জাতীয়

‘নির্যাতন সহ্য করতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল আর বাঁচবো না’

‘নির্যাতন সহ্য করতে পারছিলাম না, মনে হচ্ছিল আর বাঁচবো না’

গুমের শিকার ব্যক্তিরা চরম মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের নির‌্যাতনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পরিচয়, পারিবারিক ইতিহাস ও ধর্মীয় অনুশীলন নিয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়েছে।

Advertisement

গুম কমিশনের প্রতিবেদনে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গত বুধবার (৪ জুন) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে দ্বিতীয় পর‌্যায়ের প্রতিবেদন জমা দেয় গুম কমিশন। আজ শুক্রবার (৬ জুন) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং প্রতিবেদনের কিছু অংশ প্রকাশ করে।

প্রতিবেদনে গুমের শিকার একজন ভুক্তভোগীর বন্দি অবস্থায় থাকা দিনগুলোর তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হয়।

গুম কমিশনের সদস্যদের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছিল। তারপর আমার দুই হাত ও দুই পায়ের আঙুলের মাঝখানে বাঁশ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এরপর হাত-পায়ের ওপর চারজন উঠে দাঁড়ায়। এরপর আমার মুখে কাপড় চেপে ধরে ওপরের দিক থেকে পানি ঢালা শুরু করে। পরে জানতে পারি, এটাকে বলে ‘ওয়াটার বোর্ডিং’। আমি আগে কিছু বই-পত্রে এ বিষয়ে পড়েছিলাম।’

Advertisement

তিনি বলেন, ‘এই নির‌্যাতন আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তখন আমার মনে হচ্ছিল, আমি আর বাঁচবো না। হয়তো এখনই আমার হার্ট অ্যাটাক হবে। সম্ভবত ওরা এটাও পরীক্ষা করছিল, আমি হার্টফেল করে মারা যাই কি না। ওরা প্রায় দুই-আড়াই বা তিন মিনিট ধরে এটা চালায়। আর মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করছিল: ‘তুই জামায়াতের? শিবিরের? তুই কী করিস?’

তিনি বলেন, ‘আমি বারবার বলছিলাম দেখুন- আমি একসময় ছাত্রশিবির করতাম, এখন আর করি না। ২০১৪ সালের পর থেকে আমি রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছি। আমার বাবা মারা গেছেন, ভাইও মারা গেছে। এরপর থেকে আমি শুধু পড়ালেখা করে একটা চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করছি।’

আরও পড়ুন

গুম থেকে ৫ মাস ১১ দিন পর বাড়ি ফেরা একজনের জবানবন্দি র‌্যাব সরাসরি গুম, নির‌্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল দীর্ঘস্থায়ী ভয়ভীতি-হুমকির মুখোমুখি হয়েছেন গুম কমিশনের সদস্যরা

‘তারা বলছিল- ‘তুই কেন ফজরের নামাজ জামাতে পড়িস? তোর মেয়েদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই কেন?’, এই ধরনের প্রশ্ন করে যাচ্ছিল। ওয়াটার বোর্ডিংয়ের মাঝখানেও জিজ্ঞাসাবাদ চলছিল। তারা থেমে থেমে আমার মুখে পানি ঢালছিল। আমার মনে হয় দুই মিনিট পরই আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। অজ্ঞান হওয়ার আগে শুধু শুনতে পেয়েছিলাম কেউ একটা গালি দিয়ে বলছে- ‘রাজাকারের বাচ্চা!’

Advertisement

‘এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। আমি পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে যাই। তারা জিজ্ঞাসাবাদের সময় বলছিল- ‘তোর মুখে বড় দাড়ি কেন? তোর ভাই জামায়াত করতো কেন?’ এসব প্রশ্নের মাঝে মাঝেই তারা খুব বাজে ভাষায় গালি দিচ্ছিল। আমি কাঁদছিলাম, বলছিলাম- স্যার, আমি মিথ্যা কিছু বলছি না। আপনি যদি আমার কথা বিশ্বাস না করেন, তাহলে আমার এলাকায় গিয়ে খোঁজ নিন। আমি একসময় শিবির করতাম, কিন্তু এখন করি না। আমার ভাই জামায়াত করতো, সে মারা গেছে। আমাদের পরিবারে আর কেউ জামায়াত-শিবিরে জড়িত না।’

‘তারা বললো- ‘তোর বাবা জামায়াত করতো।’ আমি বললাম ‘না, বাবা কখনো জামায়াত করেননি। উনি একজন ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন, নামাজ-রোজা করতেন। কিন্তু জামায়াত করতেন না। আমি শিবির করতাম, ভাইও করতো—এটুকুই সত্য।’

ভুক্তভোগী ওই ব্যক্তি আরও বলেন, ‘তারা দুটি বিষয় খুব গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছিল- আমরা কয়েকজন মিলে রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে গিয়েছিলাম, একটি টিম করেছিলাম। তারা জিজ্ঞাসা করছিল ‘তোমরা কেন রোহিঙ্গাদের সাহায্য করতে গিয়েছিলে? তারা কী চায়? রোহিঙ্গাদের কি তোমরা এই দেশে রাখতে চাও?’ তারা বলছিল- ‘তোমার কি ভারত ভালো লাগে? বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কাদের বেশি পছন্দ? তুমি কি স্বাধীন বাংলাদেশকে ভালোবাসো?’

এমইউ/বিএ/এমএস