বিশ্বজুড়ে ২২ মে পালিত হয় আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস। জীববৈচিত্র্য বিষয়ক আলোচনার প্রসার এবং মানুষের মধ্যে এর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই দিনটি উদযাপন করা হয়। তাই এ দিবস উপলক্ষে জীববৈচিত্র্য নিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তাধারা তুলে ধরেছেন কাজী মালিহা আকতার—
Advertisement
শহুরে পরিবেশে জীববৈচিত্র্য কংক্রিটে রূপান্তরশৈশবে যে গ্রামবাংলার প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে পড়েছি; সেই পরিবেশ, পশুপাখি, গাছপালা, তরুলতা, কীটপতঙ্গ, নদী ইত্যাদির অনেকটা বিলুপ্ত। একসময় আমাদের পরিবেশ ঠিক তেমনই ছিল; যেমনটা কবি-সাহিত্যিকরা তাদের লেখায় তুলে ধরেছেন। চারদিকে ছিল সবুজের সমারোহ, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, রাতে জোনাকির আলো, পাখির কুজন, খালে-বিলে স্বচ্ছ পানি। এখন চারদিকে কেবল ইট, কংক্রিট, আবর্জনা আর যান্ত্রিকতা। নগরায়নের যুগে আমরা প্রযুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আর হারিয়ে ফেলছি প্রকৃতির অসংখ্য জীববৈচিত্র্য। জীববৈচিত্র্য হলো প্রকৃতির প্রাণ। কিন্তু নগরায়নের কারণে বনভূমি উজাড় হচ্ছে, জলাশয় ভরাট হচ্ছে আর বাসস্থান হারাচ্ছে হাজারো প্রাণী। একসময় চড়ুই ঘরের বারান্দায় এসে বসতো, বসন্তে কোকিলের গান শোনা যেতো; আজ তাদের দেখা মেলে না। প্রতিনিয়ত পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা, দূষণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যার কারণে জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব হুমকির শিকার। মোট কথা, জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে না পারলে আমরাও বাঁচবো না। তাই শহুরে পরিবেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে কিছু উদ্যোগ নেওয়া উচিত—ছাদে বাগান করা, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার, দূষণ কমানো, শহরে ছোট বন তৈরি, পাখি শিকার বন্ধ ইত্যাদি।
সাইমা হাসানশিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম কলেজ।
****
Advertisement
জীববৈচিত্র্য আজ প্রকট সংকটে সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের বাস, দুঃখজনক হলেও সত্য বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়ছে। প্রকৃতির যে সৌন্দর্য হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন, প্রাণীদের জীবনচক্রের সুষ্ঠুধারা গতি হারাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ বসবাসের পৃথিবী হয়ে উঠছে অসহনীয় উত্তপ্ত এবং বায়ুমণ্ডলের স্তর অস্বাভাবিক। অবাধে বৃক্ষনিধন, বনাঞ্চল উজাড়, বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে জীববৈচিত্র্য পরিবর্তন হচ্ছে। বাংলাদেশে ঋতুচক্রের পরিবর্তন লক্ষণীয়, যেমন- অনাবৃষ্টি, খড়া এবং উত্তপ্ততা বাড়ছে। উন্নত বিশ্বে কাঠ দিয়ে ঘর-বাড়ি তৈরি করা হয়। এদিকে আবাসনের জন্য আমরা ইট-পাথরের ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি, নদ-নদী জলাশয় ভরাট, কলকারখানা যানবাহনের বিষাক্ত গ্যাস নিঃসরণ, আবর্জনার স্তূপের কারণে জলবায়ুকে দূষিত করছি। আধুনিকতার নামে স্বাভাবিক পরিবেশকে করছি বিনষ্ট। পৃথিবীকে সুন্দর এবং বাসযোগ্য রাখার দায়িত্ব সবার এবং তা নিজেদেরই স্বার্থে। তাই বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণগুলো চিহ্নিত করে সমস্যা সমাধানের পথে আমাদেরই হাঁটা উচিত।
নুসরাত জাহান জেরিনশিক্ষার্থী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া আইন কলেজ।
আরও পড়ুনকৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবনযাত্রার প্রতীক গরুপ্রাকৃতিক অক্সিজেন রক্ষা দিবসে গ্রিন ভয়েসের ৫ দাবি****
জীববৈচিত্র্য ধ্বংস আগামীর বিশ্বে অশনিসংকেতজল ও স্থল সব জায়গায় উদ্ভিদ ও প্রাণী বসবাসের নিজস্ব বৈচিত্র্য বিদ্যমান। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে আজ জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। প্রাকৃতিক কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে জলবায়ুর পরিবর্তন, ভূমিকম্প, খরা ও সুনামিসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। একসময় গাছপালাসমূহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করলেও বর্তমানে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম হওয়ায় দুর্যোগ মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ বলা যায়। তাই আমাদের বৃক্ষনিধন বন্ধ করে বৃক্ষরোপণ বাড়াতে হবে। মানবসৃষ্ট কারণসমূহের মধ্যে রয়েছে অধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার, পরিবেশদূষণ ও অন্য জায়গা থেকে আসা আগন্তুক জীবপ্রজাতির আগ্রাসন ইত্যাদি। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নানা আইন ও কঠোর পদক্ষেপের কথা বলা হলেও তা প্রয়োগের শীতলতা মানুষদের অপরাধপ্রবণ করে তুলছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস কেবল প্রাণী নয় বরং মানব অস্তিত্বের জন্যও হুমকিস্বরূপ। আমাদের সুন্দর ও নির্মল পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সবাইকে এগিয়ে আসা জরুরি।
Advertisement
তৈয়বা খানমশিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ।
****
জীববৈচিত্র্যের ঝুঁকি, প্রতিকারেই সমাধানপৃথিবীর বেশিরভাগ জীববৈচিত্র্য মানুষের ব্যবহার এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডের কারণে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যা বাস্তুতন্ত্রকে বিশৃঙ্খল করে। এমনকি কখনো কখনো বিনষ্টও করে ফেলে। বিশ্বে এই জীববৈচিত্র্য বর্তমানে হুমকিতে রয়েছে। এর মধ্যে মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সরাসরি এটি ধ্বংসের জন্য দায়ী। যেমন- প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, দূষণের মাত্রা অত্যাধিকহারে বৃদ্ধি পাওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন, অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী পাচার ও হত্যা। এই জীববৈচিত্র্যের সাথে বাস্তুতন্ত্র জড়িত বলে এটি বৈশ্বিক সমস্যা। তাই এটির প্রতিকারে নিম্নোক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করি। যেমন- জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করতে হবে। প্রাকৃতিক বনায়নকে প্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের গাছ আহরণ বন্ধ রাখতে হবে। সরকারি পদক্ষেপের সাথে সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
উম্মে সালমাশিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ।
****
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে তরুণদের করণীয়জীববৈচিত্র্য পৃথিবীর প্রাণ-প্রবাহের মূল চালিকা শক্তি। জীববৈচিত্র্য মানে পৃথিবীর সব জীবের বৈচিত্র্য—উদ্ভিদ, প্রাণী, মাইক্রোঅর্গানিজমসহ সমগ্র বাস্তুতন্ত্র। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ১০,০০০ প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে পড়ে (ইউএন রিপোর্ট ২০২২)। বাংলাদেশেও এই সংকট প্রকট। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত দুই দশকে দেশের ৩১টি স্তন্যপায়ী ও ১৫টি পাখি প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। জীববৈচিত্র্য শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয় বরং মানবজীবন টিকে থাকার অন্যতম প্রধান উপাদান। কিন্তু বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ, অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার ও প্লাস্টিক দূষণের ফলে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। এই পরিস্থিতিতে তরুণদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধু ‘আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস’ পালন নয় বরং প্রতিদিনের কাজেই হতে হবে পরিবেশবান্ধব। তরুণরা সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারে—যেমনটি করেছে ‘Green Savers’। গাছ লাগানো, স্থানীয় প্রজাতির সংরক্ষণে অংশগ্রহণ, প্লাস্টিক ব্যবহার হ্রাস, ওয়ার্কশপের আয়োজন ইত্যাদির মাধ্যমে তরুণরা বাস্তব পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। তরুণদের প্রতিদিনের ছোট ছোট পদক্ষেপই হতে পারে জীববৈচিত্র্য রক্ষার বড় হাতিয়ার।
তানজিনা আক্তার চৈতিশিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ।
এসইউ/এমএফএ