গাইবান্ধা-৫ আসনটি ফুলছড়ি এবং সাঘাটা নিয়ে গঠিত। এই আসনে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে ধারণা করছেন ভোটররা। দীর্ঘদিনের দুই জোটসঙ্গী বিএনপি-জামায়াতে এ লড়াই হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ধানের শীষ-দাঁড়িপাল্লা কোন দিকে গড়াবে ভোটারদের সমর্থন তা দেখার জন্য নির্বাচনের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
Advertisement
দীর্ঘ আওয়ামী শাসনাবলে বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশের ভয়ে কোথাও চলাফেরা করতে পারেননি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর কোনো অফিস ছিল না। তারাও প্রকাশ্যে মিছিল-মিটিং করতে পারতেন না। এখন দুই দলের অফিসেই নেতাকর্মীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো। দুই দলের লোকজনের মাঝে একটা চাঙা ভাব কাজ করছে। তারা ফুরফুরে মেজাজে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন।
এ আসনে একসময় বেশ রমরমা দশা ছিল নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের। এখন তাদের অফিসেরও কোনো অস্তিত্ব নেই। নেতাকর্মীরা যার যার অবস্থান থেকে পালিয়ে আছেন। শীর্ষস্থানীয় ও গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ফোন বন্ধ। আর তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র জাতীয় পার্টি ও জাসদের কর্মকাণ্ড নেই। সব মিলিয়ে এ আসনের রাজনীতির দৃশ্যপট পুরোটাই পাল্টে গেছে।
এ আসনে কোনো বারই বিএনপির তৃণমূল কোনো নেতা দলীয় মনোনয়ন পাননি। ভোটের আগে সুযোগ বুঝে অন্য দল থেকে বিএনপিতে যোগদান করে মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন। ভোটে হেরে দল থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন।
Advertisement
এ আসনটির তিনভাগের দুইভাগ চরাঞ্চল। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান অনুন্নত। প্রতি বছর ভাঙনের কবলে পড়ে ভিটা মাটি, ফসলি জমিসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
আরও পড়ুন
রেষারেষি নেই বিএনপি-জামায়াতে, ভোটে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতীক পেয়ে গতি বেড়েছে জামায়াতের, প্রার্থী ঠিক করেনি বিএনপিএ আসন থেকে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুন্নবী টিটুল, জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ফারুক আলম সরকার, সাবেক ছাত্রনেতা কামরুজ্জামান সোহাগ, যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় আইনজীবী ফোরামের সদস্য অ্যাডভোকেট জিল্লুর রহমান, নাহিদুজ্জামান নিশাত, ফুলছড়ি উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাদেকুল ইসলাম নান্নু, সাঘাটা বিএনপির আহ্বায়ক হাজি মোহাম্মাদ আলী, শিল্পপতি মো. নয়ন, জেলা বিএনপির সদস্য মইনুল হাসান শামীমসহ অনেকেই মনোনয়ন চাইতে পারেন। অন্যদিকে এ আসনে জেলা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল ওয়ারেজকে একক প্রার্থী ঘোষণা করে ভোটের মাঠে কাজ করছে জামায়াত।
তৃণমূল বিএনপির নেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, এই এলাকা নদীভাঙনপ্রবণ, চর এলাকা। এর আগের প্রার্থীরা অনেক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কোনো কাজ করেনি। কিন্তু এখন মানুষ অনেক সচেতন। আমি মনে করি উন্নয়নের জন্য সাধারণ মানুষ বিএনপিকেই ভোট দেবে।
Advertisement
আরও পড়ুন
৪২ শতাংশ সনাতন ধর্মাবলম্বী ভোটারই নির্ধারণ করবে জয়-পরাজয় ফখরুলের প্রতিদ্বন্দ্বী জামায়াতের দেলাওয়ার, আছেন স্বতন্ত্ররাওবিগত নির্বাচনগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এ আসনে কোনোবারই বিএনপির তৃণমূল কোনো নেতা দলীয় মনোনয়ন পাননি। ভোটের আগে সুযোগ বুঝে অন্য দল থেকে বিএনপিতে যোগদান করে মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন। ভোটে হেরে দল থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এবার নতুন করে এ আসনে যোগ হয়েছেন নাহিদুজ্জামান নিশাত। বিএনপিসহ জোটের শরিক ২০১৮ সালে স্বৈরাচার হাসিনার ভোট বর্জন করেন। ওই আসনে এমপি ফজলে রাব্বী মারা যাওয়ার পর উপ-নির্বাচন হয়। নাহিদুজ্জামান নিশাত সেই উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে আপেল প্রতীকে অংশ নেন। আগে তাকে বিএনপির রাজনীতি করতে দেখা যায়নি।
জামায়াতের যিনি প্রার্থী হন। তাকে লবিং করতে হয় না। দলই তাকে সিলেক্ট করে। কেউ প্রার্থী হতে চাইলেও পারে না। জামায়াত হুট করে একজনকে মনোনয়ন দেয় না। আশা করছি আমাদের দলের প্রার্থী বিপুল ভোটে এ আসন থেকে জয় লাভ করবেন।
৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে গেলে তিনি বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হন। জেলায় দলের শীর্ষ পদ (সহ-সভাপতি) বাগিয়ে নেন। বর্তমানে তিনি নিজেকে বগুড়ায় বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার দাবি করছেন। অন্যদিকে অধিকাংশ নেতাকর্মী মনোনয়নের জন্য তার পক্ষে কাজ করছেন। আবার অনেকে তার বিরুদ্ধে সমালোচনা করছেন। বর্তমানে তিনি বিএনপির এই আসনের সব খরচ বহন করছেন বলে জানা গেছে।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবি, দীর্ঘদিন থেকে দলের দুঃসময়ে যারা লড়াই সংগ্রাম, মামলা-হামলা, জেল-জুলুম নির্যাতন করে বিএনপিকে টিকিয়ে রেখেছেন, তাদের মধ্য থেকে যেন দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
নবীন-প্রবীণে ভোটের লড়াইয়ের প্রস্তুতি নতুন প্রার্থীদের ব্যাপক প্রচারণাজামায়াত নেতা প্রভাষক হারুন অর রসিদ বলেন, জামায়াতের যিনি প্রার্থী হন তাকে লবিং করতে হয় না। দলই তাকে সিলেক্ট করে। কেউ প্রার্থী হতে চাইলেও পারে না। জামায়াত হুট করে একজনকে মনোনয়ন দেয় না। আশা করছি আমাদের দলের প্রার্থী বিপুল ভোটে এ আসন থেকে জয় লাভ করবেন।
ভোটাররা বলছেন, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বহুবার ভোট নিয়ে বিজয়ী হয়েছে অনেকেই। ভোটের পর কেউ খবর নেয় না। নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন হলেও আমাদের ভাগ্যের উন্নয়নে কোনো কাজ করে না। এরকম প্রার্থীদের আর ভোট দেব না। যে দলের প্রার্থী সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টে পাশে থাকবেন তাকে এবারের নির্বাচনে ভোট দেবেন।
তরুণ ভোটার সানজিদা আকতার বলেন, এবার নির্বাচনে তরুণরা যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দেবে। দলকে প্রাধান্য দেবে না। সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট দেবে। যারা তরুণদের কথা চিন্তা করবে, সাধারণ মানুষের উন্নয়নের কথা চিন্তা করবে। সেই প্রার্থীকে তরুণরা ভোট দেবে বলে মনে করেন তিনি।
তরুণরাই অনেক কিছু পাল্টে দিতে পারে। তার প্রমাণ ৩৬ জুলাই। তাই আগামী দিনে যারাই ক্ষমতায় যাবে তরুণদের সঙ্গে গাদ্দারি করলে তাদের পরিণতিও এমন হবে।
আরেক তরুণ ভোটার ইমরুল হুদা বলেন, তরুণরাই অনেক কিছু পাল্টে দিতে পারে। তার প্রমাণ ৩৬ জুলাই। তাই আগামী দিনে যারাই ক্ষমতায় যাবে তরুণদের সঙ্গে গাদ্দারি করলে তাদের পরিণতিও এমন হবে।
আরও পড়ুন
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সিইসির সাক্ষাৎ দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতের সঙ্গেই লড়াই হবে বিএনপিরপ্রবীণ ভোটার হাসান আলী নিজের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘জীবনে সাত থেকে আটবার এমপি নির্বাচনে ভোট দিছি। ভোটের আগে চাচা, আব্বা কয়া ডাকে। ভোট কোনা নেওয়ার পর খোঁজ তো দূরের কথা এলাকায় ভুলকিও দেয় না। কাক বিশ্বাস করে ভোট দিবো। সগলোই স্বগোত গেলে হনুমান হয়।’
গাইবান্ধা-৫ আসনটি ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত। এ আসন ১৯৮৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকে অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর মধ্য বিএনপি থেকে মাত্র চার মাসের এমপি ছিলেন মতিয়ার রহমান।
২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে নির্বাচিত হন রওশন এরশাদ। ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া নির্বাচিত হন। পরে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে উপ-নির্বাচনে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন নির্বাচিত হন। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে পুনরায় তিনি বিজয়ী হন।
এরপর গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। হাসিনার মতো মাহমুদ হাসান রিপনও তার নেতাকর্মীদের রেখে পালিয়ে যান।
এ আসনে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দুজন তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) ভোটারসহ প্রায় ৩ লাখ ৭৫ হাজার ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।
এএনএইচএস/এসএইচএস/এমএফএ/জেআইএম