কামরুজ্জামান কামাল
Advertisement
উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ। গত তিন দশকে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ বার্ষিক গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে বিশ্বে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির একটি দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে আমাদের দেশ। ১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের। ২০২৪ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলারে। এই অভূতপূর্ব অগ্রগতি আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকগুলোর উন্নয়ন, জীবনমানের উৎকর্ষ এবং মাথাপিছু আয়ে (২০২২ সালে ২,৬৮৭ ও ২০২৩ সালে ২,৫২৯ মার্কিন ডলার) উল্লেখযোগ্য উন্নতি এনে দিয়েছে।
আমাদের রপ্তানি আয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০২৩ সালে মোট রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৫৭ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। যার সিংহভাগ আসে তৈরি পোশাকখাত থেকে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। জাতিসংঘের সব সূচক পূরণ করে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পথে বাংলাদেশ। এই অগ্রগতি সমৃদ্ধি ও সুযোগের এক নতুন যুগের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
তবে এই আর্থিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে চাহিদাও বেড়েছে। বিশেষ করে প্লাস্টিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে। কম খরচ, দীর্ঘস্থায়ী ও সহজলভ্যতার কারণে আধুনিক জীবনে প্লাস্টিক একটি অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে। তবে প্লাস্টিকের বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হচ্ছে।
Advertisement
চলতি বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবস (প্রতিপাদ্য ‘প্লাস্টিকদূষণ বন্ধ করো) পৃথিবীর প্রতি আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ববোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। একটি সুসংগঠিত প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব দৃশ্যমান আবর্জনার বাইরেও বিস্তৃত। প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা কেবল একটি বিচ্ছিন্ন পরিবেশগত উদ্বেগের কারণ তা নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সংকট, প্রকৃতি, ভূমি এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির সংকটকেও আরও বাড়িয়ে তোলে। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য মোকাবিলা কেবল পরিবেশগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রচেষ্টা নয়, বরং বৃহত্তর জলবায়ু সম্পর্কিত কার্যক্রম এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ।
প্লাস্টিক দূষণের বৈশ্বিক সংকট বাংলাদেশে বিশেষভাবে স্পষ্ট। এই দূষণ সরাসরি আমাদের শহরজীবনে প্রভাব ফেলছে। কারণ এর ফলে নর্দমা ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়, গুরুত্বপূর্ণ জলাধারগুলো দূষিত হচ্ছে এবং বর্ষাকালে নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা আরও তীব্র হয়ে উঠছে।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৫ বছরে শহরাঞ্চলে মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার তিনগুণ বেড়েছে, যা ২০০২ সালে ছিল ৩ কেজি, ২০২০ সালে এসে দাঁড়ায় ৯ কেজিতে। শুধু ঢাকায় ২০২০ সালে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ২২ দশমিক ২৫ কেজি, যা ২০০৫ সালের তুলনায় তিনগুণেরও বেশি।
তবে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ বাড়লেও কমেছে রিসাইক্লিং। ২০০৬ সালে যেখানে ৫১ শতাংশ প্লাস্টিক রিসাইক্লিং হতো, সেখানে ২০২০ সালে তা নেমে আসে ৩৭ শতাংশে। যদিও এটি বৈশ্বিক গড় ৯ শতাংশের চেয়ে অনেক ভালো। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের চাহিদা ও কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। দেশে প্রতি বছর আনুমানিক ৮৭ হাজার টন একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়।
Advertisement
রিসাইক্লিংয়ের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো ‘ফিডস্টকের গুণমান’ (রিসাইক্লিংয়ের জন্য পরিষ্কার প্লাস্টিক)। ঘরোয়া পর্যায়ে বর্জ্য পৃথক না করার কারণে অধিকাংশ প্লাস্টিক ভেজা আবর্জনার সঙ্গে মিশে যায়। ফলে সেগুলো রিসাইক্লিংয়ের আগে বহুবার ধোয়া লাগে। এতে পানি ও জ্বালানির অপচয় হয়, যা অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা যেত। শুধু নাগরিকদের এই একটিমাত্র আচরণগত পরিবর্তন সমগ্র বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে বদলে দিতে পারে।
এক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্জ্য সংগ্রহকারীদের প্রশিক্ষণ, দীর্ঘমেয়াদি জনসচেতনতামূলক প্রচারাভিযান ও দায়িত্ব নির্ধারণের মাধ্যমে তারা একটি সুষ্ঠু কাঠামো গড়ে তুলতে পারে।
দ্বিতীয় প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো কাঁচামালের ঘাটতি। দেশে বছরে প্রয়োজন প্রায় দুই লাখ টন প্লাস্টিক স্ক্র্যাপ অথচ সরবরাহ মাত্র ৭০ হাজার টন। এটি সংগ্রহ ব্যবস্থার দুর্বলতা এবং ভোক্তাদের সচেতনতার অভাব।
তৃতীয় সমস্যা হলো এখাতের অনানুষ্ঠানিকতা। প্রায় ৯০ শতাংশ রিসাইক্লিং ব্যবসা অনানুষ্ঠানিক। যার ফলে তদারকি, অর্থায়ন এবং ব্যবসার প্রসারে বড় বাধা সৃষ্টি হয়।
তাছাড়া বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক বর্জ্য সংগ্রহখাতের স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে তারা বর্জ্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও সুযোগ-সুবিধার অভাব রয়েছে। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ও সুবিধার অভাবযুক্ত একটি বৃহৎ অনানুষ্ঠানিক কর্মীবাহিনীর ওপর এই নির্ভরতা সামাজিক ন্যায্যতার চ্যালেঞ্জ ইঙ্গিত করে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে আমরা প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার টন প্লাস্টিক রিসাইক্লিং করি, যা পরিবেশদূষণ রোধ করে মূল্যবান কাঁচামালে রূপান্তরিত হয়। প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্রকল্পে আমরা ৩২০-৩৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি। পাশাপাশি এই কার্যক্রমে এক হাজার ২০০ জনের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে। তাছাড়া পরোক্ষভাবে ১০ হাজার মানুষ উপকৃত হচ্ছে।
আমাদের এই প্রক্রিয়ায় দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ডিলার, সংগ্রাহক, কারখানা এবং ১০টি সংগ্রহ কেন্দ্র থেকে ব্যবহৃত প্লাস্টিক সংগ্রহ করা হয় এবং তা রিসাইক্লিং করে নতুন পণ্য তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনে কাজে লাগানো হয়। ফলে প্রতি বছর প্রায় ৪০০-৪৫০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়।
আমরা জনসচেতনতা বৃদ্ধিতেও সক্রিয়ভাবে কাজ করছি। বর্তমানে একটি ‘বাই ব্যাক’ পাইলট প্রোগ্রাম চালু রয়েছে, যা এ বছর সারাদেশে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া ‘লেটস সেইভ দ্য প্ল্যানেট’ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে আমরা আমাদের কর্মী ও সাধারণ জনগণকে যুক্ত করেছি দেশজুড়ে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিষ্কার অভিযানে। এই ক্যাম্পেইনে ১২ জন সংগ্রাহককে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, যারা পরিবেশ ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ উদ্যোগে যুক্ত করছি। যেমন সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিডোরের (ইউএনআইডিও) সঙ্গে অংশীদারত্ব। এর লক্ষ্য হলো ৫০০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে প্লাস্টিক বর্জ্য পৃথকীকরণ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া।
আমাদের এই কর্মসূচিগুলো জাতীয় টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা কর্মপরিকল্পনা-২০২১ এবং এক্সটেনডেড প্রডিউসার রেসপনসিবিলিটি (ইপিআর) নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমাদের বিদ্যমান সংগ্রহ ও রিসাইক্লিং কাঠামো এই নীতিমালার বাস্তব প্রতিফলন। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনানুষ্ঠানিক বর্জ্যখাত আনুষ্ঠানিক কাঠামোয় আনা হলে এই খাতের কর্মীদের আয় বৃদ্ধি ও পরিবেশগত মানোন্নয়ন সম্ভব। এ বিষয়ে প্রাণ-আরএফএল প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তবে শুধু শিল্পখাতের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। সরকার, শিল্প, সমাজ ও প্রতিটি নাগরিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্ভব নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা যেমন ২০০২ সালে বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়া উচিত। শুরুর দিকে এই নিষেধাজ্ঞা আশাব্যঞ্জক সাড়া ফেললেও দুর্বল বাস্তবায়ন ও পর্যাপ্ত বিকল্পের অভাবে তা দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর থাকেনি।
এই অভিজ্ঞতা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্যের মুখোমুখি করে। অর্থাৎ সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও পরিবেশবান্ধব বিকল্প ছাড়া প্লাস্টিক পণ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ বাস্তবে টেকসই হয় না বরং এটি অনানুষ্ঠানিক খাতে অসমতা বাড়ায়। এই জটিলতাগুলো স্বীকার করে আমরা প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরও শক্তিশালী, সহযোগিতামূলক এবং টেকসই পদ্ধতির অবলম্বন করতে পারি।
তাছাড়া ব্যক্তি এবং ব্যবসা উভয়ের জন্যই প্লাস্টিক হ্রাস ও দায়িত্বশীল ব্যবহারের মৌলিক নীতিগুলো গ্রহণ করতে হবে। এর কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি মূলনীতি (হ্রাস, পুনঃব্যবহার ও পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ)।
ভোক্তাদের উচিত সক্রিয়ভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য সঠিকভাবে আলাদা করা ও রিসাইক্লিং উদ্যোগে অংশগ্রহণ করা। পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিশীল প্রতিষ্ঠানের পণ্য ক্রয় করা।
সত্যিকার অর্থে একটি বৃত্তাকার অর্থনীতি অর্জন ও প্লাস্টিক দূষণ চিরতরে বন্ধ করার জন্য সব খাতে অব্যাহত উদ্ভাবন, কৌশলগত বিনিয়োগ এবং দৃঢ় সহযোগিতা প্রয়োজন।
লেখক: কামরুজ্জামান কামাল, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক
এমএসএম