আসন্ন জাতীয় বাজেটে সরকারের নীতি ও বাজেট সহায়তা অর্থনৈতিক নেভিগেশনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত। টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন, প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো এবং নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হলে বিদ্যমান প্রণোদনা ও নীতিগত সহায়তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অপরিহার্য।
Advertisement
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এবং টিম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ হিল রাকিব দেশের অর্থনীতি ও তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে আসন্ন বাজেট নিয়ে তার প্রত্যাশা ব্যক্ত করার সময় এই আহ্বান জানান। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের বিশেষ প্রতিনিধি ইব্রাহীম হুসাইন অভি।
এ বাজেটে আপনাদের প্রত্যাশা কী?
বর্তমানে যে নগদ প্রণোদনা এবং নীতি সহায়তা দেওয়া হয়েছে তা চালু রাখা জরুরি। পাশাপাশি নতুন খাত—যেমন ম্যান-মেইড ফাইবার বা ফ্যাশনেবল ও উচ্চমূল্যের পণ্য তৈরিতে সরকারের কারিগরি এবং আর্থিক সহায়তা দেয়া উচিত। কারণ এখানে প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য দরকার।
Advertisement
আরও পড়ুন
আসছে বাজেট, খাদ্যে বরাদ্দ বাড়ছে ৯ গুণ বাড়তে পারে বিয়ের খরচ, আরও বাড়বে করের চাপ ক্লাস্টারে সমৃদ্ধ এসএমই খাতের অন্তরায় অর্থায়ন শুল্ক কমছে ১৩৫ পণ্যের, আয়করে বিশেষ সুবিধা পাবেন জুলাইযোদ্ধারাআমরা চাই যারা নতুন করে বিনিয়োগ করবে, তাদের জন্য একটি স্থায়ী আর্থিক নীতি থাকুক। আর একটা ব্যাপার হচ্ছে, সরকার ব্যাংকারদের একতরফাভাবে ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে— তারা ক্যাপিটাল লোন, ওয়ার্কিং লোন—সব জায়গাতেই উচ্চ সুদ নিচ্ছে। তাদের নীতিমালাই এমন, যেন উদ্যোক্তা কখনো লাভ করতে না পারে। প্রশ্ন হলো, আপনি আসলে কি শিল্পের প্রসার চান? না কি ব্যাংকের মুনাফা বাড়াতে চান? দেখুন, ব্যাংক হাজার কোটি টাকা লাভ ঘোষণা করছে, অথচ আমাদের অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা কি ব্যাংকারদের জন্য কাজ করি, না দেশের অর্থনীতির জন্য?
দেশের উন্নয়নের জন্য, ব্যাংকের এমন একটি সুদের হার বিবেচনা করা উচিত যা নতুন বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে।
ডেভেলপমেন্টাল গ্রোথ নিশ্চিত করতে হলে—যেমন আপনি ম্যান মেইড ফাইবারে বিনিয়োগ চান—তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে একটি ডেডিকেটেড ফান্ড গঠন করতে হবে। ব্যাংকারদের বলবেন, ‘এই প্ল্যানে ইনভেস্ট করুন, এখানে কস্ট অব ফান্ড কমান।’
Advertisement
আরও পড়ুন
বাজেটে বাড়তে-কমতে পারে যেসব পণ্যের দাম বাজেট উপস্থাপন ২ জুন, প্রচার হবে বিটিভিসহ সব ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধান বের করতে কাজ করবে ফোরাম রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান থেকে ১৬১৪ কোটি টাকা বেশি কর আদায়ের লক্ষ্যসেটা কি ফিন্যান্সিংয়ের পলিসি বদলের দিকেই ইঙ্গিত করছে?
হ্যাঁ, আপনি হয় টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেবেন, না হয় কস্ট অব ফান্ড কমাবেন, না হয় সরাসরি ইনসেনটিভ দেবেন। চীনকে দেখুন—ম্যান মেইড ফাইবার খাতে তারা তিন থেকে আট বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছে। সরকার সেখানে অবকাঠামো তৈরি করে দিয়েছে। প্রাইভেট সেক্টর শুধু অপারেশন করছে। এতে তাদের আরওআই তথা বিনিয়োগের ওপর রিটার্ন নিশ্চিত হচ্ছে। এমনকি সরকারি বেসরকারি অংশীদারিত্ব মডেলেও তারা সফল। আমাদের ক্ষেত্রেও সেই রকম দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা দরকার।
আপনি যদি সেই সুযোগ না দেন, তাহলে নতুন শিল্প গড়ে উঠবে কীভাবে? বাজেটে যদি এসবের প্রতিফলন না থাকে, আমাদের সঙ্গে আলোচনা না করে যদি আপনি শুধু সংখ্যা দিয়ে বাজেট পাস করে দেন, তাহলে কেউই আর কমফোর্ট ফিল করবে না বিনিয়োগে।
উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। বাজেট সহায়তার মাধ্যমে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?
দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অস্থিরতার কারণে, উৎপাদন ব্যয় তীব্র বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলস্বরূপ, আমরা প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা হারাচ্ছি। প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে এবং রপ্তানি বাজারে আরও রপ্তানি বাড়াতে নীতি সহায়তার বিকল্প নেই।
যাদের সঙ্গে আমরা প্রতিযোগিতা করছি, তাদের মতো সাপোর্ট যদি না পাই, তাহলে কীভাবে টিকে থাকব? আপনি ৪০ বছর ধরে আরএমজিকে সাপোর্ট দিচ্ছেন। দেশের রিজার্ভ বাড়ছে, এক্সপোর্ট বাড়ছে—এসব আরএমজির মাধ্যমেই। তাহলে এখন কেন পিছিয়ে আসবেন?
আরও পড়ুন
এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি, সম্ভাব্য করহার চালু থাকছে ৩৫ বছর পর কাঁচা-ওয়েট ব্লু চামড়া রপ্তানির সুযোগ দ্বিগুণ হচ্ছে ভ্যাট, প্লাস্টিক পণ্য-এসি-ফ্রিজের দাম বাড়তে পারে বাস্তবভিত্তিক-জীবনঘনিষ্ঠ বাজেট চান সাধারণ মানুষআরও ১০০ বিলিয়ন ডলার আনার জন্য এই সেক্টরই সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। কিন্তু আপনাদের কাছ থেকে ভিক্ষাও তো চাইছি না—চাচ্ছি বাস্তবসম্মত নীতিগত সহায়তা।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন করহার রপ্তানিকারকদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। উত্তরণে বাজেটে কী ধরনের পদক্ষেপ থাকা উচিত?
ধরুন, ইউএসএ থেকে আমাদের যেসব পণ্য আমদানি হয়, তার একটা রেভিনিউ ম্যাপিং করতে হবে। এরপর রপ্তানিকারকদের সঙ্গে বসে আগামী ১০ বছরের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—আমদানি রাজস্ব কমিয়ে সেই ঘাটতি কি রপ্তানি আয় থেকে পূরণ করা সম্ভব?
এভাবে একটি সুপরিকল্পিত প্রস্তাব দিলে, মার্কিন সরকারের সঙ্গেও আলোচনা সম্ভব। এলোমেলোভাবে বাজেট পাস করলে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ব্যাংকিং ব্যবস্থার দিক থেকে কি আপনারা কোনো নির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে চান?
হ্যাঁ। আমাদের অর্থনীতি কিন্তু একমুখী নয়। বড় শিল্প আছে, মাঝারি ব্যবসা আছে, আছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প। সবার জন্য একটা ‘ওয়ান সাইজ ফিটস অল’ পলিসি চলবে না।
আরও পড়ুন
বাণিজ্য বৈষম্যের ঝুঁকিতে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতি মার্কিন শুল্ক-ভারতের নিষেধাজ্ঞায় চাপে পড়বে দেশের রপ্তানি খাত ভারতে পণ্য রপ্তানিতে অতিরিক্ত কত পথ পাড়ি দিতে হবে? দেশে নিবন্ধিত কারখানা-দোকান-প্রতিষ্ঠান সাড়ে ৯৪ হাজারএসএমই খাতের জন্য আলাদা ফান্ড, আলাদা সুদের হার, আলাদা ব্যাংকিং চ্যানেল থাকতে হবে। না হলে তারা টিকবে না। অথচ তাদের টিকিয়ে রাখলেই পরবর্তীতে বড় ব্যবসায় রূপান্তর সম্ভব। ইকোসিস্টেম মানে সবার সহাবস্থান নিশ্চিত করা, শুধু ধনীদের আরও ধনী করে তোলা নয়।
নতুন উদ্যোক্তারা কেন আসছে না?
এখানেই তো প্রশ্ন। আমি যদি নতুন হই, তাহলে আমার জন্য কী ইনসেনটিভ আছে? আমি জানি, ব্যাংকারদের হাতে সব ক্ষমতা। অলিখিতভাবে ঠিক করা আছে, নতুন কেউ যেন না আসে। পুরাতন বড় গ্রুপগুলোকেই সব সুযোগ দেওয়া হয়। যখন নীতিনির্ধারকরা নিজেরাই চান না কেউ নতুন করে আসুক, তখন সেক্টর এগোবে কীভাবে? এই মানসিকতা না বদলালে কোনোভাবেই শিল্পায়ন এগোবে না।
আইএইচও/এমএমএআর/এমএস