একসময় যাদের চোখে ছিল সমাজ ও দেশের জন্য কিছু করার আশাবাদ, তাদের সেই চেতনাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে সর্বনাশা নেশা। বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশ মাদকের দাবানলে জ্বলছে। দেশে প্রায় ৭৫ লাখের বেশি মানুষ মাদকাসক্ত, এর মাঝে প্রায় ৯০ শতাংশ তরুণ-কিশোর। মাদক শুধু একজন তরুণের স্বপ্নকেই ধ্বংস করে না, বরং পুরো জাতিকে করে দুর্বল ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। তাই সময় এসেছে সচেতন হওয়ার এবং মাদকের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ার। একটি মাদকমুক্ত, সুস্থ ও উন্নত বাংলাদেশ গড়তে তরুণ প্রজন্মের ভাবনায় জীবনের প্রকৃত অর্থ ও সামাজিক সচেতনতা তুলে ধরেছেন তানজিনা আক্তার চৈতি-
Advertisement
মাদকমুক্ত প্রজন্ম গঠনে তরুণ্যের প্রতিজ্ঞামুহাম্মদ হেফাজ উদ্দীন, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়বর্তমান সমাজে নেশার উপকরণ ছড়িয়ে পড়েছে বিষাক্ত গ্যাসের মতো, যা তরুণদের ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মাদকাসক্তির ভয়ানক অভিশাপে দেশের তারকা থেকে সাধারণ শিক্ষার্থী নেশাতে আসক্ত হয়ে নষ্ট করেছে ক্যারিয়ার। হতাশা, বেকারত্ব, মানসিক চাপ ও কৌতূহল তরুণদের মাদকের প্রতি আকৃষ্ট করছে। কেউ কেউ সাময়িক কষ্ট ভুলে থাকার আশায় একবার সেবন করেই জড়িয়ে পড়ে ভয়ংকর আসক্তিতে। মাদকসেবীদের আচরণে খাপছাড়া ভাব, ক্ষুধামন্দা ও ওজন কমে যাওয়ার মতো লক্ষণ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এই ভয়াল ছোবল থেকে তরুণদের রক্ষা করতে হলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে একযোগে কাজ করতে হবে। মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে তরুণ সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। প্রতিটি তরুণের উচিত নিজেকে মাদক থেকে দূরে রাখা এবং অন্যদেরও সচেতন করা।
পরিবারের দায়িত্বশীলতাই মাদক প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠিরাশেদুল ইসলাম আকিব, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়মাদকাসক্তি এখন সমাজিক ব্যাধি, যার মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম পারিবারিক কলহ, অবহেলা ও মানসিক অস্থিরতা। একটি শিশুর মানসিক বিকাশ শুরু হয় পরিবার থেকে, যেখানে ভালোবাসা, মনোযোগ ও সহানুভূতি তার জীবনের ভিত্তি গড়ে দেয়। পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা পারে সন্তানকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, ধর্মীয় নৈতিকতা, মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া। প্রয়োজনের বেশি অর্থ না দেওয়া। এতে মাদকের মতো ভয়াবহ বিপথগামীতা থেকে দূরে থাকতে পারবে। মাদকাসক্তদের ক্ষেত্রে প্রয়োজন কাউন্সিলিং, রিহাবে পাঠানো এবং মানসিক সহায়তা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। শুধু আইন নয়, পরিবার থেকেই শুরু হোক মাদক প্রতিরোধের পথ। তাই পরিবারের দায়িত্বশীলতায় লুকিয়ে আছে একটি মাদকমুক্ত, সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যত গড়ার মূল চাবিকাঠি। পরিবার সচেতন হলে তরুণ প্রজন্ম থাকবে মাদকমুক্ত ও আত্মবিশ্বাসী।
মাদক প্রতিরোধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক সমাজের ভূমিকাসাফওয়ানুল হক, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়মাদকবিরোধী সচেতনতা গড়তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। নিয়মিত সেমিনার, র্যালি, দেয়াল পত্রিকা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে মাদকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা যায়। শিক্ষকরা শুধু পাঠদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে নৈতিক শিক্ষা ও জীবনঘনিষ্ঠ দিকনির্দেশনা দিলে শিক্ষার্থীরা সঠিক পথ বেছে নিতে শেখে। বন্ধুসম আচরণের মাধ্যমে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সমস্যা বুঝতে পারেন। যা তাদের নেশা থেকে বিরত রাখতে সহায়তা করে। বিপথগামী শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং, প্রয়োজন হলে চিকিৎসার পরামর্শ এবং অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষক সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একযোগে সচেষ্ট হলে একটি মাদকমুক্ত শিক্ষাঙ্গন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব।
Advertisement
নেশার নীল ছায়া: শিক্ষার্থীদের ভেতরে নীরব বিষওবায়দুল মোস্তফা শিবলী, শিক্ষার্থী,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে পা রাখা একজন শিক্ষার্থীর স্বপ্নগুলো ডানা মেলতে শুরু করে। নতুন জীবনের প্রত্যাশায় ছুটে চলে অবিরাম। বন্ধুর পথ; সজাগ দৃষ্টি! যেন কোথাও হোঁচট খেতে না হয়। অনেক সময় আত্মউন্নয়নের এ প্রচেষ্টায় বাধা হয়ে আসে নেশা। এই নেশা গ্রাস করে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাময় প্রজন্মকে। বিদ্যালয়, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় সবখানেই নীরবে বাড়ছে এই নীল বিষের বিস্তার। মানসিক চাপ, হতাশা, একাডেমিক ব্যর্থতা, কৌতূহলবশত ও বন্ধুদের প্ররোচনায় শিক্ষার্থীরা এই বিষাক্ত নেশায় লিপ্ত হয়। এই নেশার কারণে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য, শারীরিক স্বাস্থ্য, পড়াশোনা এবং সামাজিক জীবন নষ্ট হয়। তাই এই নীল বিষের প্রভাব মোকাবেলায় প্রয়োজন পারিবারিক সহানুভূতি, রাষ্ট্রীয়ভাবে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম। নেশা কেবল একজন শিক্ষার্থীর নয়, পুরো সমাজের জন্যই একটি নীরব ঘাতক। সবার প্রচেষ্টাই পারে বিষবৃক্ষকে উপড়ে ফেলতে।
মাদকে ‘না’ বলুন, জীবনের ‘হ্যাঁ’ গ্রহণ করুনশাহাদাত হোসেন শিবলী, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজমাদক এক অন্ধকার গহ্বর, যা ধীরে ধীরে একজন তরুণকে নিঃশেষ করে দেয় শরীর, মন ও ভবিষ্যৎ সবই এর করাল গ্রাসে বিলীন হয়। অথচ তরুণরাই জাতির ভবিষ্যৎ, উন্নয়ন ও অগ্রগতির প্রধান চালিকা শক্তি। তাই তাদের উচিত ক্ষণিকের মিথ্যা সুখ নয়, বরং আশাবাদী, সৃজনশীল ও কর্মমুখর জীবনের পথ বেছে নেওয়া। হতাশা, ব্যর্থতা কিংবা মানসিক চাপ থেকে মুক্তির জন্য মাদকের পথ নয়, দরকার সহানুভূতি, বন্ধুত্ব, পরামর্শ ও মানসিক যত্ন। শিক্ষা, খেলাধুলা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি চর্চার মাধ্যমে তরুণরা নিজেকে বিকশিত করতে পারে সুন্দর জীবনের পথে। একবার সাহস নিয়ে ‘না’ বললেই শুরু হয় আলোর পথযাত্রা। মাদক নয়, সুস্থ জীবন বেছে নিয়ে একটি গর্বিত, উদ্যমী ও মাদকমুক্ত প্রজন্ম গড়ে তোলাই হওয়া উচিত তরুণ সমাজের প্রতিজ্ঞা।
আরও পড়ুন নির্যাতনের শিকার প্রবীণরা: সমাজের দায়, পরিবারের ভূমিকা শিশুশ্রম কি দারিদ্র্যেরই ফসল?কেএসকে/জিকেএস
Advertisement