জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে-জুন মাসে।প্রথম দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য দেখা গেছে ব্যাপক। জুলাই বিপ্লবের পর নতুন ব্যবস্থাপনায় দেশ পরিচালনার উদ্দেশে সংস্কার কমিশনগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর থেকেই এ নিয়ে বিপরীতমুখী আলোচনা চলছিল রাজনৈতিক মহলে। বলা যায় চূড়ান্ত অবস্থা দেখা যায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তাদের আলোচনার প্রথম দফা চলাকালেই। কথা ছিল ন্যূনতম ইস্যুতে মতৈক্য প্রতিষ্ঠা মাধ্যমে আগামী নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবে সরকার। বাস্তবতা হচ্ছে, মত ও পথের দূরত্ব এতই বেশি যে,সরকারের দশ মাস বয়স হলেও কিনারা করতে পারছে না জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
Advertisement
পুরো কর্মকাণ্ডই রাজনৈতিক দলগুলোকে কেন্দ্র করে। তারাই কর্মসূচির অংশীজন।গণতান্ত্রিকভাবেই তারা ভিন্ন মত ও ভিন্নপথের । কোনো রাজনৈতিক প্রশ্নে তারা শতভাগ একমত হবে এমনটা প্রত্যাশা করা যায় না। কিন্তু মৌলিক কিছু প্রশ্নে তাদের মধ্যে ন্যূনতম ঐকমত্য হতে পারে। যেহেতু তারা সংস্কার কমিশন কিংবা ঐকমত্য কমিশনে নেই তাই ধাপে ধাপে দলগুলোর মতামত গ্রহণ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। যেহেতু এখনও তারা সেই লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়নি,তাই রাজনৈতিক দলগুলোর মতো তাদেরও আলোচনায় আসার প্রয়োজন বলে মনে করি। শুরুতেই দেখা যাক,তারা কাদের আলোচনায় ডেকেছে,কাদের প্রস্তাবগুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছে।
বাংলাদেশে এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৫৫টি। এরমধ্যে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছে ৩৩টি দল। প্রশ্ন আসতেই পারে, বাকি দলগুলো কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অধিকার বহির্ভুত? এর মধ্যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গকে বাদ রাখা যায়-তাদের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে। তাইলে আরও বাকি থাকে ২১টি দল। সেই হিসাবে দেখা যায়-আলোচনায় অংশ নেয়ার যোগ্য দলগুলোর প্রায় সমানসংখ্যক দলই মতামত প্রদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই দলগুলোর মধ্যে এমন নেতাও আছেন যাদের ব্যক্তিগত ইমেজও দৃশ্যমান। যাদের বিরুদ্ধে জুলাই অভ্যুত্থানের বিরোধিতার অভিযোগও কম কিংবা নেই। তারা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটেরও অন্তর্ভুক্ত নয়। এমন কয়েকটি দলকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় দেখা যায়নি।
১৪দলীয় জোটভুক্ত নয় এমন দল জাতীয় পার্টি জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় এক দুইবার বসার সুযোগও পেয়েছিল। যেমনি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের কথাও বলা যেতে পারে। শুধু তাই নয়,নিবন্ধিত বাকি দলগুলো যারা ১৪দলীয় জোটভুক্ত নয় এমনকি জুলাই অভ্যুত্থানের সমর্থক তাদেরও আলোচনায় গুরুত্ব না দেয়াটা ইতোমধ্যে আলোচনায় আসছে। আবার রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন পায়নি,সাংগঠনিক ভিত্তিও প্রশ্নাতীত নয় এমন দলগুলোকেও আলোচনার টেবিলে দেখা যায়। তাদের কণ্ঠও উচ্চ। তাদের পরিচিতি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সহযোগী হিসেবে। হয়তো জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়ার সুবাদে তাদের সুযোগ হয়েছে। এ নিয়ে আপত্তির সুযোগ কম।
Advertisement
জুলাই অভ্যুত্থানের সহযোগী কিংবা বিরোধী হিসেবে যে বিভাজন করা হয়েছে এটা এই মুহূর্তে মানুষ স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে। কারণ জুলাই অভ্যুত্থানের আবেগ এখনও তাজা হওয়ার কারণে। কিন্তু আবেগমুক্ত সময়ে অবশ্যই প্রশ্ন দেখা দেবে, কেন তাদের আলোচনা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের আগে থেকেই কিঞ্চিৎ আলোচনা হয়েছিল-সংস্কার কমিশনগুলো নিয়ে। সংস্কার কমিশনগুলো গঠিত হয়েছে মূলত তাত্ত্বিক দিক বিবেচনা করে। বিজ্ঞজনেরাই ছিলেন সংস্কার কমিশনগুলোতে। কিন্তু যাদের জন্য সংস্কার অর্থাৎ যারা এই সংস্কার কাজ বাস্তবায়ন করবেন,তাদের কাউকে সংস্কার কমিশনে রাখা হয়নি। সংস্কার কমিশনে যদি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের রাখা হতো তাহলে আজকে যেভাবে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে হচ্ছে, সেই কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেতো। ভিন্নপথে যাত্রায় যে জটিলতা তৈরি হয়েছে তাই স্পষ্ট হচ্ছে এখন। যে কারণে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠনের যৌক্তিকতাই আজকে প্রশ্নের মুখে। তারা সমালোচিত হচ্ছেন- নির্বাচন বিলম্বিত করার কুশিলব হিসেবে।
ন্যূনতম ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ৩৩টি দলের সঙ্গে আলোচনা করে যেসব বিষয়ে ঐক্যের কাছাকাছি যেতে পেরেছে, সেগুলো রাজনীতির জটিলতা কাটাতে গৌণ ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু ভিন্নমতগুলো এতই বিপরীতমুখী যে সেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অন্যদিকে নতুন যাত্রায় এসব ইস্যুতে সর্বসম্মত মত আসা উচিত ছিল। রাজনৈতিক পক্ষগুলো আদর্শিক দিক বিবেচনার চেয়ে দলীয় স্বার্থ চিন্তার বিষয়ে অধিক উৎসাহী বলে মনে হয়। যে কারণে তাদের অবস্থান রীতিমতো ১৮০ ডিগ্রি।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনার পর দলগুলোর যে মতামত পাওয়া গেছে তা বাছাই হবে কোন পদ্ধতিতে,বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়। দলের সংখ্যা যদি মূল্যায়ণের মাধ্যম হয় তখন সেই মূল্যায়ণ কতভাগ মানুষের মতামতকে প্রতিফলন ঘটাবে, এমন প্রশ্ন আজ না হয় কাল আসবেই। যারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ডাক পেয়েছে তাদের মধ্যে একমাত্র বিএনপি ও জামায়াতের গণভিত্তি আছে। তারমধ্যে আবার জামায়াতে ইসলামির গণভিত্তি বিএনপির তুলনায় অতি সামান্য, এটা প্রমাণিত বিভিন্ন মাধ্যমে। বাকি দলগুলোর অধিকাংশই ওয়ানম্যান শো বললেও বেশি ভুল হবে না। সেক্ষেত্রে দলের সংখ্যা দিয়ে যদি মতামত গ্রহণ করা হয় তাহলে সেটি জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব করবে না এটাই স্বাভাবিক। আবার শক্তিশালী জনভিত্তির দল হিসেবে বিএনপির মতকে যদি প্রাধান্য দেওয়া হয় তখন সংশ্লিষ্ট দলগুলো কি তা মেনে নেবে? মানবে না যে, এটা প্রমাণ হয়ে যায় উপস্থাপিত সুপারিশগুলোর দিকে তাকালে।
Advertisement
নির্বচান হলে যেসব দল হয়তো দুয়েকটি আসন পেতে পারে কিংবা যাদের কোনো আসন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই এমন দলগুলো সংখ্যানুপাতিক ভোটের নিরিখে উচ্চকক্ষ গঠনের দিকে জোর দিচ্ছে। কিন্তু বড় দল হিসেবে বিএনপি সেটা মেনে নিতে চাইবে না এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি চাইছে এখন যেভাবে সংসদে প্রাপ্ত আসনের ভিত্তিতে সংরক্ষিত আসনগুলো পূরণ হয় সেভাবেই হোক। এই পদ্ধতি ছোট দলগুলোর কাছে গ্রহণযোগ্য নয় কারণ তারা জানে হয়তো তারা কোনো আসনেই বিজয়ী হবে না। এখন ভোটের আনুপাতিক হার বিবেচনায় আনলে তারা নিন্মকক্ষে কোনো আসন না পেলেও উচ্চকক্ষে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। এদিক থেকে ছোট দলগুলোকে প্রতিনিধিত্বের সুযোগ দেওয়ার পক্ষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন বা সংস্কার কমিশনগুলো। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেওয়া ৩৩ দলের মধ্যে ২১টি দলই সংখ্যানুপাতিক সদস্য চায়। এই ২১টি দলই আকারে ছোট হয়তো যাদের দেশভিত্তিক সদস্যসংখ্যা বিএনপির একটি জেলার সদস্যের সমানও নয়।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমিয়ে আনার ব্যাপারে যদিও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়ও কিন্তু কত মেয়াদ একজন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, এ বিষয়টি সমাধান করাও কঠিন হবে। এখানেও দলগত ভাবনার বিষয় আছে। বড় দলগুলো পরিচালিত হয় কোনো আইকন দ্বারা। সেখানে নেতার পরিচয়ে দলের পরিচয় হয়ে থাকে বললেও ভুল হবে না। কিন্তু ছোট দলগুলো নিজেরাই দলীয় নেতা নির্বাচনে হিমসিম খায়। তাদের সেরকম আইকনও নেই। যে কারণে একজন একবার নাকি ৫বার প্রধানমন্ত্রী হবেন সেটা তাদের কাছে বড় বিষয় নয়। তারপরও সবাই যাতে নেতৃত্বের স্বাদ পেতে পারেন তেমন ভাবনা থেকে তারা দুইবারের বেশি কারো প্রধানমন্ত্রী না হওয়ার সুযোগকে সমর্থন করে। কিন্তু বড় দল হিসেবে বিএনপি সেটা মানবে বলে মনে হয় না।
আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্র স্টাইলে সিটি করপোরেশন,পৌরসভার মতো স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধিদেরও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটার করা নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কও সহজে সমাধান হবে বলে মনে হয় না। দফাভিত্তিক এমন অনেক বিষয়ই আছে যা রাজনৈতিক দলগুলোর দূরত্ব তৈরি করে রেখেছে। অন্যদিকে সংস্কার কমিশন যেসব প্রস্তাব জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে উপস্থাপন করেছে সেগুলো নিয়েও কথা উঠেছে যে, তারা একটি দলের মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করার মতো প্রস্তাবগুলো তৈরি করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ধীরগতির কাজকে রাজনৈতিক আলোচকদের কেউ কেউ নির্বাচন বিলম্বিত করার কৌশল হিসেবে মনে করছেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে এমন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদের কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে- তারা কোনো মত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে না,রাজনৈতিক দলগুলোর মতকেই তারা গুরুত্ব দেবে। ভিন্নমত ও ভিন্নপথের মানুষকে কাছাকাছি আনতে পারার সাফল্যের ওপর নির্ভর করে তাদের কাজের মূল্যায়ন কেমন হবে।
লেখক-সাংবাদিক,শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।
এইচআর/এএসএম