কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গা শিবিরে প্রায় ৪ লাখ ৩৭ হাজার স্কুলগামী শিশুর শিক্ষা হুমকির মুখে পড়েছে। আন্তর্জাতিক দাতাদের সহায়তা কমায় চলতি মাসের শুরু থেকে শিবিরে পরিচালিত হাজারো ‘লার্নিং সেন্টার’ বন্ধ করেছে ইউনিসেফ। বুধবার (২৬ জুন) হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়।
Advertisement
এই প্রতিবদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকার রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেয়, যা ছিল মোট আন্তর্জাতিক সহায়তার অর্ধেকেরও বেশি। কিন্তু ২০২৫ সালের জুন নাগাদ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এই সহায়তা কমিয়ে মাত্র ১২ মিলিয়ন ডলারে নামিয়ে আনে।
এমন পরিস্থিতিতে পুরো শিক্ষাখাতে ৭২ মিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন থাকলেও এপ্রিল পর্যন্ত মাত্র ২২ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন নিশ্চিত হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৩ লাখ ৪ হাজার শিক্ষার্থী যে লার্নিং সেন্টারগুলোতে পড়ত সেগুলো বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে শরণার্থী শিবিরগুলোতে একমাত্র চালু থাকা শিক্ষা ব্যবস্থা হচ্ছে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নিজস্ব উদ্যোগে গড়ে ওঠা কমিউনিটি নেতৃত্বাধীন স্কুলগুলো। এই স্কুলগুলো উন্নতমানের পাঠদান নিশ্চিত করলেও বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি না থাকায় কোনো আন্তর্জাতিক দাতাসংস্থা এগুলোতে সহায়তা দিতে পারছে না। ফলে অভিভাবকদের কাছ থেকে মাসিক ফি নেওয়া হয় প্রথম শ্রেণির জন্য প্রায় ৫০ সেন্ট এবং দ্বাদশ শ্রেণির জন্য ৫ ডলার পর্যন্ত; যা অনেক রোহিঙ্গা পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।
Advertisement
একজন অভিভাবক বলেন, অনেক পরিবার চায় শিশুদের কমিউনিটি স্কুলে পড়াতে, কিন্তু সামর্থ্য না থাকায় বাধ্য হয়ে লার্নিং সেন্টারে পাঠায়। কিন্তু সেখানে সন্তানের শিক্ষা খুব দুর্বল হওয়ায় শেষে কাজেই পাঠিয়ে দেয়।
একজন স্কুলপ্রধান জানান, কক্সবাজারে ১০০টিরও বেশি কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন স্কুল আছে। কিন্তু সরকারের স্বীকৃতি না থাকায় কোনো মানবিক সংস্থা আমাদের সহায়তা করছে না।
শিক্ষকরা জানান, স্কুলগুলোতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও সরকারি স্বীকৃতি ও সার্টিফিকেট না থাকায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
একজন শিক্ষক বলেন, যদি কেউ দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্তও পড়ে কিন্তু সার্টিফিকেট না থাকে তাহলে মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে তাকে আবার শুরু থেকে পড়তে হবে।
Advertisement
এইচআরডব্লিউ জানায়, ইউনিসেফ ৬ষ্ঠ শ্রেণি ও তদূর্ধ্ব শ্রেণির শিক্ষাক্রম ২৯ জুন থেকে পুনরায় চালুর পরিকল্পনা করেছে। তবে এনজিওগুলোকে নিম্ন শ্রেণির পাঠদান পুনরায় শুরু করতে বলা হয়েছে, যদি তারা অন্য উৎস থেকে অর্থ জোগাড় করতে পারে।
শিক্ষা সংকটের পাশাপাশি, শিশুদের সুরক্ষা ঝুঁকিও বেড়েছে। অপরাধী চক্র ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব শিবিরগুলোতে বাড়ছে। শিশুদের অপহরণ, মানবপাচার এবং জোরপূর্বক গ্যাংয়ে যুক্ত করার ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে।
২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে ৫১টি শিশু অপহরণের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। ২০২৪ সালের শেষ দিকে অপহরণ এতটাই বেড়ে যায় যে অনেক অভিভাবক সন্তানদের আর স্কুলে পাঠাতে সাহস করেননি।
এইচআরডব্লিউ বলছে, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন স্কুলগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের উচিত এসব স্কুলে অর্থায়নের মাধ্যমে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। সরকারের পাশাপাশি ইউনিসেফ ও অন্যান্য সহায়তা সংস্থাগুলোর উচিত রোহিঙ্গা শিক্ষকদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে অন্তর্ভুক্ত করা এবং নেতৃত্বের সুযোগ দেওয়া।
তুরস্কসহ কিছু দেশ শরণার্থী শিশুদের নিজস্ব পাঠ্যক্রমে পরিচালিত স্কুলকে স্বীকৃতি ও সার্টিফিকেট প্রদান করেছে; বাংলাদেশও চাইলে এই পথ অনুসরণ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী সব শিশুরই জাতীয়তা, বসবাস বা অভিবাসন অবস্থান নির্বিশেষে মানসম্মত শিক্ষার অধিকার রয়েছে। আন্তর্জাতিক শরণার্থী শিক্ষা নীতিমালায় বলা হয়েছে, শরণার্থীদের শিক্ষা পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষণে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের শিশু অধিকার বিষয়ক সহযোগী পরিচালক বিল ভ্যান এসভেলড বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দাতা যখন রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষার দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসছে তখন বাংলাদেশের নতুন সরকারের উচিত সবার শিক্ষা অধিকার নিশ্চিত করা। আন্তর্জাতিক দাতাদের উচিত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের শিক্ষা প্রচেষ্টাকে সহায়তা দিয়ে একটি প্রজন্মকে হারিয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা।
এমআইএইচএস/জিকেএস