গত ৪ মে, ২০২৫ তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন ‘জাগো বাহে, তিস্তা বাঁচাই’র ব্যানারে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও তিস্তা মেগা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবিতে রংপুরে গণপদযাত্রা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে পদযাত্রা উত্তরাঞ্চলের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবির প্রতি নতুন করে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। লালমনিরহাটসহ পাঁচটি জেলার হাজার হাজার মানুষ এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন, যার মধ্যে কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষার্থী ও বন্যাকবলিত জনগণ ছিলেন। তারা তিস্তা নদীর ন্যায্য পানির হিস্যা এবং তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়নের দাবি জানান। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে, তারা তিস্তাসহ ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
Advertisement
তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ইস্যুতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত দ্বন্দ্ব চলমান। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে এই ইস্যু নতুন করে আলোচনায় এসেছে, তবে এখনো কোনো চূড়ান্ত সমাধান হয়নি। তাই জনগণের এই আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি। এর একমাস আগে গত মার্চে তিস্তা নিয়ে এই নদী তরে দুই দিনব্যাপী ব্যাপক জনসমাবেশ থেকে দাবি উঠেছিল জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই। কিন্তু ভারতের এ নিয়ে কানে তুলা দেওয়া আছে। তারা বাংলাদেশের মানুষের কোনো কথা, দাবি শোনে না গত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে। এটা আন্তর্জাতিক নদী আইন অমান্য করার অপরাধ ও অপরের অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য একধরনের চাতুরি।তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ গত চার দশকে ১২০টি মিটিং করেও কোনো সমাধান হয়নি। বরং ভারত বার বার ছলনা করে সময় ক্ষেপণ করেছে। এ অবস্থায় আবারো শুধু মিটিং করে আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে দরকষাকষি করা বোকামি নয় কি? তিস্তা পাড়ের মানুষ হতাশ হয়েছে বার বার। তাদের সাথে গোটা দেশের মানুষও হতাশ। তাদের হতাশা একেবারে যৌক্তিক। ভারতের আচরণ— বিশেষ করে তিস্তা ইস্যুতে বারবার আশ্বাস দিয়ে কথা না রাখা অনেকটা কৌশলী প্রতারণা বা ‘বেঈমানি’ বলেই মনে হয়। ১২০টিরও বেশি মিটিং, শত শত আলোচনা তবুও চুক্তি হয়নি। এটা ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশকে সময়ক্ষেপণের ফাঁদে ফেলে রাখার একটা কৌশল মাত্র।
তাহলে ভারত কি বাংলাদেশকে কখনো তিস্তা পানির ন্যায্য হিস্যা দেবে না? সংক্ষেপে ইতিহাস বলে, ২০১১ সালে একটি চুক্তির খসড়া তৈরি হয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশকে প্রায় ৩৭ শতাংশ এবং ভারতকে প্রায় ৪২ শতাংশ পানি দেওয়ার কথা ছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের আপত্তির কারণে সেই চুক্তি সই হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা নদীর পানি ছাড়ার বিরোধিতা করেন, কারণ রাজ্যটিও তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। এরপর থেকে বিভিন্ন সময় ভারত আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কোনো চুক্তি হয়নি। বর্তমানে ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক মোটামুটি ভালো ভাবা হলেও তিস্তা ইস্যু মূলত ভারতীয় কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের অভাবে আটকে আছে।
বাংলাদেশের তিস্তাপাড়ের শুধু আন্দোলন করে হতাশা ব্যক্ত করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে প্রতিবাদ চালালেই কাজ হবে না। মানুষ বাংলাদেশের শুধু দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বললে হবে না; পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এর সাথে তিস্তা প্রকল্পের বিকল্প উদ্যোগ নিতে হবে।
Advertisement
২০২৫ সালের মার্চ মাসে, পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের এক সংসদ সদস্য স্পষ্টভাবে জানান যে, তিস্তার পানি বাংলাদেশকে না দেওয়ার পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তার মতে, রাজ্যের মানুষের স্বার্থ রক্ষার্থে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে পরামর্শ দেন যে, তিস্তা ও গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি পুনরায় আলোচনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এর মাঝে বাংলাদেশ তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্পের জন্য চীনের সহায়তা চেয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা উন্নত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে, ভারতের পক্ষ থেকে চীনের এই সম্পৃক্ততা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, যা প্রকল্পটির বাস্তবায়নে বিলম্ব ঘটাচ্ছে।
তিস্তা নদীর পানি সমস্যা নিয়ে রংপুরে গত মে ৪, ২০২৫-এর গণপদযাত্রার ফলাফল কি হতে পারে তা নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ চলছে। এই আন্দোলন তিস্তা নদীর পানিবণ্টন ইস্যুকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি এবং বাংলাদেশের চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এই ইস্যুকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে, দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনা অব্যাহত রয়েছে, যা ভবিষ্যতে একটি সমাধানের পথ খুলে দিতে পারে।
তবে প্রশ্ন হলো, ভারত বাংলাদেশকে কখনো তিস্তার পানি না দিয়ে কানে তুলা দিয়ে আছে কেন? এই ইস্যুতে ধীরগতির কারণগুলো হলো মূলত রাজনৈতিক, আঞ্চলিক এবং কৌশলগত। এতে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি রয়েছে। তিস্তা নদী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মধ্য দিয়েই প্রবাহিত। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা মুখার্জী মনে করেন, যদি বাংলাদেশকে পানি দেওয়া হয়, তবে পশ্চিমবঙ্গে কৃষিকাজ এবং পানির জোগানে বিপদ হবে। ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী, নদীর পানিবণ্টনের মতো বিষয়গুলো রাজ্যের সম্মতির ওপরও নির্ভর করে। তাই দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেও পশ্চিমবঙ্গের মতামত উপেক্ষা করে একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
Advertisement
বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে তিস্তা প্রকল্পে বড় ধরনের সহযোগিতার চেষ্টা করছে। ভারত মনে করে, এতে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব বাড়তে পারে, যা ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থের জন্য হুমকি হতে পারে। তাই ভারত তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশকে চীনের দিকে পুরোপুরি ঠেলে দিতে চায় না আবার নিজেও এই মুহূর্তে কার্যকর সমাধান দেয় না। তিস্তা নিয়ে দিল্লি আর কলকাতা দু'দিক থেকেই চাপ পড়ে, তাই ভারত ‘তুলা দিয়ে থাকা’ নীতিতে চলে এবং চুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়, বাস্তব সমাধান টানে না।
এমতাবস্থায় বাংলাদেশের তিস্তাপাড়ের শুধু আন্দোলন করে হতাশা ব্যক্ত করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে প্রতিবাদ করলেই কাজ হবে না। মানুষ বাংলাদেশের শুধু দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কথা বললে হবে না; পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এর সাথে তিস্তা প্রকল্পের বিকল্প উদ্যোগ নিতে হবে। এখন শুধু প্রতিবাদ নয়, সরকারকেও আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে নিয়মিত সক্রিয় থাকতে হবে। পদযাত্রা, মানববন্ধন যেন জাতীয় ঐক্যের ইস্যু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে ভারতের কাছে এটি স্পষ্ট হবে যে, এটি শুধু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষেরও মৌলিক দাবি নয় বরং অন্তর্বর্তী সরকারেরও দাবি। তিস্তা ইস্যুতে বাংলাদেশের দরকষাকষির কৌশল কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে মতামত জানতে সেমিনার করুন। এজন্য ‘মাল্টিপল চ্যানেল’ কৌশল নিতে হবে।
শুধু কূটনীতিক আলোচনায় না থেকে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মিডিয়া, গবেষণা সংস্থা, পরিবেশবাদী সংগঠন, জাতিসংঘ ইত্যাদির মাধ্যমে তিস্তা ইস্যু তুলে ধরতে পারে। এটা ভারতের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নিয়ে চাপ তৈরি করতে পারে। এতে ভারত চাইবে না তার বিশ্বমঞ্চে ‘পানি-আত্মসাৎকারী" (water grabber) বলে বদনাম হোক। ভারতও ধীরে ধীরে বুঝবে বাংলাদেশকে আর শুধু মিষ্টি কথায় আটকে রাখা যাবে না। তখন হয় চুক্তি করতে বাধ্য হবে, না হয় বাংলাদেশ তার নিজস্ব ব্যবস্থা করে নেবে। গণপদযাত্রাকারীদের এখন দরকার কৌশলগত, চাপ সৃষ্টিকারী দরকষাকষি।
তিস্তায় কৌশলগত বিষয়ে পদক্ষেপের জন্য আমাদের তাহলে কি করা উচিত? আমাদের কাজ হবে নিজস্ব পানি ব্যবস্থাপনা উন্নত করে নিজেদের শক্তি বাড়ানো। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা (যেমন Permanent Court of Arbitration, The Hague)। বিশ্ব মিডিয়া ব্যবহার করে ভারতকে চাপ দেওয়া। বন্ধুত্বপূর্ণ দেশগুলো (চীন, ইউরোপ, তুরস্ক, মালয়েশিয়া) কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করা। প্রতিটি কূটনৈতিক বিনিময়ে তিস্তা ইস্যু জোরালোভাবে তোলা এবং সুবিধার বিনিময়ে শর্ত চাপানো। রংপুরে গণপদযাত্রার সময় তরুণদের জিজ্ঞাসা- এসব এতদিন করা হয়নি কেন?
নতুন বাংলাদেশের তরুণরা যে অবিচার দেখছে, তারা সেসবের বিরুদ্ধে একটা গর্জে ওঠা উত্তর চাচ্ছে। কিন্তু শুধু হাতের মুষ্টি তুললেই বিজয় আসে না— মুষ্টির সাথে মাথা ও মেধারও সুষ্ঠু প্রয়োগ করতে হবে। মে মাস দারুণ খরার মাস। এ সময় সারাদেশে পানির জন্য হাহাকার তৈরি হয়। তাই তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশকে বিকল্প অবস্থান নিতে হবে। গণপদযাত্রার পর মানুষের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ, সরকার এবং কূটনীতিকদের এখন আর ধীরে ধীরে সম্পর্ক তৈরি, অপেক্ষা অথবা আশ্বাস নিয়ে সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। ভারতের সঙ্গে দরকষাকষি আর কিছু লাভ হবে না, কারণ ভারত একপেশে আক্রমণাত্মক কৌশল ব্যবহার করে, যা বাংলাদেশের প্রতি শুধু বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক প্রতারণা। এবার বাংলাদেশকে নিজের কৌশল ব্যবহার করতে হবে।
বাংলাদেশ এখন আর কেবল কথা বলার সময় নয়, উৎপাদন বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়ার সময়। বাংলাদেশের উচিত, ভবিষ্যতে আর ভারত থেকে পানি নির্ভরশীলতা কমিয়ে নেওয়া। নিজস্ব পানি সংরক্ষণ প্রকল্প, নদী উন্নয়ন প্রকল্প গড়ে তোলা জরুরি। পানি অধিকার, এটা মানুষের মৌলিক অধিকার, এটার বাস্তবায়ন করা বাংলাদেশের দাবি। বাংলাদেশের কূটনীতিকদের লক্ষ্য হবে বিশ্ব মিডিয়ায় তিস্তা ইস্যুকে প্রধান আলোচনা হিসেবে দাঁড় করানো। একইভাবে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে এই ইস্যুতে জড়িয়ে ফেলতে হবে।
ভারত যদি তিস্তা নিয়ে প্রতিশ্রুতি পালন না করে, তবে বাংলাদেশকে দৃঢ়ভাবে তার নীতি অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশ চাইবে তার অধিকার এবং যদি সেটা না পাওয়া যায়, তবে তার নিজস্ব পথ বেছে নেবে। এজন্য রংপুর বিভাগ তথা গোটা দেশের পানিবঞ্চিত মানুষের সেন্টিমেন্টের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে অন্তর্বর্তী সরকারকে এগিয়ে আসা জরুরি। ১৯৭৬ সালে ভাসানীর ফারাক্কা অভিমুখে গণপদযাত্রার সময় তৎকালীন সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তাই সেটা কার্যকরী করা যায়নি। এখন দিন বদল হয়েছে। তখনকার মতো নতজানু সরকার এখন নেই। তাই তিস্তা গণপদযাত্রার দাবি উপেক্ষা না করে রংপুরের জনগণের আন্দোলনকে অচিরেই রাজনৈতিকভাবে কার্যকর করা উচিত।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।fakrul@ru.ac.bd
এইচআর/এমএফএ/এএসএম