আব্দুল্লাহ আল সিফাত ও শাহ বিলিয়া জুলফিকার
Advertisement
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু কলকাতায় আর হাইস্কুল শেষ করেন ফেনীর আরিমাবাদ থেকে। সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন অতি অল্প বয়সে। কলকাতার একটি পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ছাত্রজীবনেই। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে তিনি কারাবরণ করেন। যা তার দেশপ্রেমের আরেক অনন্য দৃষ্টান্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। সাহিত্য থেকে চলচ্চিত্র প্রতিটি মাধ্যমেই তিনি ছিলেন সক্রিয় ও মেধাবী। ১৯৫৬ সালে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৬১ সালে মুক্তি পায় তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’।
ছাত্রজীবনেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সূর্যগ্রহণ’। এরপর একে একে ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘বরফ গলা নদী’ এবং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি। যার জন্য তিনি ১৯৬৪ সালে আদমজী পুরস্কার লাভ করেন। তাঁর পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেওয়া’ (১৯৭০) একটি কালজয়ী চলচ্চিত্র হিসেবে সমাদৃত। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী অস্থির বাংলাদেশে নিখোঁজ হন জহির রায়হান। তাঁর ভাই, শহীদ সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে। সেই সময়ই তাঁকে মরণোত্তর সম্মানিত করা হয় বাংলা একাডেমি পুরস্কারে।
জহির রায়হানের ‘কয়েকটি মৃত্যু’ উপন্যাসটি একটি স্বপ্নকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। আহমদ আলীর বয়স ষাটের কাছাকাছি। যে বাড়িতে থাকেন, তা দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর নিজেদের সবকিছু বিক্রি করে এক বিত্তবান হিন্দু পরিবার থেকে তা নেওয়া। চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে উকিল মনসুর, মেজো ছেলে ইঞ্জিনিয়ার আহসান, সেজো ছেলে পাটের কারবারি মকবুল আর ছোট ছেলে শামছু।
Advertisement
শামছু সারাবছর পেটের ব্যথায় অসুস্থ থাকে। আহমদ আলী সারাজীবন অনেক কষ্ট করছে। ভালো পরিবার দেখে ছেলেদের বিয়ে দিয়ে এখন শুকরিয়া আদায় করেন আল্লাহর কাছে। গল্পটির মোর ঘোরে একটি স্বপ্নকে কেন্দ্র করে। আহমদ আলী একদিন স্বপ্ন দেখেন যে, চারটি সাদা কাপড়ে ঢাকা মূর্তি এসে খাটের চারপাশে দাঁড়ায়। আহমদ আলী একই স্বপ্ন আরও একুশ বছর আগে দেখেছিলেন। সেবার স্বপ্ন দেখার পরদিন তার আব্বা আর সেজো ভাই হঠাৎ মারা যান। আবার সেই স্বপ্ন যখন একুশ বছর পর দেখেন; তখন তিনি সবাইকে বলেন আবার কোনো অঘটন ঘটতে চলেছে। তখন তার ছেলে-মেয়ে সবাই ভয়ের মধ্যে জীবন যাপন করতে থাকে।
আমরা প্রতিদিনের জীবনে হাজারও কাজের ভিড়ে মৃত্যুর বাস্তবতাকে ভুলে যাই কিংবা ভুলে থাকতেই চেষ্টা করি। কিন্তু কখনো এই চিরসত্য পরিণতিকে এড়ানো সম্ভব হয় না। এই সত্য যখন মানুষের খুব কাছে এসে দাঁড়ায়; তখন নিজের জীবন বাঁচানোর জন্য এই মানুষ কতটা ছটফট করে ওঠে, স্বার্থপর হয়ে ওঠে। সে চিত্রই লেখক জহির রায়হান অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন এ উপন্যাসে। একজন চাষি যেমন করে তার ফসলভরা ক্ষেতের দিকে চেয়ে পরিতৃপ্তির সুখ পায়; ঠিক তেমনই ভরা ফসলের ক্ষেতে পোকা-পড়ার পর অসহায় আতঙ্ক নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। জীবনের সুখ-আহ্লাদের মাঝে হঠাৎ মৃত্যু আমাদের কাছে কৃষকের ভরা ফসলে পোকামাকড়ের মতোই। উপন্যাসে সেই স্বপ্ন প্রকাশের পর পরই সবার মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে যায়।
ছেলেদের প্রত্যেকের বউ তাদের সম্পদের ভাগাভাগির কথা বলে, কে কীভাবে লাভবান হতে পারে, কার কেমন ভাগ হওয়া উচিত—এসব নিয়ে ভাবে। স্বামীর মৃত্যু হলে তারা কীভাবে চলবে; সেসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। বড় ছেলে মনসুর সেই স্বপ্নের কথা ভেবে, নিজের করা গুনাহের কাজগুলো ভেবে নামাজ পড়া শুরু করে। মনসুর দেখলো সারাজীবনে যা করেছে; সবই ইহকালের জন্য। পরকালের জন্য সঞ্চিত নেই কিছুই। ওকালতিতে মক্কেলকে বাঁচাতে অনেক মিথ্যা কৌশল ব্যবহার করতে হয়। এতেও আছে কেবল পাপ। সে ভীতু হয়ে পড়ে, চিন্তা করে। মেজো ছেলে আহসান বই পড়ছিল। বউ জিজ্ঞেস করে আমাদের জন্য করা ইন্স্যুরেন্সের খবর কী? আহসান মৃদু হেসে ওঠে মনে মনে। ভেবে বলে, আমি মারা গেলে তুমি অনেকগুলো টাকা পাবে। সেজো ছেলে মকবুল পাটের ব্যবসার হিসাব গণনা করতে থাকে সিগারেট টানতে টানতে।
একটি সিগারেট শেষ না হতেই আরেকটি সিগারেট ধরায় মকবুল। বউ শুধায়, অত সিগারেট খাচ্ছো কেন? সামনে সরে এসে আস্তে করে বলে, যদি কোনো অঘটন ঘটে তাই জানিয়ে রাখছি। তোমার নামে কিছু টাকা আমি আলাদা করে ব্যাংকে জমা রেখেছি। কিছু শেয়ারও কেনা আছে। ওই ড্রয়ারের মধ্যে কাগজপত্রগুলো রাখা। কাউকে কিছু জানিয়ো না কিন্তু এসব। বউ ঘাড় নেড়ে সায় দিলো, জানাবো না। ছোট ছেলে শামছু ধরেই নিয়েছে যে, সে হয়তো পেটের ব্যথায়ই মারা যাবে।
Advertisement
অবশেষে দেখা যায়, তাদের বাড়ির চাকর আবদুলের স্ত্রী গর্ভবতী ছিলেন; তখন তার অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। সবাই ধরে নিয়েছে যে, তার স্ত্রী মারা যাবে তাদের সমস্যা দূর হবে। কিন্তু প্রচণ্ড ব্যথা সহ্য করার পর তার স্ত্রী জমজ সন্তান জন্ম দেয়। সুতরাং স্বপ্নে দেখার পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনা ভুল হয়। তাই সুখের সময়ে আত্মহারা না হয়ে শুকরিয়া আদায় করার পাশাপাশি দুঃসময়ে ধৈর্যধারণ করতে হবে, সময় থাকতেই মৃত্যু নিয়ে ভাবতে হবে। তবেই উপন্যাসের চাকর আবদুলের মতো অনাকাঙ্ক্ষিত সুখ যমজ সন্তানের পিতা হওয়ার সৌভাগ্য হবে।
এ উপন্যাসে ধর্ম, মৃত্যু এবং সামাজিক কাঠামোর টানাপোড়েন একসাথে গাঁথা হয়েছে এক সূক্ষ বুননে। গল্পের আবহে একটি যৌথ পরিবারের চিত্র উঠে আসে। যেখানে ধর্মীয় মূল্যবোধের টান ও পারিবারিক বন্ধনের শক্তি একত্রে বিদ্যমান। পরিবারটি মূলত আহমদ আলী ও তার স্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত। তাঁরাই শাসক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে আর ছেলেরা ও তাদের স্ত্রীরা যেন ধীরে ধীরে একেকজন শোষিতের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
উপন্যাসে আহমদ আলীর তিন ছেলে মনসুর, আহসান ও মকবুল আসলে বাংলাদেশের সমকালীন রাষ্ট্রব্যবস্থার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রতীক বা রূপক। মনসুর বড় ছেলে, একজন উকিল। সে আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি। তার পেশাগত জীবনের ভেতর লুকিয়ে আছে সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব, যাকে মোকাবিলা করতে গিয়েই সে বুঝতে পারে, কতটা অনৈতিক পথ সে পাড়ি দিয়েছে। তার নামাজে ফিরে আসা, আত্মজিজ্ঞাসায় ডুবে যাওয়া, আসলে সেই সময়কার বিচারব্যবস্থার ভেতরে আত্মশুদ্ধির তাগিদ ও নৈতিক দ্বিধার রূপক।
মেজো ছেলে আহসান, একজন ইঞ্জিনিয়ার। সে জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথে হাঁটে, বই পড়ে, ইন্স্যুরেন্সের হিসাব রাখে। এতে ফুটে ওঠে আমাদের দেশের প্রযুক্তি ও আধুনিক অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিক। অথচ এই খাতেও রয়েছে একরকম নিরাপত্তাহীনতা, যেখানে মানুষ প্রথাগত সাফল্যের আড়ালে মৃত্যুভীতি এবং পারিবারিক নিরাপত্তার কথা ভাবে। আহসান সেই দ্বৈত মানসিকতার প্রতিনিধি।
সেজো ছেলে মকবুল, পাট ব্যবসায়ী। পাট বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী কৃষিপণ্য। মকবুল যেন বাংলাদেশের কৃষি ও ব্যবসা খাতের রূপক। সিগারেট টানতে টানতে নিজের হিসাব গুছিয়ে রাখা, স্ত্রীর কাছে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কাগজ রেখে যাওয়া—এসব তার একধরনের অনিশ্চয়তা ও অনাস্থার পরিচায়ক, যা আমাদের অর্থনীতিতেও প্রতিফলিত। তিনটি পেশার মানুষই মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে কেউ আত্মশুদ্ধির পথে, কেউ আর্থিক নিরাপত্তার আশায়, কেউ ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় ভীত। ফলে উপন্যাসে তারা শুধু ব্যক্তি নয় বরং রাষ্ট্র ও সমাজের বৃহৎ চিত্রকেই প্রতিনিধিত্ব করে।
আহমদ আলীর মনে জেগে ওঠা ভয় ২১ বছর আগের স্মৃতি থেকে জন্ম নেয়। যখন একই ধরনের স্বপ্নের পর তার বাবা মারা গিয়েছিলেন। সেই ভয়ই ছড়িয়ে পড়ে পুরো পরিবারে। এ যেন এক সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিচ্ছবি। যেখানে মৃত্যুভীতি মানুষকে আত্মবিশ্লেষণের দিকে ঠেলে দেয়। এ উপন্যাসে জহির রায়হান বুঝিয়ে দেন, মৃত মানুষ জীবিতদের শাসন করে; আর জীবিতেরা যেন মৃত্যুর ভয়ে নিজের শেকড়কে হারিয়ে ফেলে। সেই শেকড়হীনতার ভেতরেই জন্ম নেয় আধুনিক দ্বন্দ্ব বিজ্ঞান বনাম ধর্ম, বিশ্বাস বনাম যুক্তি। রাসুল ও পেঁচির মধ্যকার সংলাপে পরবর্তী প্রজন্মের এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত স্পষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাস আর যুক্তিভিত্তিক জগতের দ্বন্দ্বে তারা বিভ্রান্ত হবে।
সবশেষে গল্পটি মোড় নেয় এক অভাবিত সুখ ঘটনার দিকে। চাকর আবদুলের স্ত্রী, যাকে সবাই মনে করেছিল মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে। অথচ জন্ম দেয় যমজ সন্তান। এখানে আবদুল ও তার সন্তানের আগমন যেন শোষিত শ্রেণির প্রতীকী মুক্তি। যমজ সন্তান জন্মের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ দুটি রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আবির্ভাবেরও এক ভবিষ্যদ্বাণী প্রতিভাত হতে পারে। যখন আবদুলের হাসির কারণ জানতে পেরে আহমদ আলী রেগে যায়, সেখানে যেন ধরা পড়ে পুরোনো ক্ষমতাকাঠামোর অসহায় ক্রোধ। কারণ শোষক শ্রেণির পতনে শোষিতের মুখেই হাসি ফোটে। এই চিরন্তন সত্যই লেখক গভীর সার্থকতায় উপস্থাপন করেছেন।
এসইউ/জিকেএস