জাতীয়

তামাক বোর্ডে সরকারের প্রতিনিধি থাকা গ্রহণযোগ্য নয়

তামাক বোর্ডে সরকারের প্রতিনিধি থাকা গ্রহণযোগ্য নয়

আন্তর্জাতিক সনদে সই করে তামাকের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার পর আবার তামাকের বোর্ডে থাকার মতো বৈপরীত্য কোনোভাবেই গ্রহনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। শনিবার (৩১ মে) বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৫ উপলক্ষে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন। এ সভারে আয়োজন করে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।

Advertisement

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমানের সভাপতিত্বে এতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম ছাড়াও বক্তৃতা করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, স্বাস্থ্যের দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান, রেল সচিব ফাহিমুল ইসলাম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর প্রমুখ।

নূরজাহান বেগম বলেন, তামাকের বোর্ডে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে চারজন আছেন। এটা কেমন করে হয়? তার সঙ্গে তাদের ছেলে মেয়েরাও চাকরিতে আছে। এটা তো হওয়ার কথা না। কিন্তু বাস্তবে এটা হচ্ছে। কাজেই আমাদের নিজেদেরও চিন্তা করতে হবে এই বোর্ডে আমাদের থাকা উচিত কি না। এখানে বেনিফিট অব ডাউট থাকেই। সরকার আন্তর্জাতিকভাবে সই করেছে তামাকের বিরুদ্ধে, আবার তামাকের বোর্ডে আমরা আছি তাদের ব্যবসা কত সুন্দরভাবে চলানো যাবে, সেটার দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য। এই বৈপরীত্য কোনোভাবে গ্রহনযোগ্য না। আমাদের স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করেই বলা উচিত। এখন যদি বলতে না পারি, তাহলে আর কখনোই এই কথাগুলো বলতে পারব না। আমরা সবার সহযোগিতা চাই।

তিনি বলেন, আমার শ্রমিকদের শোষন করবে। ঠিকমতো বেতন দেবে না। আমাদের পরিবেশ বিষিয়ে তুলবে। কিন্তু তাদেরকেই আমরা এখানে বহাল তবিয়তে রাখব, এটা হয় না। মহাখালীতে একটা জমি লিজ নিয়ে তারা কারখানা চালাতো। এবার আমরা লিজ বাতিল করেছি। কোর্টে গেছে, কোর্টেও তাদের আবেদন নাকচ করেছে। আমরা একের পর এক সব বাধা আপনাদের নিয়ে অতিক্রম করতে চাই। আমাদের পরিবর্তন ঘর থেকেই করতে হবে।

Advertisement

‘তামাকে আয়ের চেয় ব্যয় বেশি’

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা বলেন, তামাক নিয়ন্ত্রণের কথা এলে প্রশ্ন আসে রাজস্ব কমে যাবে। অথচ আমরা তাদের কাছ থেকে (তামাক কোম্পানি) ৮ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাই। অথচ তামাকজনিত রোগের জন্য স্বাস্থ্য সেক্টরে চিকিৎসা বাবদ ৪৮ হাজার কোটি টাকা খরচ করি। সামনে যেটা আসে সেটা দেখি, পেছনের খরচটা বিবেচনা করি না। আমাদের সবার এটা বিবেচনায় নেওয়া উচিত।

তামাক নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট ও তাদের কর্যক্রম পর্যাপ্ত নয় দাবি করে তিনি বলেন, আমরা যেন মোবাইল কোর্ট করতে পিছপা না হই। আমরা যেন ভয় না পাই। ভয়টাকে উপড়ে ফেলতে হবে। সিভিল সার্জনদের ওপর অনেক দায়িত্ব। এটা তার মধ্যে একটা মহান দায়িত্ব। দেশ ও পৃথিবীকে বাঁচানোর দায়িত্ব।

নূরজাহান বেগম বলেন, সিগারেট কোম্পানি আমাদের প্রলুব্ধ করে। কিন্তু আমরা প্রলুব্ধ হব কেন? এটা রোজা রাখার মতো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলে এটাও ছেড়ে দিতে পারব। না খেয়ে থাকতে পারব। আমরা যদি একতাবদ্ধ হই তাহলে এই তামাকমুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে পারব। ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাঁচানোর জন্য টিভি সিরিয়ালে ধূমপানের চিত্র দেখানো থেকে বিরত রাখতে হবে।

‘তামাক নিয়ন্ত্রণে এখন ঘা মারার সময়’

শক্তি প্রয়োগ করে হলেও তামাক বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়ে নূরজাহান বেগম বলেন, আমাদের অনেকগুলো আইন আছে। এগুলো বাধ্যতামূলকভাবে পালন করার বিষয়টি রপ্ত করতে হবে। সবাই শুনবে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা আছে- ওরে সবুজ ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা। আমাদের এখন ঘা মারার সময়। ঘা মেরে মেরে ওদের (তামাক কোম্পানি) শেখাতে হবে, একাজ তোমরা এখানে করতে পারবে না। যত প্রলোভনই নিয়ে আসো, তোমার প্রলোভনে পা দেবো না। আমার ঘরের সন্তান, অফিসের সন্তান ও দেশের সন্তানটাকে যাতে ওরা প্রলুব্ধ করতে না পারে। এই তরুণ প্রজন্ম নিয়েই আমাদের ভবিষ্যত। তাদেরই যদি শেষ করে দেয়। তাহলে আমরা কী নিয়ে বাঁচব, কাদের নিয়ে বাঁচব? যবুথবু দেশ? এদেশ কি আমরা চাই? নিশ্চয়ই চাই না।

Advertisement

‘গরুর যে বুদ্ধি, সেটাও অনেক মানুষের নেই’

একই সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেন, গরুর যে বুদ্ধি আছে, সেটাও অনেক মানুষের নেই। কারণ গরু-ছাগল তামাক পাতা খায় না। কিন্তু মানুষ খায়। এসময় তরুণদের প্রশংসা করে তিনি বলেন, যেই তরুণরা এত বড় সরকার হটিয়েছে তাদের টার্গেট করে তামাক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা করবে, এটা হবে না। আমি আশা করি, আমাদের তরুণেরা তামাক কোম্পানির এই ধ্বংসযজ্ঞ রুখে দেবে।

তিনি আরও বলেন, এই তামাক কোম্পানিগুলো তামাক চাষের জন্য নদীর পাড় বেছে নেয়। এতে মাছের প্রজনন কমছে। গরুপালনও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষের প্রজনন তো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ই।

‘তামাক কোম্পানির প্রভাব রাষ্ট্রের ওপর পড়েছে’

তামাক কোম্পানির প্রভাব পর্যায়ক্রমে রাষ্ট্রের ওপর পড়ছে দাবি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান বলেন, এটার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শক্তি প্রয়োজন। এজন্য সরকার ও বেসরকারি সব সেক্টরকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, সব নেশার মহা তোরণ ধূমপান। তামাক কোম্পানিগুলো গবেষণা করে তাদের বাজার তৈরি করে। অথচ আমরা আমাদের সন্তানদের বাঁচাতে তেমন উদ্যোগ নিতে পারছি না। ধূমপানবিরোধী লড়াইয়ের মূল ভূমিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়, পরীক্ষায় এই তামাক নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। পাঠ্যপুস্তকে একটা প্যারাগ্রাফও নেই। এটি দুঃখজনক।

সভাপতির বক্তব্যে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ও জেলা-উপজেলা হাসপাতালগুলোকে ধূমপানমুক্ত করতে হবে। শিক্ষা সংক্রান্ত ট্রেনিং ইনস্টিটিউটগুলো ধূমপানমুক্ত করতে পারলে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর নিজ প্রতিষ্ঠান ধূমপানমুক্ত করতে পারবে। ট্রেন ধূমপান নিয়ে সফলতা দেখিয়েছে, বাস পিছিয়ে গেছে। বাসে যাত্রীরা ধূমপান করেন না, ড্রাইভার হেলপাররা করে। এটাও বন্ধ করতে হবে।

এসইউজে/এএমএ/এমএস