকে আনে, বারবার ছুঁয়ে যায় এক অদ্ভুত আবেগে। এটা শুধু একটা প্রতিরক্ষা দেওয়াল নয়, এটা এক মৌন প্রহরী—যার গায়ে হাজার বছরের গল্প আঁকা। কখনো প্রেমের, কখনো যুদ্ধের, কখনো বিশ্বাসঘাতকতার। এই দেওয়ালের দিকে তাকালেই আমার মনে হয়, আমি ইতিহাসকে ছুঁয়ে ফেলেছি। যেন পাথরের গায়ে হাত রেখে শুনতে পাচ্ছি মধ্যযুগের শ্বাসপ্রশ্বাস, শোনার মতো করে।
Advertisement
১৩শ শতাব্দীতে তৈরি এ প্রাচীর একসময় পুরো শহরকে ঘিরে রেখেছিল, যেন ভালোবাসার ঘেরাটোপে রাখা কোনো নরম প্রাণ। আজও সেই প্রাচীরের ১.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ অংশ দাঁড়িয়ে আছে, সময়ের তোয়াক্কা না করে। তার সাথে দাঁড়িয়ে আছে ২৬টি গার্দ টাওয়ার, প্রতিটিই একেকটা চরিত্র। ‘কিয়েক ইন ডে কোকে’ কিংবা ‘ফ্যাট মারগারেট’, প্রতিটি টাওয়ার যেন জানে এমন সব গোপন কথা, যা কেবল তার ভেতরের ছায়ারাই জানে।
আরও পড়ুন
পথের শেষে দাঁড়িয়ে পৃথিবী দেখতে চাই নরওয়ের স্বপ্নময় দুটি শহরে একদিনআমার প্রিয় মুহূর্তগুলোর একটি হলো, গোধূলির সময় তালিনের পুরোনো শহরের কোনো এক উঁচু পাথরের টাওয়ারে দাঁড়িয়ে দূরে তাকিয়ে থাকা। সেই মুহূর্তে মনে হয়, আমি একদম ইতিহাসের বুকের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। বাতাসে মিশে থাকে পুরোনো কাঠের ঘ্রাণ, দূর থেকে শোনা যায় হালকা ঘোড়ার গাড়ির চাকার শব্দ, আর সূর্য তখনো বিদায়ের আগে দেওয়ালের গায়ে এক শেষ স্পর্শ রেখে যায়।
শুধু পর্যটক নয়, আমি এখানে এসেছি এক আগ্রহী ইতিহাসপ্রেমী হয়ে, এসেছি এক ক্লান্ত হৃদয় নিয়ে, আবার এসেছি এক উদাস সন্ধ্যায় নিঃশব্দ আশ্রয় খুঁজতে। প্রতিবার এ শহর, এ প্রাচীর, আমাকে দিয়েছে প্রশ্রয়, দিয়েছে নিরাময়। আমার শৈল্পিক চোখ, আমার নীরব ভালোবাসা, সব যেন জমা পড়ে আছে এ শহরের পাথরের মাঝে।
Advertisement
তালিনের পুরোনো শহর আমাকে শিখিয়েছে—একটা শহরের সৌন্দর্য কেবল তার উচ্চতা নয়, তার অতীত, তার নীরবতা, তার সময়কে ধরে রাখার ক্ষমতা। আজকের আধুনিক, প্রযুক্তিনির্ভর এস্তোনিয়ার বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এ প্রাচীন দেওয়াল যেন এক বিপরীত উচ্চারণ—যেখানে প্রযুক্তির ছুটন্ত ছায়ার মাঝেও টিকে আছে ইতিহাসের ধীর প্রহর।
আমি জানি না, এ শহরে আমার শেষযাত্রা কবে হবে। কিন্তু এটা জানি—তালিনের এ দেওয়ালের দিকে আমি যতবার তাকাই; ততবার আমার হৃদয়ে জেগে ওঠে এক নতুন অনুভব, এক নতুন ভালোবাসা। এ এক প্রেম—যা অতীতকে ভালোবাসে, নিঃশব্দতাকে শ্রদ্ধা করে এবং বারবার ফিরে আসতে শেখায়।
তালিনের পথে আমি হাঁটি—কিন্তু মনে হয়, আমি আসলে নিজেকেই খুঁজে ফিরি। দেওয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আমি যেন শুনি আমার মনের শব্দ। এ শহর, এ প্রাচীর, এ ইতিহাস—সব মিলিয়ে তালিন আমার কাছে শুধু একটি জায়গা নয়, এক হৃদয়ের ঠিকানা।
এসইউ/এমএস