রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন ফিরে পেতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর করা আপিলের রায় ঘোষণার জন্য রোববার (১ জুন) দিন ঠিক করা হয়েছে। এ দিন কার্যতালিকার এক নম্বর ক্রমিকে রায়ের জন্য রাখা হয়েছে মামলাটি।
Advertisement
সুপ্রিম কোর্টের রোববারের জন্য প্রকাশিত কার্যতালিকায় মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চে রয়েছে।
গত ১৪ মে এ সংক্রান্ত বিষয়ে শুনানি শেষে রায়ের জন্য ১ জুন দিন ধার্য করা হয়েছিল। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক এবং আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম।
শুনানির দিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এ টি এম মা’ছুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামীর আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল এবং ঢাকা মহানগর উত্তর জামায়াতের আমির সেলিম উদ্দিন প্রমুখ।
Advertisement
এক রিট আবেদন নিষ্পত্তি করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরবর্তীকালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে জামায়াত।
তবে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল শুনানিতে জামায়াতের মূল আইনজীবী উপস্থিত না থাকায় ২০২৩ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বিভাগ ‘ডিসমিস ফর ডিফল্ট’ বলে আপিল খারিজের আদেশ দেন। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল থাকে।
একপর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে গত ১ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে শেখ হাসিনার সরকার। সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৮(১) ধারায় জামায়াত, ছাত্রশিবিরসহ তাদের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলটি পুনরুজ্জীবনের আবেদন করা হয়। সে আবেদনের পর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আপিল বিভাগে পেন্ডিং মামলাটি পূর্ণাঙ্গ শুনানি হয়ে নিষ্পত্তি হয় নাই। ‘ডিসমিসড ফর ডিফল্ট’ হয়। সেজন্য আমরা মামলাটি পুনরুজ্জীবনের আবেদন করি। সে পুনরুজ্জীবনের (রেস্টর) আবেদন গত ২২ অক্টোবর মঞ্জুর হওয়ার পর মেরিট অনুযায়ী আবার আপিল শুনানি শুরু হয়। এর মধ্য দিয়ে নিবন্ধন ফিরে পেতে জামায়াতের আইনি লড়াইয়ের পথ খুলে যায়।
Advertisement
জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে রিট২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। পরের বছর বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন ব্যক্তি জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করেন।
রিটে জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, নির্বাচন কমিশনসহ চারজনকে বিবাদী করা হয় এবং নিবন্ধন বাতিলের আর্জি জানানো হয়।
এ রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি হয়ে অবসর) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের (বর্তমানে অবসর) সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন। এরপর জামায়াত একাধিকবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয় এবং দলের নাম পরিবর্তন করে ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ থেকে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ রাখে।
নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা হাইকোর্টের রায়ে২০১৩ সালের ১২ জুন রুলের শুনানি শেষ হয়। ১ আগস্ট হাইকোর্টের বৃহত্তর (লার্জার) বেঞ্চ জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন (বর্তমানে অবসর), বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম (পরে আপিল বিভাগের বিচারপতি পদত্যাগ করেন) এবং বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হক (গত বছরের ১৯ নভেম্বর পদত্যাগ করেন)।
সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়, এই নিবন্ধন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। একইসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীকে আপিল করার অনুমোদন দেওয়া হয়। তবে আপিল বিভাগের বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী (বর্তমানে অবসর) চেম্বার জজ আদালতে একই বছরের ৫ আগস্ট জামায়াতের রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে করা আবেদন খারিজ করেন। ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।
আপিল খারিজ২০২৩ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ জামায়াতের আপিল খারিজ করে দেন। ওইদিন রিটকারীদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তানিয়া আমির এবং আহসানুল করীম। জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলীর পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. জিয়াউর রহমান। জিয়াউর রহমান জানান, সিনিয়র আইনজীবী এজে মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত অসুবিধা এবং অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড জয়নুল আবেদীনের অনুপস্থিতির কারণে ছয় সপ্তাহ সময় চাওয়া হয়েছিল। আইনজীবীরা উপস্থিত না থাকায় আদালত মামলাটি ডিসমিস ফর ডিফল্ট (ডিফল্টের কারণে খারিজ) করেছেন। তবে রেস্টোর (পুনরায় শুনানি) করার সুযোগ আছে, যা আদালতের এখতিয়ার।
আপিল পুনরুজ্জীবন২০২৪ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ সরকার পুনর্নির্বাচিত হয়। জুলাই থেকে কোটা বিরোধী ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয়, যা সরকার পতনের দাবি পর্যন্ত গড়ায়। এরপর ১ আগস্ট সরকার জামায়াতে ইসলামীসহ তাদের অঙ্গসংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
কিন্তু ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জামায়াত নিষিদ্ধের আদেশ বাতিলের উদ্যোগ নেয়। ২৮ আগস্ট সরকার সেই নিষিদ্ধ আদেশ প্রত্যাহার করে।
এরপর জামায়াত আপিল বিভাগে নিবন্ধন মামলাটি পুনরায় শুনানির জন্য আবেদন করে। আদালত ২২ অক্টোবর বিলম্ব মার্জনা করে আপিলটি পুনরুজ্জীবন (রিস্টোর) করেন। এরপর ৩ ডিসেম্বর শুনানি শুরু হয়ে শেষ হয় ১৪ মে।
এফএইচ/এমএএইচ/এএসএম