ড. আতিয়া আদলান
Advertisement
অনুবাদ: মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান
কতই না প্রয়োজন আমাদের জাতির, হজের আচার-অনুষ্ঠান থেকে শিক্ষা গ্রহণের! এই পবিত্র অনুশীলনগুলো না থাকলে মুসলিম উম্মাহ হয়তো এতদিনে ইতিহাসের অতলে হারিয়ে যেত। এগুলো শুধুই আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং জীবনের গভীর তাৎপর্য বহনকারী পথনির্দেশ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের অনেকে হজ ও ঈদের তাৎপর্যে সামান্য আবেগে আপ্লুত হন, কিন্তু চিন্তার গভীরে প্রবেশ না করেই তা পাশ কাটিয়ে যান। ফলে এই আবেগ নতুন জীবনগঠনের শক্তি হয়ে উঠতে পারে না, যতক্ষণ না আমরা তার অন্তর্নিহিত দিকগুলিকে অনুধাবন করি।
এই আচারগুলোর প্রধান শিক্ষা—উম্মাহর ঐক্য এবং পারস্পরিক সংহতি—কেবল তখনই বাস্তব রূপ নিতে পারে, যখন আমরা তার ভেতরকার ইঙ্গিত ও প্রতীকসমূহ গভীরভাবে উপলব্ধি করব। প্রশ্ন হচ্ছে: আমরা কি এসব প্রতীকের মধ্য দিয়ে ঐক্যের স্বপ্ন দেখতে পারি? এবং বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে নয়, বরং তাকে সম্মান করেই সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারি?
Advertisement
আমাদের ঘাটতি একটাই—ঐক্য
আমাদের মুসলিম উম্মাহর রয়েছে বিস্তীর্ণ ভৌগোলিক ব্যাপ্তি, অতুল সম্পদ, পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানির উৎস, বন্দর, উপকূল আর সাগরপথের দখল। রয়েছে তারুণ্যের অফুরন্ত শক্তি, আছে জ্ঞানী, ধনবান, অভিজ্ঞ মানুষদের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার—যদি এই সবকিছুকে সঠিকভাবে সংগঠিত করা যায়, তাহলে মুসলিম উম্মাহ নিজস্ব ধারায় একটি আলাদা সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে। ইসলাম আমাদের সেই পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে মুক্তির পথ ও মানবজাতির প্রকৃত কল্যাণ।
তবে, এই মহান সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমাদের যা ঘাটতি—তা শুধু একটি, আর তা হলো: অন্তত ন্যূনতম পর্যায়ের ঐক্য।
এক ঝলকে হজ ও ঈদের মাহাত্ম্য
Advertisement
আসুন, এই দৃশ্যপটকে এক পা পেছনে গিয়ে বিস্তৃত পরিসরে দেখি। হজের সময় পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্ত থেকে মুসলমানরা একই লক্ষ্যে একত্রিত হন, আর ঈদের সময় তারা ছড়িয়ে পড়েন খোলা মাঠে, নিজেদের মাঝে ঐক্য প্রকাশ করে আনন্দ ভাগ করে নিতে।
দেখুন কীভাবে কাবার চারপাশে পবিত্র তাওয়াফে অংশ নিচ্ছেন বাদশাহ থেকে দিনমজুর, ধনী থেকে গরিব, শ্বেতাঙ্গ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ—সবাই একই পোশাকে, একই কায়দায়।
তাওয়াফের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য
তাওয়াফ প্রতীকীভাবে কী ইঙ্গিত করে? এটা বুঝতে হলে আমাদের তাকাতে হবে সৃষ্টিজগতের দিকে। পরমাণু থেকে মহাবিশ্ব—সবারই রয়েছে একই ঘূর্ণনপথ, একই কেন্দ্রগামী টান। তাওয়াফ আমাদের শেখায়, ঐক্য তখনই আসে যখন একটি জাতি এক কেন্দ্রের দিকে ঝুঁকে চলে, একটি অভিন্ন পথ ও উদ্দেশ্যকে অনুসরণ করে।
তাই আমাদের প্রয়োজন একক লক্ষ্য, একক নীতিমালা এবং আল্লাহর দীনকে কেন্দ্র করে চলা—এই ধারাবাহিকতা থাকলে বাহ্যিক ভিন্নতাও ঐক্যবদ্ধ চেতনায় গাঁথা হয়ে যায়।
ঐক্যের ন্যূনতম মাপকাঠি
যদি একটি জাতি বা গোষ্ঠী অন্তত এই দুইটি বিষয়ের ওপর ঐক্য বজায় রাখতে পারে—একটি অভিন্ন লক্ষ্য এবং একটি অভিন্ন উৎস থেকে পরিচালনা—তাহলেই ঐক্য সম্ভব। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যদি কোরআনকে তাদের অভিন্ন সূত্র হিসেবে নেয় এবং আল্লাহর শরিয়াহ অনুযায়ী নিজেদের শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে, তাহলে অন্তত একটি ন্যূনতম ঐক্য অর্জন সম্ভব—রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তাগত মৈত্রী জোটের মাধ্যমে।
একইভাবে ব্যক্তি ও মতবাদের ক্ষেত্রেও—ভিন্নতা মেনে নিয়েই একটি সাধারণ নৈতিক সনদের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে, যেটা হবে আমাদের ঐক্যের ভিত্তি।
আর সমাজজীবনে ঐক্যের জন্য যেসব বিষাক্ততা দূর করতে হবে, তা কুরআন খুবই স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, হে ঈমানদারগণ! কেউ যেন অন্য কাউকে উপহাস না করে। তোমরা একে অপরের সম্পর্কে কু-ধারণা করো না, গুপ্তচরবৃত্তি করো না এবং কেউ যেন কারো গীবত না করে। (সুরা হুজুরাত: ১১, ১২)
ঈদ; নবজাগরণের সুবাতাস
ঈদের আগমন আমাদের হৃদয়ে এক নবজীবনের আবাহন নিয়ে আসে। এটি কেবল উৎসব নয়, বরং একটি আহ্বান—নতুনভাবে জেগে ওঠার, নবনির্মাণের।
আমাদের হাতে আছে এক মহাগ্রন্থ, যেটিকে কোরআন ‘রূহ’ এবং ‘নূর’ বলে আখ্যায়িত করেছে—এভাবেই আমি তোমার প্রতি ওহি করলাম আমাদের আদেশের রূহ আমরা একে নূর বানালাম যার মাধ্যমে আমাদের বান্দাদের মধ্যে যাকে চাই পথ দেখাই। (সুরা আশ-শুরা: ৫২)
এই রূহ আমাদের প্রাণের শক্তি, এই নূর আমাদের পথের আলো। আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের হজ ও ঈদ—সবই আমাদের ডেকে বলছে, এক হও, নতুন করে গড়ে ওঠো, ফিরে চলো আল্লাহর পথে।
লেখক: মিশরীয় আলেম, ইসলামি আইনশাস্ত্রের অধ্যাপক
ওএফএফ/এএসএম