মো. রাহুল শেখ
Advertisement
ঘরের চার দেওয়ালে সব সত্য মেলে না। বিশ্বই আমাদের জন্য মহাজগতের দুয়ার খুলে দেয়। প্রকৃতি নীরবে অনেক কিছু শেখায়। ভ্রমণেই মেলে আত্মিক শান্তি। এ চিরন্তন সত্যগুলো যেন সবারই জানা। এসবই আমাদের মনে ভ্রমণের অন্যরকম আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তোলে। ঢাকার ব্যস্ত জীবনে পড়াশোনা, টিউশন আর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের মাঝে ডুবে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তাই মন চাইলো একটু সতেজ হতে। যেই ভাবা; সেই কাজ! গন্তব্য স্থির হলো বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর পার্বত্য চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড।
যাত্রা শুরুর প্রস্তুতিদুই দিনের ছুটি পেয়ে আমরা সাত বন্ধু বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষে সাড়ে তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে কুমিল্লার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় কুমিল্লা পৌঁছলাম। সীতাকুণ্ড যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলাম। যা ঢাকা থেকে রাত ১১টায় ছাড়ার কথা থাকলেও কুমিল্লা পৌঁছবে ভোর ৪টায়।
বন্ধুর বাসায় রাতআমরা কুমিল্লার এক বন্ধুর বাসায় রাত কাটালাম। সারারাত গল্প, আড্ডা আর হাসি-তামাশায় কেটে গেলো। কারো চোখেই একফোঁটা ঘুম ছিল না। ভোর চারটা বাজতেই আমরা স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ট্রেন তিন ঘণ্টা দেরিতে অর্থাৎ সকাল সাতটায় কুমিল্লা স্টেশনে পৌঁছলো। আমরা তড়িঘড়ি করে ট্রেনের ছাদে উঠে পড়লাম। ট্রেন সর্পিল গতিতে ছুটে চলছিল। চারপাশে বিস্তীর্ণ সবুজ আর সোনালি বাংলার প্রান্তর দিয়ে। ছাদে বসে দুপাশে হাত ছড়িয়ে মুক্ত বাতাসে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, উন্নত জীবনের আশায় কেন যে মানুষ ঢাকা আসে! আরও কত কী ভাবনা মনে উঁকি দিচ্ছিল।
Advertisement
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অবগাহনএভাবে মুক্ত বাতাস গ্রহণ, আনন্দ-উল্লাস, দার্শনিক চিন্তা-ভাবনা আর ছবি তুলতে তুলতে সকাল সাড়ে নয়টায় সীতাকুণ্ড স্টেশনে পৌঁছলাম। ট্রেনের ছাদে বসে প্রকৃতি, সবুজে ঘেরা বিস্তীর্ণ মাঠ আর সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের দৃশ্য সত্যিই উপভোগ করার মতো। যদিও এটি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পরামর্শ থাকবে, ট্রেনের ছাদে যাত্রা এড়িয়ে চলুন। কারণ রাস্তায় অনেক গাছপালা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশস্টেশন থেকে নেমেই খাবারের জন্য একটি রেস্টুরেন্টে গেলাম। সেখান থেকে খেয়েই বাসে বোটানিক্যাল গার্ডেন, সুপ্তধারা ঝরনা এবং ইকোপার্কের পথে ছুটলাম। ইকোপার্কের মূল সড়কে বাস থেকে নেমে হেঁটে পার্কের গেটে পৌঁছলাম। সেখানকার হোটেল কর্মচারীদের আতিথেয়তা মন ছুঁয়ে গেলো। নিজেদের ব্যাগ হোটেল কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে রেখে পার্কে প্রবেশের টিকিট নিয়ে ঢুকে পড়লাম বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বপ্নরাজ্যে।
সুপ্তধারা ঝরনাপার্কের ভেতরে সিএনজিচালিত গাড়ি দেখা গেলো। অনেকেই দূরের রাস্তা পাড়ি দিতে গাড়ি ব্যবহার করছিলেন। আমরা হেঁটে সুপ্তধারা ঝরনার দিকে রওয়ানা হলাম। আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথ পাড়ি দিয়ে ঝরনায় পৌঁছানোর রাস্তায় চলে এলাম। ঝরনায় পৌঁছাতে দীর্ঘ পথ সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে। ভেতরের ভালো লাগা আর উত্তেজনা নিয়ে নামতে নামতে পৌঁছে গেলাম ঝরনার সামনে। মনে হলো যেন এক জঞ্জালমুক্ত পরিবেশে এসেছি। ঝরনার পানিতে নিজেদের ডুবিয়ে নিলাম। বিভিন্ন স্টাইলে একক এবং গ্রুপ ছবি তুললাম। হঠাৎ গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি নামলো। সে এক ভিন্নরকম অনুভূতি! মনের মধ্যে উচ্চারিত হতে লাগল, ‘গুড়গুড়ি ধ্বনি পাহাড়ের বাজে, প্রকৃতির প্রাণ ঝরনায় সাজে। মনটা চায় হারিয়ে যেতে, বৃষ্টির গল্প কানে পেতে।’
আরও পড়ুন সবুজে ঘেরা শেরপুরের রাজার পাহাড় ঝরনা ও পাহাড় ভ্রমণে যেসব সতর্কতা জরুরিসহস্রধারা ঝরনাএবার সহস্রধারা ঝরনায় যাওয়ার পালা। সুপ্তধারা থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বের হলাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে সিঁড়িগুলো পিচ্ছিল ছিল, যা বেশ বিপজ্জনক। পরামর্শ থাকবে, বর্ষা মৌসুমে ঝরনা পরিদর্শনে বিরত থাকার। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই কোমলপানীয়ের তৃষ্ণা পেলো। দোকানে লাচ্ছি কিনতে গিয়ে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হলো। ২০ টাকার লাচ্ছি ৩০ টাকা!
Advertisement
জোঁকের আতঙ্কএবার আরও বহুদূর হাঁটতে হবে। ক্রমেই যেন উঁচুতে উঠছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে সহস্রধারা ঝরনায় পৌঁছানোর মূল সিঁড়িতে চলে এলাম। সতর্কতার সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে কাদামাখা সিঁড়ি বেয়ে ঝরনার সামনে নেমে গেলাম। তখনো ভিন্নরকম চিত্র! মনে হচ্ছিল, যেন রূপকথার গল্পের মতো আমরা নিজেদের মিলিয়ে নিচ্ছি। সেখানে পৌঁছাতেই কিছু পর্যটকের মুখে জোঁকের আতঙ্ক শুনলাম। তবে ভয় না পেয়ে পানিতে নেমে পড়লাম। নিজেদের ভিজিয়ে মনে হচ্ছিল, এতদিনে জমে থাকা ক্লান্তি আর বিষাদ শরীর থেকে ধুয়ে যাচ্ছে।
দুপুরের খাবারএখানে সময় কাটাতে কাটাতে প্রায় দুটা বেজে গেল। এবার আমরা খাবার এবং ফ্রেশ হওয়ার জন্য যে হোটেলে ব্যাগ রেখে এসেছিলাম; সেদিকে রওয়ানা হলাম। হোটেলে এসে মাথাপিছু ১০০ টাকার প্যাকেজে মুরগির মাংস, ডাল, সবজি এবং ভাত খেলাম। তখন প্রায় চারটা বাজে।
গুলিয়াখালী সৈকতেএবার বাসে করে সীতাকুণ্ড বাজারে পৌঁছলাম। উদ্দেশ্য গুলিয়াখালী সৈতক। সীতাকুণ্ড বাজার থেকে সিএনজিতে ত্রিশ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে সৈকত সংলগ্ন স্ট্যান্ডে পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নেমে মাটির সরু রাস্তা দিয়ে ধীর পায়ে গুলিয়াখালী গেলাম। এর আরেক নাম ‘মুরাদপুর বিচ’। দূর থেকেই সমুদ্রের গর্জন শুনছিলাম। সৈকতে যাওয়ার রাস্তার ধারে ‘ম্যানগ্রোভ বন’ দেখলাম, যা সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বেশ উদ্দীপনার সাথে সমুদ্রের গর্জন আর ঢেউ উপভোগ করতে নেমে পড়লাম।
বৃষ্টির হানাতখন অনেকটা সন্ধ্যা হয়ে এসেছে এবং গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমরা সৈকতে অবস্থিত একটি দোকানে আশ্রয় নিলাম। বৃষ্টি কিছুটা থামতেই সিএনজি স্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করলাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে মাটির সরু রাস্তা কাদা এবং পিচ্ছিল হয়ে ছিল। অনেকেই কাদাযুক্ত রাস্তা পাড়ি দিতে পারছিলেন না। এখানেও ভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। এ সময় ট্রলারে ১০ টাকার ভাড়া ৫০ টাকা দাবি করে যাত্রী বহন করতে দেখা যায়। বিষয়গুলো তদারকি করার জন্য প্রশাসনের সুদৃষ্টি দরকার। এমনকি পর্যটকদের বর্ষা মৌসুমে সৈকত ভ্রমণ পরিহার করার পরামর্শ থাকবে।
ফিরতি পথের স্মৃতিসিএনজি স্ট্যান্ডে এসে গাড়িতে করে সীতাকুণ্ড বাজারে পৌঁছলাম। সেখান থেকে বাসের টিকিট কেটে রাত সাড়ে আটটায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। সারারাত বাস চললো, আমরা ঘুমিয়ে কাটালাম। কুমিল্লায় যাত্রাবিরতি পেয়ে সামান্য নাস্তা করার পর আবার বাস ছুটে চললো। রাত দুটায় ঢাকায় পৌঁছলাম। যে যার বাসায় চলে গেলাম। বারবার মনে হচ্ছিল, ‘ইচ্ছে কী হয় ওই পাহাড়ি ঝরনা, সমুদ্রের গর্জন ছেড়ে ইট-পাথরের এই শহরে ফিরে আসতে? মন যে চায়, পড়ে থাকি ওই সমুদ্রের পাড়ে; ঝরনার পানিতে দেহ ভিজিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে।’
লেখক: শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এএসএম