দেশজুড়ে

রেলের জমিতে বহুতল ভবন-রেস্তোরাঁ-ব্যাংক, বাদ যায়নি জলাশয়ও

রেলের জমিতে বহুতল ভবন-রেস্তোরাঁ-ব্যাংক, বাদ যায়নি জলাশয়ও

দেশের বৃহত্তর রেলওয়ে কারখানাকে ঘিরে গোড়াপত্তন ঘটে নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরের। এ শহরকে বলা হয় ‌‘রেলের শহর’। এ কারণে জেলায় রেলের জমি বেদখলে থাকার ঘটনা নতুন নয়। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময় সৈয়দপুর রেল অঞ্চলে দখলদারিত্ব রীতিমতো মচ্ছবে পরিণত হয়েছে।

Advertisement

বেহাত হয়েছে শহরে অবস্থিত প্রায় সাড়ে ৪০০ একর জমি। এর কারণ হিসেবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও রেলের কর্মকর্তাদের অজ্ঞাত কারণে নীরবতাকে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা।

দখল হওয়া এসব রেলের জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য বহুতল ভবন। কোনো কোনো স্থানে এসব জমি কৌশলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠাসহ ব্যক্তির নামে দিয়ে হরিলুট হয়েছে। দখলের থাবা থেকে বাদ যায়নি কেপিআই অন্তর্ভুক্ত জমিও। রেলের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেই হয়েছে সব অপকর্ম। আর স্থানীয় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা সম্ভব হয়নি।

সবশেষ ২০২২ সালে রেলের ভূমি ব্যবস্থাপনার কমপ্লায়েন্স নিরীক্ষা প্রতবেদনে সব মিলিয়ে ৪২৭ একর জমি অবৈধ দখলদারদের হাতে চলে যাওয়ার তথ্য উঠে আসে। দখল হওয়া এসব জমির মধ্যে ১৫ দশমিক ২১৮৩ একর সিএস, এসএ, আরএস, বিএস জরিপের সময় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ডভুক্ত এবং নামজারি করা হয়েছে। প্রতিবেদন জমা পড়ার তিন বছর পার হলেও এসব জমি সংশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি রেল কর্তৃপক্ষ। এভাবে জমি দখল হয়ে যাওয়ায় শুধু লাইসেন্স ফি বাবদই বার্ষিক দুই কোটি ৫৪ লাখ টাকার ক্ষতি হচ্ছে রেলের।

Advertisement

আরও পড়ুন: জলের জন্য জীবনের লড়াই রপ্তানিযোগ্য আমের শেষ ‘ভরসা’ সুপারশপ দখলে বেহাল ছাউনি, যাত্রীদের দুর্ভোগ

রেলওয়ে সূত্র বলছে, সৈয়দপুর শহরে ৮০০ একর ভূ-সম্পত্তির মধ্যে ১৮৭০ সালে ১১০ একর জমিতে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা গড়ে ওঠে। অবশিষ্ট জমির মধ্যে আছে রেলের বিভিন্ন স্থাপনা ও কর্মচারীদের জন্য বসতবাড়ি। অব্যবহৃত জমির মধ্যে ৫৫ একর কৃষি, ২১ দশমিক ৩৮ একর জলাশয়, ১ একর বাণিজ্যিক হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছড়া ২৫ দশমিক ৭৫ একর জমি পৌরসভার কাছে আছে। আর স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত রেলের বাদবাকি ৪৩৭ একর জমি বেহাত বা দখল হয়েছে। আর গণঅভ্যুত্থানের পর দখল ও বেহাত হওয়া রেলের জমিতে বহুতল ভবন হয়েছে অর্ধেকেরও বেশি।

‘সরকারি বিধি অনুযায়ী হাট-বাজার এলাকা ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নিয়ন্ত্রণ করবে। এর ৬০ শতাংশ খাজনা তাদের রাজস্বে যাবে। আর ৪০ শতাংশ রেলওয়েকে দিতে হবে। কিন্তু সৈয়দপুর পৌরসভা কর্তৃপক্ষ তিন থেকে চার মাস এ নিয়ম মানলেও পরবর্তী সময়ে তারা আর রেলওয়েকে কোনো খাজনা দেয়নি।’

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা যায়, শহরের স্থানীয় ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন রেলওয়ে কোয়ার্টার ও জমি দখল করে ১২টি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত উপজেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক জয়নাল আবেদিন রেলওয়ে খাদ্য গোডাউন ভেঙে চারতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। সৈয়দপুর রেলওয়ে পুলিশ অফিসের পাশে বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ নির্মাণ করেছেন প্রভাবশালী দখলদার রাজু। তিনি সম্প্রতি মারা গেছেন।

রেলের জায়গায় অবৈধভাবে লায়ন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন সৈয়দপুর উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি লায়ন নজরুল ইসলাম। তিনিও মারা গেছেন।

Advertisement

ডালমিল সিনেমা রোডে রেলের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন বাবু আলী নামের একজন। ইটভাটা ব্যবসায়ী আতিকুল ইসলাম রেলের জলাশয় (ওয়াটার রিজার্ভার) দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জমি অবৈধভাবে দখল করে দখলদাররা ঢাকা ব্যাংক, আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, পুবালী ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংকসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।

‘বাংলাদেশ রেলওয়ে এমপ্লয়িজ কো-অপারেটিভ মার্কেট’ নামে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে অর্ধশতাধিক দোকান। রেলওয়ে জেলা পুলিশ ক্লাবের পাশে রেলের জমি দখলে নিয়ে একতা প্রেস ভবনসহ বসতবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ১৪০০ বাড়ি বা স্থাপনা থেকে ভাড়া তুলছেন রেলওয়ে কর্মচারী ও ভূমিদস্যুরা। এসব স্থাপনায় অবৈধভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রেলের জায়গায় রয়েছে দলীয় অফিস ছয়টি, আবাসিক হোটেল ৩৬টি, পাঁচ হাজার অবৈধ দোকান, ১৬টি ব্যাংকসহ ৪৩টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এতে রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

আরও পড়ুন: খাঁচায় মাছ চাষে ফিরেছে সুদিন বড় গরুতে লাভের আশায় গুড়েবালি

রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী শরিফুল ইসলামের ভাষ্য, ১৯৮৫ সালে সৈয়দপুর রেলওয়ে ২৫ দশমিক ৭৫ একর জমি পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করে। চুক্তি অনুযায়ী, জমির মালিকানা রেলের কাছেই থাকার কথা ছিল। কিন্তু পৌরসভাকে দেওয়া ওই ২৫ দশমিক ৭৫ একরের ওপর ভিত্তি করেই রেলওয়ের জমি দিন দিন বেদখল হচ্ছে।

তিনি আরও জানান, সরকারি বিধি অনুযায়ী হাট-বাজার এলাকা ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নিয়ন্ত্রণ করবে। এর ৬০ শতাংশ খাজনা তাদের রাজস্বে যাবে। আর ৪০ শতাংশ রেলওয়েকে দিতে হবে। কিন্তু সৈয়দপুর পৌরসভা কর্তৃপক্ষ তিন থেকে চার মাস এ নিয়ম মানলেও পরবর্তী সময়ে তারা আর রেলওয়েকে কোনো খাজনা দেয়নি।

‘জলাশয়টি আবর্জনা দিয়ে ভরাট হয়ে গিয়েছিল। সেখানে রাতের বেলায় মাদকসেবীদের আড্ডা বসতো। এলাকার পরিববেশ নষ্ট হচ্ছিল। তাই পৌরসভার কাছে বরাদ্দ নিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছি। এজন্য প্রতিবছর পৌরসভাকে হোল্ডিং ট্যাক্স ও খাজনা দিয়ে আসছি।’

‌‌‘শুধু তাই নয়, তাদের নিয়ন্ত্রণ এরিয়ার জমির ম্যাপ রেলের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের কাছে নেয়নি। একাধিকবার ভূ-সম্পত্তি বিভাগ এরিয়া নির্ধারণ করতে পৌরসভাবে চিঠি দিলেও তারা কর্ণপাত করেননি। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এ সুযোগে পৌরসভা ইচ্ছামতো জমির দখল নিয়ে খাজনা তুলছে। বর্তমানে মামলাটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন’, যোগ করেন রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী শরিফুল ইসলাম।

রেলওয়ে জলাশয় ভরাট করে বহুতল ভবন নির্মাণ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ী আতিকুলের ভাষ্য, জলাশয়টি আবর্জনা দিয়ে ভরাট হয়ে গিয়েছিল। সেখানে রাতের বেলায় মাদকসেবীদের আড্ডা বসতো। এলাকার পরিববেশ নষ্ট হচ্ছিল। তাই পৌরসভার কাছে বরাদ্দ নিয়ে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছি। এজন্য প্রতিবছর পৌরসভাকে হোল্ডিং ট্যাক্স ও খাজনা দিয়ে আসছি।

আরেক দখলদার আলতাফ হোসেন বলেন, তার প্রতিটি স্থাপনা রেলের হলেও সেগুলো রেল পৌরসভাকে দিয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে তিনি বরাদ্দ নিয়েছেন। এর বেশি মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

একই মন্তব্য করেন ঠিকাদার জয়নাল আবেদীন, ব্যবসায়ী সিদ্ধিকুল আলম ও বাবু আলী।

রেলওয়ে পুলিশ সুপারের পাশে জমি দখল নিয়ে প্রেস ব্যবসা করেন দুখু মিয়া ও তার ভাই মোহাম্মদ রিপন। তারা জাগো নিউজকে বলেন, রেলের কাছে তারা বরাদ্দ নিয়েছেন।

একইভাবে আরও কয়েকজন দখলদারদের সঙ্গে কথা হলে তাদের কেউ পৌরসভা আবার কেউ কেউ রেলের কাছে বরাদ্দ নেওয়ার কথা জানান। কিন্তু এদের কেউই বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেননি।

এসব বিষয়ে সৈয়দপুর পৌর প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) নুর-ই-আলম সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, প্রথমত-সরকারি জমি ব্যক্তির নামে নামজারি হওয়ার সুযোগ নেই। যদি এ রকম হয়ে থাকে, অভিযোগ পেলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে পৌরসভার বিষয়টি তিনি ভালোভাবে অবগত নন বলে জানান।

এ বিষয়ে পাকশী বিভাগীয় রেলওয়ে ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা আরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘এসব জমি একদিনে দখল হয়নি। যুগ যুগ ধরে অবৈধ দখলদাররা ধীরে ধীরে এসব দখল করেছেন। এসব অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। উচ্ছেদের পর তারা আবারও স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। তবে আমাদের লোকবল সংকটের কারণে সবসময় উচ্ছেদ অভিযান চালানো সম্ভব হয় না।’

তিনি বলেন, ‘জুন মাসের পর যে কোনো সময় অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। অবৈধ দখলদাররা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে রাজশাহীর প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. নাদিম সরোয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করে খুব শিগগির এদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে। কেউ যদি রেলের জমিতে অবৈধভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করে বসবাস ও ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এসআর/এএসএম