ভ্রমণ

মাদারীপুরের ‘খালিয়া’ হতে পারে পর্যটন এলাকা

মাদারীপুরের ‘খালিয়া’ হতে পারে পর্যটন এলাকা

মাদারীপুরের প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পত্তির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজৈর উপজেলার টেকেরহাটের খালিয়া এলাকা। ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ পুরোনো অনেকগুলো স্থাপনা ঘিরে এলাকাকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ ছাড়া এখানে বিশাল এলাকাজুড়ে বিভিন্ন ধরনের গাছ ও পুরোনো স্থাপনা নিয়ে গড়ে উঠেছে শান্তিকেন্দ্র। ফলে পর্যটকরা এ এলাকায় এলে সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হবেন। পাশাপাশি পুরোনো স্থাপনাগুলো নিয়ে গবেষণাও করতে পারবেন।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার টেকেরহাটের খালিয়া এলাকায় পুরোনো অনেকগুলো মন্দির, জমিদার বাড়ি আছে। যা যে কারো নজর কাড়ে। অভিভূত হয় সৌন্দর্যপিপাসু মানুষ। এলাকায় পুরোনো স্থাপনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো অন্নপূর্ণার মন্দির, কবি কিরণ চন্দ্র দরবেশের বাড়ি, জমিদার শিশির গাঙ্গুলীর বাড়ি, অগ্নিপুরুষ চিত্তপ্রিয়রায় চৌধুরীর সমাধি, লেখক পি কে গুহর বাড়ি, কালি প্রসাদ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়ি, অগ্নিপুরুষ পূর্ণচন্দ্র দাসের বাড়ি, জমিদার রাজা রাম রায় চৌধুরীর বাড়ি, রাজা রাম রায় চৌধুরীর মন্দির (দেউল), রাজা রাম রায় চৌধুরীর সমাধি প্রমুখ। এ ছাড়া ৬ একর জমির ওপরে গড়ে উঠেছে শান্তিকেন্দ্র। যা পিকনিক স্পট হিসেবে ব্যবহার করার মতো।

অন্নপূর্ণার মন্দিরঅন্নপূর্ণার মন্দিরটি অষ্টদশ শতাব্দীতে খালিয়ার জমিদার প্রতিষ্ঠা করেন। যেন তার প্রজারা ‘দুধে ভাতে’ থাকেন এ প্রত্যাশায়। মন্দিরটি বর্তমানে বেসরকারি সংস্থা গণ উন্নয়ন প্রচেষ্টার তত্ত্বাবধানে আছে। মন্দিরের ভেতরে প্রতিষ্ঠিত অষ্টধাতু ও স্বর্ণমিশ্রণে তৈরি মূর্তিটি এখন আর নেই। স্বাধীনতার আগে চুরি হয়ে গেছে। বর্তমানে সেখানে মাটির তৈরি একটি মূর্তি আছে।

কবি কিরণ চন্দ্র দরবেশের বাড়িকবি কিরণ চন্দ্র দরবেশের লেখা ‘মন্দির’ কাব্যগ্রন্থটি ব্রিটিশ আমলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য ছিল। তিনি কলকাতার ‘কাশি’ সাহিত্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন। খালিয়ায় অবস্থিত তার বাড়িটি দিনে দিনে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে।

Advertisement

জমিদার শিশির গাঙ্গুলীর বাড়িজমিদার শিশির গাঙ্গুলী জমিদার না হয়েও জমিদার নামে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জমিদার প্রথা বিলুপ্তি হলে জমিদাররা যখন একে একে চলে গেছেন। তখন তিনি থেকে যান। তার এমন সাহসী ভূমিকার জন্য তিনি এলাকায় জমিদার নামে পরিচিতি পান। বাড়িটি অপূর্ব নির্মাণশৈলীর জন্য অনবদ্য। তবে বর্তমানে বাড়িটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। বাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করে সংরক্ষণ না করলে ধ্বংস হয়ে যাবে।

অগ্নিপুরুষ চিত্তপ্রিয়রায় চৌধুরীর সমাধিঅগ্নিপুরুষ চিত্তপ্রিয় রায় চৌধুরীর বাবা পঞ্চনন চৌধুরী আঠারোশ শতকের শেষদিকে মাদারীপুর মহকুমার অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তার কৃতি সন্তান চিত্তপ্রিয়রায় চৌধুরী ব্রিটিশ আমল কাঁপানো বিপ্লবী ছিলেন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শান্তিসেনা দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তাঁর সমাধিটি খালিয়ায় অবস্থিত।

লেখক পি কে গুহর বাড়িপাকিস্তান আমলের শেষদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন লেখক পি কে গুহ। তিনি রাজৈর উপজেলার ইশিবপুর হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। পরে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক হন। বর্তমানে তাঁর খালিয়ায় অবস্থিত বাড়িটি রাজস্ব অফিস হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

কালিপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়কালিপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়ের বাড়িটি খালিয়ায় অবস্থিত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শান্তিসেনা সংগঠনের তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন তিনি।

Advertisement

জমিদার রাজা রাম রায় চৌধুরীর বাড়িজমিদার রাজা রাম রায় চৌধুরীর বাড়ি খালিয়ায় অবস্থিত। জমিদার রাজা রাম রায় চৌধুরী আনুমানিক ৩৮৫ বছর পূর্বে খালিয়ার রাজা ছিলেন। তাঁর তৈরি বিখ্যাত রাজা রাম মন্দিরটি টিকে থাকলেও তার বাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন নেত্রকোনায় চন্দ্রডিঙ্গার ছায়ায় একদিন লক্ষ্মীপুর জেলায় ভ্রমণের সেরা ১০ স্থান

রাজা রাম রায় চৌধুরীর মন্দির (দেউল)অনুুমানিক ৩৬৫ বছর পূর্বে মুঘল আমলে ষোড়শ শতাব্দীতে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন রাজা রাম রায় চৌধুরী। অপূর্ব সুন্দর নির্মাণশৈলীর মন্দিরটি বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করছে। ২৩ শতাংশ জমির ওপর অবস্থিত রাজা রাম মন্দিরটি। ২০ ফুট দৈর্ঘ, ১৬ ফুট প্রস্থ ও ৪৭ ফুট উচ্চতার মন্দিরটি দেখতে অনেকটাই চৌচালা ঘরের মতো। মন্দিরজুড়ে টেরাকোটায় রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্যাবলি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেব-দেবী, পশু-পাখি ও লতা-পাতার অসংখ্য চিত্র আছে। মন্দিরটি দেখতে খালিয়ায় দর্শনার্থী বেশি আসেন।

অগ্নিপুরুষ পূর্ণচন্দ্র দাসের বাড়িখালিয়া হাইস্কুলের পাশে অবস্থিত অগ্নিপুরুষ পূর্ণচন্দ্র দাসের বাড়ি। তিনি মাদারীপুরের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শান্তিসেনা নামক দলটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাঁর জীবনের প্রায় সময় জেলের অভ্যন্তরে কাটিয়েছেন। বাড়িটি বর্তমানে ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাড়িটি সংরক্ষণ করা উচিত।

শান্তিকেন্দ্র সাড়ে ছয় একর জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তিকেন্দ্রটি। এটি প্রতিষ্ঠা করেন গণ উন্নয়ন প্রচেষ্টা নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। শান্তিকেন্দ্রে ঢুকতেই প্রথমে পুরোনা অন্নপূর্ণার মন্দির। মন্দিরের পাশেই একটি পুকুর ও একটি লাইব্রেরি। এতে দুই হাজারের বেশি বই আছে। বিকেলে এটি সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়। পুরাকীর্তি ও জমিদার বাড়িগুলোর মধ্যে দুর্গা দাস ব্যানার্জির বাড়ি, ফটিক মোহন ব্যানার্জির বাড়ি, গুহ চৌধুরীর বাড়ি আছে। আরও আছে একটি মসজিদ ও দিশারী শিশু বিদ্যালয় নামে একটি স্কুল। স্কুলে শিশু শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। বিভিন্ন ধরনের ফুল ও ফলের গাছ আছে। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ হওয়ায় পিকনিক স্পট হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ আছে।

অন্যান্য স্থাপনাখালিয়া এলাকায় অর্ধশত পুরোনো বাড়ি ও মঠ আছে। যা এখনো পর্যটকদের মুগ্ধ করে। তাই এ এলাকায় যে একবার যাবেন; তার বার বার যেতে ইচ্ছে করবে। পুরার্কীতির দর্শণে বিমুগ্ধ হয়ে যাবেন। এখানেই কয়েক বছর আগে গণ উন্নয়ন প্রচেষ্টার উদ্যোগে গড়ে ওঠে শান্তিকেন্দ্র, শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং হাসপাতালসহ নানা প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে দিনের পর দিন এলাকাটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে।

যাতায়াত ব্যবস্থাফিডার সড়ক মন্দিরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করায় যাতায়াতে সুবিধা আছে। এখনো শীতকাল এলে শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলার লোকজন ঘুরতে আসে। ওই সময় কোলাহলে মুখরিত হয়ে থাকে খালিয়া এলাকাটি। গত কয়েক বছর ধরে লোকজন আসা কমে গেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

স্থানীয়রা যা বললেনপ্রবীণ বাসিন্দা বাদল দাস বলেন, ‘খালিয়ার আনাচে কানাচে অনেক পুরোনো বাড়ি আছে। যা পুরাকীর্তি। এখানে অনেকগুলো জমিদার বাড়ি ও মন্দির আছে। যা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অনেকগুলোই ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেকগুলো ধ্বংসের পথে। যা আছে; তা রক্ষা করতে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত।’

ফ্রেন্ডস অব নেচারের সদস্য মো. মামুন বলেন, ‘খালিয়ায় রাজা রাম মন্দিরসহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরাকীর্তি ও জমিদার বাড়িগুলো নিয়ে একটি সুন্দর পর্যটন কমপ্লেক্স গড়ে তোলা যায়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ রাজা রাম মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেছে। তবে নতুন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কারো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। দর্শনীয় এলাকাটি পর্যটনের অধীনে আনা হলে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের পদভারে মুখরিত হবে।’

ইতিহাস গবেষক সুবল বিশ্বাস বলেন, ‘এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরাকীর্তি ও জমিদার বাড়িগুলো নিয়ে পর্যটন কমপ্লেক্স গড়ে তোলা যায়। প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বা পর্যটন কর্পোরেশনের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে না। পর্যটন কর্পোরেশন পুরাতন পর্যটনকেন্দ্রগুলো নিয়ে আঁকড়ে আছে। তাই নতুন পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার দাবি জানাই। যাতে নতুন প্রজন্ম এগুলো সম্পর্কে জানতে পারে।’

উন্নয়ন সংস্থা দেশগ্রামের নির্বাহী পরিচালক এবিএম বজলুর রহমান খান বলেন, ‘প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হলো অতীতের সামগ্রিক জীবনের রূপরেখা। কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া এসব নিদর্শন প্রত্নতাত্ত্বিকদের সৃষ্টিশীল চিন্তার ধারাবাহিকতায় নতুন করে আবিষ্কারের মাধ্যমে আবার মানুষ জানার সুযোগ লাভ করে। একটি দেশের অতীত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিষয় সহজভাবে জানার সুযোগ করে দেয় এ পুরাকীর্তি। তাই এগুলো রক্ষা করা সরকারের পাশাপাশি সবার দায়িত্ব।’

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্যরাজৈরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহফুজুল হক বলেন, ‘খালিয়ার ঐতিহ্যবাহী রাজা রাম মন্দিরটির দেখাশোনা করছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। যেহেতু খালিয়া এলাকা পুরাকীর্তিতে ভরপুর। তাই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে এগুলো রক্ষার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এলাকাটিতে পর্যটকরা যেন বেশি আসেন, সে ব্যাপারেও নজর দেওয়া হবে।’

এসইউ/এএসএম